▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৮

                                       


                           পর্ব-৮ 

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-২

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৩

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৪

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৫

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৬

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৭

আমাকে আধমরা করে ফেলে। একপর্যায়ে যখন আমার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে, তখন তারা আমাকে নিয়ে একটা সেলে আবদ্ধ করে রাখে। লাগাতার কয়েক দিন আমার উপর এরূপ টর্চার চলতে থাকে।

এ সময়ে আমার ভগ্নিপতি জানতে পারেন, কাসেম খাঁ টাকার বিনিময়ে বন্দীমুক্তির ব্যবস্থা করেন। সেনাবাহিনী ও অন্যান্য ফোর্সের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে। আমার ভগ্নিপতি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং আমার মুক্তির জন্য ১০ হাজার টাকা তার হাতে তুলে দেন। কিন্তু তাতে কাজ হলো না। কাসেম খাঁর সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করা হলো। কিন্তু তিনি আমাকে মুক্ত করতেও পারলেন না, টাকাও ফেরত দিতে ব্যর্থ হলেন। অবশেষে নজির সিদ্দিকীর মাধ্যমে ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে মুক্ত করা হয়।

১৯৯২ সালের ২৪ মার্চ ঘটনাক্রমে আমি আমার বোনের বাড়িতে ছিলাম। রাতে বিএসএফ ওখানে হানা দেয়। বোনের আন্ডারগ্রাউন্ড এক্সপোজ হয়ে যায়। অন্যদের সঙ্গে আমিও ধরা পড়ে যাই। আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে বের করে করিডোরে নিয়ে বিএসএফ সর্বপ্রথম আমার মুখমণ্ডল কাপড় দ্বারা বেঁধে ফেলে। জুতার ফিতা খুলে তা দ্বারা আমাকে পিঠমোড়া করে বাঁধে। তারপর বন্দুকের বাঁট ও ডান্ডা দ্বারা আমাকে প্রহার করে। তারা এক-এক করে আমাদের প্রত্যেককে বুট দ্বারা পিষ্ট করে। আমাদের হাড়গোড় ভেঙ্গে দেয়। সবাইকে রক্তাক্ত করে ফেলে। অবশেষে হেডকোয়ার্টার থেকে আরেকটি কোম্পানি ডেকে এনে আমাদেরকে টুটু গ্রাউন্ডের বিএসএফ ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

এখানে সর্বপ্রথম জাবেদ আহমাদ শালাহকে জ্ঞিাসাবাদ করা হয়। তারপর মোহাম্মদ সিদ্দিক সুফীকে। সিদ্দিক সুফীর পর সাব্বীর আহমাদকে। তারপর তলব পড়ে আমার। একজন আমার বাহু দরে আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। তারা আমাদের এক-একজনকে এক একটি গ্রুপের হাতে তুলে দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও টর্চার চালায়। বিষয়টি আমি এভাবে বুঝতে পারলাম যে, আমার কানে কখনও ফিরোজের, কখনও মকবুল জানের, কখনও মুদ্দাসসির ও মাসাররাতের আবার কখনও আব্বাজানের চিৎকারের আওয়াজ আসছিল। রাতভর আমাদের উপর চরম নির্যাতন চালানো হয়। মওসুমটা ছিল শীতের। বরফপাতও হচ্ছিল। আমাদেরকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে সিমেন্টের মেঝেয় শুইয়ে দিয়ে মারপিট করা হয়। আরও অস্ত্রের ডিপো এবং অন্যান্য মুজাহিদদের ঠিকানা বলার জন্য আমাদের উপর এই নির্যাতন চালানো হয়।

পরদিন আমাকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। অনুমান করলাম, আব্বাজান এই কক্ষে আছেন। তাকে নানা প্রশ্ন করা হচ্ছিল আর তিনি উত্তর দিচ্ছিলেন। আমার চোখ-মুখ ঢাকা। হাত পিঠমোড়া করে বাঁধা। আব্বাজানের কণ্ঠ চিনতে পেরে আমি শুধু এতটুকু বললাম, আব্বাজান আমি শাকীল, আপনার পাশে দাঁড়িয়ে আছি।

কথাটা আমার মুখ থেকে বের হওয়ামাত্র আমার ঘাড়ে প্রচণ্ড এক লাথি এসে পতিত হয়। আমি আহ! বলে চিৎকার করে উঠি। আমার আহ চিৎকার আব্বাজানের কলিজা বিদীর্ণ করে দেয়। তিনি আপত্তি উত্থাপন করে বললেন, তোমরা আমাদের এমনভাবে নির্যাতন করছে কেন? অমনি ঠক করে একটি শব্দ হয়। সঙ্গে-সঙ্গে আব্বাজানের মুখ থেকে আহ! বেরিয়ে আসে। তারপরই তিনি কালেমা শাহাদাত পাঠ করেন। আমি অনুমান করলাম, তার মাথায় বন্দুকের বাঁট দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। কক্ষে কিছু সময় নীরবতা বিরাজ করে। তারপর কারো ভেতরে প্রবেশ করার শব্দ শুনতে পেলাম। ভেতরে ঢুকেই তিনি জিজ্ঞেস কররেন, এখানে কী হচ্ছে? জবাব হলো, এ লোকটি অজ্ঞান হয়ে গেছে। আগন্তুক একজন অফিসার। তিনি আব্বাজানের শিরা দেখে বললেন, লোকটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। একে অন্যত্র নিয়ে যাও। আব্বাজানকে এই কক্ষ থেকে বের করে অন্য কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়।

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹

আমাকেও এই কক্ষ থেকে বের করে নেওয়া হয়। রাখা হলো একটা ঘোড়ার আস্তাবলে। আমার ভগ্নিপতি এবং ভাগিনা মুদ্দাসসিরকেও এখানে নিয়ে আসা হলো। আমাদের সকলের শরীর বিবস্ত্র। জায়গাটা অত্যন্ত দুর্গন্ধ। প্রচণ্ড শীতে ঠকঠক করে কাঁপছি আমরা সবাই। তার উপর জখমের যন্ত্রণা তো আছেই। লাগাতার আট দিন পর্যন্ত অত্যাচার বলতে থাকে।

টর্চারের সময় আমার উপর এই বলে বেশি নির্যাতন করা হয় যে, প্রথম গ্রেফতারের সময় তুই এই আস্তানা সম্পর্কে বলনি না কেন? তার অর্থ তুই আমাদের থেকে তথ্য গোপন করেছিস। এখন এরূপ আরও একটি আস্তানার কথা বলে দে, আমরা তোকে ছেড়ে দেব। অন্যথায় তোর পরিণতিও তোর বাপের মতোই হবে।

আমি অজ্ঞাত প্রকাশ করি এবং কোনো মিলিট্যান্ট সম্পর্কে আমার জানা-শোনা আছে বলে অস্বীকার করি। এবার আমাকে কোয়ার্টার গার্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একটি একটি কক্ষ। মেঝেতে বালি বিছানো।

বালিগুলো পানিতে ভিজে আছে। ছাদ গলিয়ে পানি পড়ছে। বরফপাতের কারণে কক্ষটি একটি বরফডিপোতে পরিণত হয়ে আছে।

এখানে আমার সঙ্গে আমার ভগ্নিপতি মকবুল জান, তার পুত্র মুদ্দাসরি, আলতাফ খান, ফিরোজ বেগকে আঠারো দিন রাখা হয়। তারপর আমাদের পাপাটু পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

পাপাটুতেও আমাদেরকে নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আমাদের চোখ থেকে শুধু খাওয়ার সময় পট্টি খুলে দেওয়া হতো। খাওয়া শেষ হওয়ামাত্র আবার পট্টি বেঁধে দেওয়া হতো। লাগাতার চোখ বাঁধা থাকার কারণে চোখের জ্যোতি কমে যায়। এখানে কয়েক দিন রাখার পর আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়। রিলিজ করার সময় এক অফিসার আমাকে বলল, দুঃখের বিষয়, তোমার পিতা হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেছেন।

আমি বললাম, আপনার কথা সত্য নয়। আব্বাজানকে আমার সম্মুখে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। বন্দুকের বাঁট দ্বারা তার মাথায় আগাত করা হয়েছিল। আপনি কী করে বললেন, তিনি হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেছেন?

অফিসার আমার কথার কোনো জবাব দিলেন না। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা আলুচাবাগ এসে পৌঁছি। এখানে এসেও পিতা ইউসুফ বেগের শাহাদাতের কথা জানতে পারি।

"বেলাল আহমাদ বেগ"

আমি তেমন শিক্ষিত নই। লেখাপড়া বেশি করতে পারিনি। তবে আল্লাহ বুদ্ধি-বিবেক বেশ দিয়েছেন। আল্লাহ আমাকে দ্বীনের খাতিরে কুফরের বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার এবং স্বদেশের আযাদির জন্য লড়াই করার তাওফীক দিয়েছেন বলে আমি বেশ গর্বিত। আসল-নকল ও সত্য- মিথ্যা পার্থক্য করার জ্ঞান আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।

আমি বরাবরই প্রচলিত রাজনীতি থেকে দূরে অবস্থান করেছি। আমার বিশ্বাস, এই রাজনীতি দ্বারা জাতির কল্যাণ সাধন ও দ্বীন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তবে মুসলিম মুত্তাহাদা মাহাযের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণাকে আমি এজন্য স্বাগত জানিয়েছি যে, দলটির নির্বাচনি ইশতেহার আমার মনঃপুত হয়েছিল। তাই ১৯৮৭ সালে নির্বাচনে অন্যান্য কর্মীদের সঙ্গে আমিও নির্বাচনি তৎপরতায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করি। নির্বাচনের পর যখন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ধড়পাকড় শুরু হয়ে যায়, তখন এক পর্যায়ে আমাকেও নিরাপত্তা হেফাযতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং শেরগড়ি থানায় আটক রাখা হয়।

এখানে আমার সঙ্গে শুধ নির্মম আচরণই নয়, বরং চরম অবমাননাকর আচরণও করা হয়। তখন আমার সঙ্গে মোহাম্মাদ রমযান রাথের, হাবীবুল্লাহ খান, তার পুত্র ও মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বাঙ্গরোসহ আরও কতিপয় যুবক আটক ছিল। আমরা একত্রিত বসে পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ- আলোচনা জুড়ে দিলাম।

একজন বলল, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। জবাবে আমি বললাম, সোজা আঙ্গুলে ঘি কখনওই ওঠে না। ঘি তুলতে হলে আঙ্গুল বাঁকা করতেই হবে। আমরা কি পারি না আঙ্গুল বাঁকা করতে?

আমরা কি এমন কোনো পদক্ষেপ হাতে নিতে পারি না, যা দ্বারা ভারতের কবল থেকে রক্ষা পেতে পারি? ওরা তো আমাদের ভোটের অধিকারও ছিনিয়ে নিয়েছে। ঘটনাক্রমে থানার অন্যান্য কক্ষের যুবকরাও একই ধারার চিন্তা করছিল। ফলে বের হয়েই আমরা পরস্পর মতবিনিময় করে ঐকমত্যে পৌছতে সক্ষম হলাম।

আমি ছিলাম সংসারী মানুষ। সংসার পরিচালনায় পিতার সহযোগিতার জন্য উপার্জনের চিন্তাই ছিল আমার বড় কাজ। সে জন্য বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে বিষয়টি নিয়ে বেশি দূর আর এগুতে পরিনি। কিন্তু একপর্যায়ে যখন যুবকরা সীমান্তের ওপারে যাওয়া-আসা শুরু করে, তখন আমি আমার বাল্যবন্ধু হেলাল আহমাদ বেগের সঙ্গে যোগাযোগ করি। হেলাল বেগ জিহাদের জন্য অবিবাহিত যুবকদের বিশেষভাবে প্রস্তুত করছিল। সংসারীদের সহজে নিতে চাচ্ছিলেন না। তথাপি আমিসহ আরও কয়েকজনের পীড়িাপীড়িতে আমাদের ওপারে পাঠাতে সম্মত হয়।

আমরা রওনা হয়ে যাই। জাবেদ আহমাদ শালাহ সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আমাদেরকে গাইডের হাতে তুলে দিয়ে ফিরে যান। ছয় সপ্তাহ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে আমরা সশস্ত্র অবস্থায় কাশ্মিরে ফিরে আসি এবং কাশ্মিরের আযাদি মিশন নিয়ে কাজ শুরু করে দেই। আমাদের লক্ষ্য, ইসলামের জন্য আযাদি অর্জন করা। এই টার্গেটের উপরই আমাদের কার্যক্রম চলতে থাকে।

১৯৯০ সালের মে মাসে হঠাৎ একদিন আমি গ্রেফতার হয়ে যাই। ভারতীয় পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে পাপাভন পাঠিয়ে দেয়। এখানে আমাকে রাখা হয় মাত্র দুঘণ্টা। কিন্তু এই দু-ঘণ্টায় আমার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা বলে বোঝাবার মতো নয়। তারপর আমাকে এক-এক সময় এক-এক স্থানে রাখা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালানো হয়।

১৯৯২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর আমাকে ভয়ানক মিলিট্যান্টের তালিকাভুক্ত করে মধ্যপ্রদেশের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই জেলে ১৪ মাস পর্যন্ত আমাকে ডেথ সেলে রাখা হয়। তারপর নাহিদা সোজের অপহরণের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার পরিবর্তে আমাকে হেরানগর জেলে স্থানান্তর করা হয়। এই হেরানগর জেলে আমাকে ছয় মাস কাটাতে হয়।

তারপর দোরায়ে সোয়ামীর ডিমান্ডে আমাকে শ্রীনগর স্থানান্তর করা হয়। শ্রীনগর সেন্ট্রাল জেলে কিছুদিন রাখার পর তাহের মীরের সঙ্গে চোখে পট্টি বেঁধে আমাকে হরিনওয়াস পৌছিয়ে দেওয়া হয়। হরিনওয়াস নতুন করে আমার ইন্টারোগেশন করা হয়। চলে নানা রকম নির্যাতন। লাগাতার কদিনের জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনে আমি চরমভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। অসুস্থ অবস্থায় কাটাই ষোলো দিন। এখানে আমাকে আড়াই মাস রাখা হয়। তারপর অন্যান্য সাথীদের সঙ্গে আমাকে আবার শ্রীনগর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

বামনার আন্ডারগ্রাউণ্ড হানা দিয়ে সমস্ত অস্ত্র, উপস্থিত সকল মুজাহিদ ও ঘরের সব পুরুষকে নিয়ে যাওয়ার পর এখন ঘরে আছি আমি আর আমার কন্যা সায়েমা। আমরা মা-মেয়ে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের একটি কোম্পানী দ্বারা অবরুদ্ধ। আমাকে তারা ঘরের একস্থানে এমনভাবে বসিয়ে রেখেছে যে, এখান থেকে একচুলও নড়াচড়া করার অনুমতি নেই। আগের কোম্পানী আমার মাথার ওড়না কেড়ে নিয়েছিল। আমি অন্য কক্ষে গিয়ে মাথা ঢাকার জন্য কোনো কাপড় আনতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু অনুমতি পেলাম না।

আমি আমার অবুঝ কন্যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে গ্রেফতারকৃত মুজাহিদ ও পরিবারের সদস্যদের কথা ভাবছি যে, হায়েনারা যেন তাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করছে। এমন সময় কোম্পানীর এক-একজন সিপাহী ও অফিসার আমার নিকট এসে আমাকে দেখে-দেখে চলে যেতে লাগল- যেন আমি প্রদর্শনের জন্য রাখা কোনো আজব প্রাণী। আমাকে দেখার জন্য রীতিমতো লাইন লেগে যায়। অবস্থা দেখে আমি দু-হাটুর মাঝে মুখ লুকিয়ে ফেলি। তারা অকথ্য ভাষায় আমাকে যা-তা বলতে শুরু করে। কেউ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছে, কেউ চিবুক ধরে মাথাটা উপরে তুলে মুখের দিকে তাকিয়ে বলছে আহ! কী রূপ রে! একেকজন

একেক কথা বলছে- 'দেখ, কেমন নির্দোষ সেজে বসে আছে, যেন কিছুই বোঝে না। অথচ কত ভয়ংকর নারী।' 'আরে এ তো নারী নয়- নাগিনী।' 'কে জানে ডাইনীটা তার মিলিট্যান্টদের হাতে আমাদের কত জওয়ানকে হত্যা করিয়েছে।' 'মন চায় মহিলার মুখ খাবলে দেই।' 'অনুমতি পেলে আমি ওর ওপর আমার সমস্ত মেগজিন খালি করে ফেলতাম।' ইত্যাদি আরো অনেক রকম অসহনীয় মন্তব্য।

বিএসএফ-এর জওয়ানরা রাতভর আমার গায়ে এভাবে বিষাক্ত শর বর্ষণ করতে থাকে। তারা আমার ব্যক্তিত্বকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে। আমি ধৈর্যের সাথে মনে-মনে আল্লাহর কালাম পাঠ করতে থাকি।

আমি মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকি, 'হে আল্লাহ! আপনি আমার সাহস অটুট রাখুন এবং এই কঠিন পরীক্ষায় আমাকে উত্তীর্ণ করুন। আমাকে ও আমার মাছুম কন্যাকে হেফাযত করুন।' আমি আল্লাহর নিকট আরজ পেশ করি, এ মুহূর্তে আমার হেফাযতের জন্য কোনো ফেরেশতা প্রেরণ করুন।

আমরা গতকাল সন্ধ্যায় শুধু পানি পান করে ইফতার করেছিলাম। আর এখন খাবার প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও শুধু এক গ্লাস পানি পান করে রোযার নিয়ত করলাম।

মসজিদে ফজরের আযান হলো। আমরা নামাযের জন্য অজু করলাম। নামাজ আদায় করার পর সায়েমা বলল, মা, আমি বাথরুমে যাব। আমি তাকে পুরোপুরি ফর্সা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললাম। মেয়েটা সকাল আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে এবার বলল, মা আর অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তুমি আমাকে বাথরুমে নিয়ে চলো।

মেয়ের অবস্থা দেখে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। ঘরের সর্বত্র সিপাহীরা গিজগিজ করছে। তাদের বর্তমানে আমি মেয়েকে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া সমীচীন মনে করলাম না। কিন্তু না গিয়েও যে উপায় নেই।

হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল। আমি এক সিপাহীকে বললাম, আমি তোমাদের ইনচার্জ অফিসারের সাথে দেখা করতে চাই। সিপাহী ধারণা করে, আমি অফিসারের নিকট তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পেশ করব। সে আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেয় যে, তুমি অফিসারের সঙ্গে কেন সাক্ষাৎ করবে? এ সময় অপর এক সিপহী বাইরে গিয়ে অফিসারকে নিয়ে আসে। এসেই অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার?

আমি বললাম, আমার মেয়ে বাথরুমে যেতে চায়, কিন্তু তোমার এই সিপাহীরা...। অফিসার বলল, ঠিক আছে, নিয়ে যাও। অফিসার সব সিপাহীকে বাইরে বের করে দিয়ে আমাকে বলে দেয়, ভিতর থেকে বাথরুমের দরজা বন্ধ করবে না।

আমি সায়েমাকে বাথরুমে নিয়ে গেলাম। ওকে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে বাইবে দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে থাকি। মনে বড় ভয় লাগছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে কোনো অঘটন ঘটেনি মেয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে সিপাহীদের অনুপস্থিতিতে আমি ভাবলাম, এই সুযোগে বেডরুমে গিয়ে মাথা ঢাকার জন্য কিছু নিয়ে আসি। বেডরুমে গিয়ে দেখি, আমার স্বর্ণালংকারের ডিব্বাটা শূন্য নীচে পড়ে আছে। ওয়ার্ডরব-এর দরজা খোলা। একটা লেদার ব্যাগে টাকা ছিল, সেটাও খালি পড়ে আছে।

আমি পাগলের মতো সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে অন্য কক্ষে ঢুকি। সেখান থেকে আরেক কক্ষে। কিন্তু ঘর আমার শূন্য। কিছুই নেই। বিছানাপত্র আর কাপড়-চোপড় ছাড়া সব উধাও। মটর সাইকেল, বাইসাইকেলও নেই। কাপড় ধোঁওয়ার মেশিন এবং ফ্রিজও লাপাত্তা। নজিরবিহীন এক ডাকাতির ঘটনা ঘটে গেছে আমার ঘরে।

লুটপাটের এই চিত্র দেখে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। আমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, ওরে সন্ত্রাসীরা, দস্যুরা, বদমাশরা, তোরা আমার সবকিছু লুটে নিয়েছিস! তোরা যদি মুজাহিদ ধরতে আর অস্ত্র নিতেই এসে থাকিস, তা তো তোরা পেয়েছিস। কিন্তু আমার ঘরের সব জিনিসপত্র, সোনা-দানা, টাকা-পয়সা লুট করলি কেন? তোরা আমাকে ভিখারীতে পরিণত করেছিস। তোরা আমাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আরোপ করেছিস। শোন সন্ত্রাসীরা! শোন দস্যুরা! আমরা নিজেদের অধিকার-ই দাবি করছি। তোরা যদি তোদের ওয়াদা পূরণ করতে, তাহলে আমাদের ভারতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে হতো না। অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার জন্য তোরাই আমাদের বাধ্য করেছিস। নিজের স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র ধারণ করা অপরাধ নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করছি। এখানকার সব মানুষ নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু সবাই স্বাধীনতা চায়। আযাদি আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য। এই অধিকারকে আমরা শত্রুর হাতে তুলে রাখতে পারি না।

আমি আরও কত কী বললাম আল্লাহ জানেন। এমন সময় এক অফিসার আমার কথা কেটে বলে উঠল, তুমি খুব বেশী কথা বলছ। তোমার ঘর থেকে এতগুলো অস্ত্র উদ্ধার করা হলো, বলো তো এসব অস্ত্র দ্বারা কতজন জওয়ানকে হত্যা করেছ? আরও কতজন হত্যা করতে?

আমি সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠলাম, 'আর তোমাদের কাছে এই যে অস্ত্র আছে, এগুলো দ্বারা আমাদের শুধু সশস্ত্র যুবকরাই নয় নিরস্ত্র বৃদ্ধ, শিশু এবং অবলা নারীরা প্রতিদিন-ই তো খুন হচ্ছে। আমাদের নিরপরাধ লোকদের রক্তে তোমাদের হাত রঞ্জিত হয়ে আছে। তোমরা পাপিষ্ঠ, লুটেরা, ঘাতক। আসল সন্ত্রাসী তো তোমরাই।'

আমার চিৎকার ও বক্তব্য শুনে চারপাশে অনেক সিপাহী ও কয়েকজন অফিসার জড়ো হয়ে যায়। এক সিপাহী আমাকে প্রহার করার জন্য হাত তুলে সামনে এগিয়ে আসে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বড় অফিসার এগিয়ে এসে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সর, ওকে বলতে দাও। কী বলছে ও?

এমন সময়ে অপর এক অফিসার আমার নিকট এল। সে অন্যান্য

অফিসার ও সিপাহীদের সরিয়ে দিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আপনি

পর্ব-৯ এখানে.........




Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

সমাজে সততা ও ইমানের গুরুত্ব  লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ
Chat with us on WhatsApp