Header Ads Widget

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-১



(কাশ্মীরের অসীম সাহসিনী নারী মুক্তিযোদ্ধা ফরিদা আপার ঈমানদীপ্ত কাহিনী।) পর্ব- ১
 

পরিচিতি

ফরীদা আপা। কাশ্মিরের শহীদ মোহাম্মদ ইউসুফ বেগ-এর জ্যেষ্ঠা কন্যা। মোহাম্মদ ইউসুফ বেগ শ্রীনগরের আলুচাবাগের এক গরিব পরিবারের সন্তান। শহীদ ইউসুফ বেগ-এর বড় ভাই হাবীবুল্লাহ বেগ ভারত বিভক্তির পর-পর কাশ্মির ত্যাগ করে পাকিস্তান চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। রাওয়ালপিণ্ডির স্যাটেলাইট টাউনে তার বাড়ি। পঞ্চাশ বছরে বছর বিশেক আগে ইউসুফ বেগ মাত্র একবার বড় ভাইযের সঙ্গে দেখা করতে পাকিস্তান গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন মুহূর্তে জালেম ভারতীয় বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে তাদের নিরাপত্তা হেফাযতে নির্মমভাবে হত্যা করে।

শহীদ মোহাম্মদ ইউসুফ বেগ-এর প্রায় পুরোটা জীবনই কেটেছে নেহায়েত দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে। বিয়ে করেছিলেন অতি অল্প বয়সে। শ্রীনগরের বার্বার শাহ এলাকায় রজব ভাটের কন্যা সাঈদা বেগম তার স্ত্রী। ইউসুফ বেগ ও সাঈদা বেগমের দাম্পত্যজীবন অতি কষ্ট ও সংকটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আর্থিক সংকট তাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গের রূপ ধারণ করে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ইউসুফ বেগ যা উপার্জন করতেন, তা দিয়ে কোনো রকমে চারটা ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হতো মাত্র।

শহীদ মোহাম্মদ ইউসুফ বেগ লেখাপড়া জানতেন না। তার বংশে না শিক্ষার কোনো পরিবেশ ছিল, না কারও শিক্ষিত হওয়ার আগ্রহ ছিল। 'মজুরের ছেলে মজুরই হবে' এ রীতিরই বাস্তবায়ন ছিল তাঁর বংশে। পিতা সন্তানদের লেখাপড়া শেখাননি; বরং অল্প বয়সেই উপার্জনের কাজে জড়িয়ে দিয়ে যান।

শহীদ মোহাম্মদ ইউসুফ বেগ অত্যন্ত কোমলস্বভাব, ধৈর্যশীল ও লাজুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এতই ভদ্র ছিলেন যে, জীবনে কখনও কারও সঙ্গে মারপিট তো দূরে থাকুক, বাগ্বিতণ্ডাও করেননি। গোটা জীবন কেটেছে তাঁর কৌলিন্য ও সরলতার মধ্য দিয়ে। কোনো কাজে কখনও ক্লান্তি অনুভব করেননি। বড় পরিশ্রমী ও স্বল্পেতুষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। দাম্পত্য জীবনে তিনি তিন পুত্র ও দুই কন্যা সন্তানের জনক।

বিয়ের তিন বছর পর প্রথমা কন্যার জন্ম হয়। মেয়েটির নাম রাখেন ফরীদা। ফরীদা দেখতে ঠিক মায়ের মতো। প্রথম সন্তান হিসেবে ফরীদা পরম আদর-যত্নে লালিতা-পালিত হতে থাকে। রূপ-সৌন্দর্য ও শরীর- স্বাস্থ্যের কারণে শুধু ইউসুফ বেগ-এর পরিবারেই নয় এলাকার সকলেরই আদরিণী। ফরীদা গোটা

ফরীদার বয়স যখন আড়াই বছর, তখন ইউসুফ বেগ-এর ঘরে আগমন ঘটে ফুটফুটে এক পুত্র সন্তানের। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় সকলের মনে। ইউসুফ বেগ পুত্রের নাম রাখেন শাকিল আহমাদ। শাকিল আহমাদের বয়স যখন আড়াই বছর, তখন জন্মলাভ করে আরেকটি কন্যাসন্তান। নাম রাখেন ডেইজি। ফরীদার মতো ডেইজিও ঠিক মায়ের অনুরূপ দুই বোন দেখতে ঠিক একই রকম। 

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹


ডেইজির বয়স যখন প্রায় তিন বছর, তখন জন্ম হয় আরও একটি পুত্রসন্তান। নাম রাখা হয় বেলাল আহমাদ। বেলালের তিন বছর বয়সে ইউসুফ বেগ বাবা হন তৃতীয় পুত্রসন্তানের। নাম রাখেন ফিরোজ। যে- বছর ফিরোজের জন্ম হয়, ফরিদার বয়স তখন দশ বছর।

ইউসুফ বেগ যে-ভূখণ্ডের বাসিন্দা, সেখানে মেয়েদের লেখাপড়া করে শিক্ষিত হওয়ার প্রচলন নেই। তারা কন্যাসন্তানদের স্কুলে পাঠাবার কথা কল্পনাও করে না। তাই ইউসুফ বেগ-এর দুই কন্যা ফরীদা ও ডেইজি অশিক্ষিতই রয়ে যায়। তবে পুত্রের মধ্যে বেলাল ও ফিরোজ প্রাথমিক কয়েক শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করতে সক্ষম হয়। সংসারের ঘানি টানতে ইউসুফ বেগ-এর এখন অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন। তাই বয়সে পরিণত হওয়ার আগেই তিনি একে-একে সবকটি পুত্রকে উপার্জনের জন্য কাজে জুড়িয়ে দেন।

ইউসুফ বেগ-এর ঘরে পর-পর জন্ম নিল পাঁচটি সন্তান। বিশেষত দুটি রূপসী কন্যার সঙ্গে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হাট্টা-কাট্টা সুশ্রী তিনটি পুত্রসন্তানের জন্মে তার ঘরে চোখ লেগে গেছে যেন মানুষের। সবকটি সন্তানের অসুখ-বিসুখ লেগেই থাকছে এখন। পিতা দিনভর মজুরি খেটে যা উপার্জন করেন, পেটের আগুন নেভাতেই তা ব্যয় হয়ে যায়। তার উপর একের-পর-এক সন্তানদের রোগ-ব্যাধি ইউসুফ বেগকে সীমাহীন সংকটে ফেলে দেয়। ইউসুফ বেগ-এর সমস্যা ও দুশ্চিন্তা বহুগুণ বেড়ে যায়।

ইউসুফ বেগ রুটি-রুজির সন্ধানে সেই কাকডাকা ভোরে বের হন। ফেরেন সন্ধ্যার পর। রোগাক্রান্ত সন্তানদের সেবা-চিকিৎসার পুরো দায়িত্ব চাপে স্ত্রী সাঈদার উপর। সন্তানদের রোগ-ব্যাধির বাস্তব চিত্র হলো এই অধিকাংশ সময় এমন হয়েছে যে, হাসপাতালের এক ওয়ার্ডে এককন্যা চিকিৎসাধীন, তো আরেক ওয়ার্ডে একপুত্র চিকিৎসাধীন। কখনও এক বেডে এক সন্তান, পাশের বেডে অন্য সন্তান আর দুজনে মধ্যখানে মা সাঈদার দৌড়-ঝাঁপ।

১৯৭১ সাল। কাশ্মিরে তখন খাজা গোলাম মোহাম্মাদ সাদেক-এর শাসন। তখন পারশিমুরী নাম্মী এক শিক্ষিতা হিন্দু তরুণী ইসলাম গ্রহণ করে এক মুসলিম যুবকের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। মেয়েটি নিজের নাম ধারণ করে পারভিন। এর প্রতিক্রিয়া হয় ভয়াবহ। কাশ্মিরের গোটা হিন্দুসমাজ, বিশেষ করে পণ্ডিতমহল তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার রূপ দিয়ে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। হিন্দু- মুসলিম সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।

শান্তি রক্ষায় প্রশাসন কয়েক দিনের জন্য কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয়। ইউসুফ বেগ-এর দুই সন্তান শাকিল ও ডেইজি তখন হাসপাতালে। কারফিউ সাত দিন পর্যন্ত বহাল থাকে। হাসপাতালের রোগীরা পড়ে যায় মহাসংকটে। শাকিল ও ডেউজির মা কারফিউ উঠে যাওয়ার সাথে-সাথে সন্তানদের নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়ে আসেন।


ফরীদার মা বলেন- "আমি যখন মা ছিলাম, তখন আমার জীবনটা কেটেছে সন্তানদের সঙ্গে হাসপাতালে। আমার দৌড় সীমাবদ্ধ ছিল ডাক্তারের চেম্বার আর ক্লিনিক-হাসপাতাল পর্যন্ত। আর যখন আমি দাদি হই, তখন আমার হাঁটার মোড় ফিরে যায় দেশের বিভিন্ন জেলখানার দিকে।" 

ফরিদার মা সাঈদার দুই পুত্র, দুই জামাতা আর দুই নাতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জেলে কারাভোগ করে। তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও খবরা খবর নিতে তার এক পা থাকত যদি জম্মু, তো অপর পা থাকত দিল্লি। আজ থাকতেন যদি জুধপুর, তো কাল থাকতেন মধ্যপ্রদেশ। এভাবে তার জীবন যে-পরিমাণ দুঃখ-কষ্ট ও জুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে, তার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। স্বামী ইউসুফ বেগকে নিরাপত্তা হেফাযতে হত্যা করে ফেলে ভারতীয় হায়েনারা!

মোহাম্মাদ ইউসুফ বেগ ও সাঈদা বেগমের দাম্পত্যজীবনের প্রথম ফসল বড় কন্যা ফরীদা কাশ্মিরি মুসলমান ও মুজাহিদদের কাছে যিনি 'ফরীদা আপা' নামে পরিচিত  একজন জানবাজ, নির্ভীক ও দুঃসাহসী নারী। ফরীদা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, সমঝদার ও অভিজ্ঞ মহিলা। তার বুঝ- বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা এতই প্রখর যে, শুধু শিক্ষিতা মহিলারা-ই নয়, বিজ্ঞ পুরুষরাও তার থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকেন। কোনো মূল্যবান বস্তু; যেমন পোশাক, অলংকার ইত্যাদি কিনতে হলে ফরীদার কাছে এসে ধরনা দেয় যে কেউ। কাজ-কারবার ও লেনদেনে তার মতামত না নিলে চূড়ান্তে পৌঁছতে পারে না যেন কেউ। বিবাদ-মীমাংসায় ফরীদার শরণাপন্ন হন বড়-বড় বিচক্ষণ পুরুষরাও। অনুপম এক ভাগ্যবতী ও গুণবতী নারী 'ফরীদা আপা'।

ফরীদা আপার শৈশব কেটেছে নেহায়েত দারিদ্র ও ক্লেশের মধ্য দিয়ে যেমনটা আগেই বলেছি। ষোলো বছর বয়সে শ্রীনগরের বারাবার শাহ এলাকার মোহাম্মাদ মকবুল জান নামক এক মিস্ত্রী যুবকের সঙ্গে ফরীদার বিয়ে হয়ে যায়।

ফরীদা অত্যন্ত ভাগ্যবতী মহিলা। মকবুল জান যখন ফরীদাকে বিয়ে করে ঘরে তোলে, তখন সে এক কারখানায় পাঁচশো টাকার বেতনে চাকরি করে। কিন্তু ভাগ্যবতী ফরীদা শ্বশুরালয়ে প্রবেশ করার পর অল্প ক-দিনের ব্যবধানেই মকবুল জান চাকরি ত্যাগ করে পার্টনারশীপে একটি কারখানা চালু করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বিয়ের বয়স এক বছর পূরণ না হতেই ফরীদা মারাত্মক এক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। 

চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু নিরাময়ের পরিবর্তে অসুখ দিন-দিন বাড়তেই থাকে। অবশেষে একজন বিশেষজ্ঞ মহিলা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডাক্তার ফরীদার শাশুড়িকে জানান, আপনার পুত্রবধূ বন্ধ্যা। তার সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এ রিপোর্টে ফরীদার দাম্পত্যজীবনে সাত সাগরের প্রচণ্ড ঝড় উঠে যায়।

যে-সংসারে এতদিন ফরীদার আদর-সোহাগের অভাব ছিল না, সেই সংসারে ফরীদা এখন উপেক্ষিতা ও অপয়া। ঘটনা এতদূর গড়াল যে, পিতামাতার পক্ষ থেকে মকবুল জানের উপর ফরীদাকে তালাক দেওয়ার প্রবল চাপ শুরু হয়ে গেল। দিন-দিন এই চাপ বাড়তে থাকল।

কিন্তু মকবুল জান ফরীদাকে তালাক দিতে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকৃতি জানায়। ফলে বিষয়টি পারিবারিক কলহের রূপ ধারণ করে। মকবুল জান ফরীদাকে নিয়ে পিতামাতার সংসার থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। ফরীদাকে নিয়ে তিনি সাময়িকের জন্য শ্বশুরালয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয়।

এ সময়ে মকবুল জান পার্টনারশীপ থেকে বেরিয়ে এসে কারখানা নিয়ে এককভাবে ব্যবসা শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই একটা বাড়িও ক্রয় করে ফেলে। এই বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে মকবুলজান চার বছর বাস করে।

'কাশ্মির মোটর ড্রাইভার্স এসোসিয়েশন' বাসস্ট্যান্ডের সন্নিকটে প্রতিষ্ঠিত মকবুল জানের নিজস্ব কারখানাটি এতই লাভজনক হয়ে উঠল যে, এ কারখানায় প্রস্তুত পণ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করতে সক্ষম হলো। দশ বছর পর মকবুল জান ক্রয় করা বাড়িটি বিক্রি করে নটিপুরায় দেলসুজ কলোনীতে কয়েক কাঠা জমি কিনে তার উপর একটি মনোরম বাড়ি নির্মাণ করেন।

বিক্রি করা বাড়িটিতে বসবাস করা অবস্থায় পিতামাতার সঙ্গে মকবুল জানের সমঝোতা হয়ে যায়। দেলসুজ কলোনীর বাড়টি নির্মিত হওয়ার পর থেকে পিতামাতা ও ভাই-বোনরা এ বাড়িতে আসা-যাওয়া শুরু করে এবং মাসের-পর-মাস বেড়াতে থাকে। মকবুল জান সকালে কারখানায় চলে যেত এবং ফিরে এসে সারা দিনের উপার্জন স্ত্রী ফরীদার হাতে তুলে দিত। দু-জনের দাম্পত্য ছিল অত্যন্ত সুখময়। তারা স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে শুধু ভালই বাসত না, একজন অপরজনের আনুগত্যও করত পুরোপুরি। 

মকবুল জান নিজেকে সংসারের একজন উপার্জনকারী ব্যক্তি অপেক্ষা বেশি ভাবত না। কারণ, সামাজিকতা, লেনদেন, সংসারের সার্বিক তত্ত্বাবধান প্রভৃতি ফরীদাই আঞ্জাম দিত। ফরীদা যেন এ ঘরের রানি। ফরীদার বুঝ-বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা সত্যিই অনুপম। যোগ্যতাবলে সে সংসারটাকে যেন জান্নাতে পরিণত করে ফেলেছিল।

ফরীদা অত্যন্ত হৃদয়বান মানুষ। অভাবীর অভাব পূরণে কার্পণ্য করত না কখনও। তাকে আল্লাহ সব গুণই দিয়েছেন, দেননি শুধু পুঁথিগত বিদ্যা। তার আছে একটি স্বচ্ছলতু সুখময় সংসার, আছে সোহাগী স্বামী। আছে ভদ্র, সহনশীল ও বিদ্যানুরাগী সন্তান। বন্ধ্যা ফরীদা তিন পুত্রটি সন্তান ও

না কখনও। তাকে আল্লাহ সব গুণই দিয়েছেন, দেননি শুধু পুঁথিগত বিদ্যা। তার আছে একটি স্বচ্ছলতু সুখময় সংসার, আছে সোহাগী স্বামী। আছে ভদ্র, সহনশীল ও বিদ্যানুরাগী সন্তান। বন্ধ্যা ফরীদা তিন পুত্র সন্তান ও এক কন্যা সন্তানের মা হলেন। বড় ছেলে মুদ্দাস্সিরের বয়স আঠারো বছর। ছোট ছেলে মুসাব্রাতের বয়স পনেরো বছর। কন্যা সায়েমার বয়স চৌদ্দ বছর।

কাশ্মিরের আযাদি আন্দোলনের জন্য নিবেদিতা ও চরম নির্যাতিতা এক মহিলার নাম ফরীদা। জিহাদে-কাশ্মিরের এক বীর মুজাহিদার নাম ফরীদা। এই জিহাদে কিভাবে তার অংশগ্রহণ, কিভাবে তার দুঃসাহসী জিহাদের নেতৃত্বদান ও নির্যাতন বরণ, আমরা তার বিস্তারিত কাহিনী শুনব তারই জবানিতে।


শুরুর কথা

১৯৮৭ সালে ভারতের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে 'মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায' প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায-এর লক্ষ্য ছিল, নির্বাচনে জয়লাভ করে আইনগতভাবে এ্যাসেম্বলির দখল হাতে নিয়ে ভারতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা। ফলে সর্বস্তরের নারী-পুরুষের সঙ্গে আমিও এই নির্বাচনি তৎপরতায় জড়িয়ে পড়ি। 

মুসলিম মুত্তাহাদা মাহাযকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে আমি কাশ্মিরি মহিলাদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করি। এই আন্দোলনে আমি মহিলাদের পাশাপাশি বেশ কজন প্রভাবশালী পুরুষকেও জড়িয়ে নিতে সক্ষম হই। 

আমি সর্বান্তকরণে নির্বাচনি কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। 'মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায' এমন একটি শক্তশালী রাজনৈতিক জোট, কাশ্মিরের প্রায় সবকটি বড় ইসলামি ও রাজনৈতিক দল যার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন কমিটির প্রধান মৌলভী মোহাম্মাদ ফারুক মুসলিম মুত্তাহাদা মাহাযকে সমর্থন দেওয়ার পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল কাশ্মিরের প্রায় সবকটি বড় ইসলামি ও রাজনৈতিক দল যার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন কমিটির প্রধান মৌলভী মোহাম্মাদ ফারুক মুসলিম মুত্তাহাদা মাহাযকে সমর্থন দেওয়ার পরিবর্তে প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যাশনাল কনফারেন্স ও কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। মৌলভী ফারুক ড. ফারুককে এই শর্তে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি নির্বাচনে মুসলিম মুত্তাহাদা মাহাযকে পরাজিত করে দেবেন।

মৌলভী ফারুক ও ড. ফারুকের যোগসাজশ কাশ্মিরি মুসলমানদের জন্য বিরাট এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। তারপরও কাশ্মিরি জনতা এই চ্যালেঞ্জ বরণ করে নেয়। প্রাদেশিক সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার যখন অনুভব করল, কাশ্মিরি জনতা মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায-এর পক্ষে, তখন অতি নীরবে এক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায-এর বিজয়কে পরাজয়ে পরিণত করে দেয়। ড. ফারুক মৌলভী ফারুককে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করে দেখান।

সেই ঘটনাটি ছিল আমাদের জন্য চরম বেদনাদায়ক, যা আমাদের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। আমরা মনে-প্রাণে বিদ্রোহী হয়ে উঠি। নির্বাচনের সময় মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায-এর বেশ কজন সক্রিয় যুবক কর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় এবং তাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায়।

'চুরি আবার সিনাজুরি'র এই পলিসি গ্রেফতারকৃত যুবকদের চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। পুলিশ লকাপে তারা একসঙ্গে থাকার সুযোগ পায়। এতে তারা পরস্পর মতবিনিময় ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পরিকল্পনা তৈরি করারও সুযোগ পায়। কিছুদিন পর জেল থেকে বেরিয়ে এসে তারা আরও কিছু যুবকের সঙ্গে যোগাযোগ ও মতবিনিময় করে ভারতের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক সশস্ত্র আন্দোলন পরিচালনার পরিকল্পনা ঠিক করে। কিন্তু তারা তাদের সকল পরিকল্পনা গোপন রাখে। পরিকল্পনা মোতাবেক যুবকদের একটি দল সীমান্তের ওপারে (আযাদ কাশ্মির) চলে যায়। প্রথম প্রথম কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হলেও তারা সাহসিকতার সাথে মিশন ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। অবশেষে তারা সফলতা লাভ করে। যুবকরা সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিয়ে অস্ত্র হাতে ফিরে আসতে শুরু করে। এক গ্রুপের পর আরেক গ্রুপ রওনা হয়ে যায়। যাওয়া-আসার এই ধারা অব্যাহত থাকে। তারা ধাপে- ধাপে তাদের গোপন পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শুরু করে। মুসলিম মুত্তাহাদা মাহাযকে নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়ার পর সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় ও নির্যাতন-নিপীড়নের অভিযানে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিল গুরুত্বপূর্ণ এক পুলিশ অফিসার আলী মোহাম্মাদ বাটালি। যুবনেতা এজাজ ডার-এর নেতৃত্বে চার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবক এই আলী মোহাম্মাদকে পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়। যুবকরা আলী মোহাম্মাদের বাড়িতে আক্রমণ চালায়। কিন্তু আলী মোহাম্মদ অল্পের জন্য রক্ষা পেয়ে যায়। সংঘর্ষে এজাজ ডার শাহাদতবরণ করেন। অন্যরা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে সক্ষম হয়। চার কাশ্মিরি যুবকের বন্দুক হাতে একজন পুলিশ অফিসারের বাসভবনে হামলার খবর আগুনের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবার মুখে বিস্ময়, কাশ্মিরি যুবকদের হাতে কী অস্ত্র আছে! কাশ্মিরি যুবকরা পুলিশ অফিসারের বাড়িতে ঢুকে হামলা করার সাহস রাখে!

বাস্তবিক সে-সময় একজন কাশ্মিরি যুবকের হাতে অস্ত্র থাকা এবং কারও বাড়িতে ঢুকে হামলা করা সাধারণ মানুষের চোখে অবিশ্বাস্য ও বিস্ময়করই ছিল। কারণ, তারা পূর্ব থেকে এর কিছুই জানত না। কিন্তু আমি এ খবরে মোটেও বিস্মিত হইনি। কেননা, আমি এ সম্পর্কে পূর্ব থেকেই অবহিত ছিলাম।

যাহোক, ঘটনার পর সরকার তৎপর হয়ে ওঠে। পুলিশ বেছে-বেছে সেই যুবকদের গ্রেফতার করতে শুরু করে, যারা বিগত নির্বাচনে মুসলিম মুত্তাহাদা মাহাযের পক্ষে কাজ করেছিল।

এই ধরপাকড়ের ধারাবাহিকতায় আলুচাবাগের হেলাল আহমাদ বেগ- এর বাড়িতে পুলিশ হানা দেয় এবং তাকে না পেয়ে তার পিতাকে বেদম প্রহার করে রেখে যায়। এলাকার মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামে হেলাল বেগের সম্পৃক্ততার কথা শুনে বিস্মিত হয়ে পড়ে। একটি হালকা-পাতলা সাধাসিধা লাজুক ও অল্পবয়স্ক নিরীহ ছেলেও কি দেশের সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সংগঠিত সশস্ত্র দলের সদস্য হতে পারে? বিষয়টি অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাসে আনতে পারেনি। কিন্তু যেহেতু পুলিশি নির্যাতনের ভয়ে হেলাল আত্মগোপন করেছিল, তাই তার প্রতি মানুষের সন্দেহ হওয়ারও কারণ ছিল। হেলাল বেগ-এর সশস্ত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিষয়টি ছিল আলুচাবাগের মানুষের জন্য গৌরবের বিষয়। আমিও একসময় আলুচাবাগের বাসিন্দা ছিলাম। সেখানে আমার বাপের বাড়ি। তাই আমিও নিজেকে এই গৌরবে অংশীদার বানিয়ে নিলাম। হেলাল বেগ-এর সঙ্গে শৈশবে আমার অনেক দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, আলাপ পরিচয় ছিল। কিন্তু বিয়ের পর এ পর্যন্ত আর তাকে দেখিনি। এখন তো লোকটা দেখতে কেমন, তাও আমার মনে নেই। এ ঘটনার পর আমার মনে তাকে এক নজর দেখার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায-এর নির্বাচনে পরাজিত হওয়া ছিল আমাদের জন্য বিরাট এক দুর্ঘটনা। সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণকারী যুবকরা ছিল বাস্তবিকই মুজাহিদ। সেই মুজাহিদ গ্রুপে আমাদের হেলাল আহমাদ বেগ-এর অংশগ্রহণে আমাদের মর্যাদা বেড়ে গিয়েছিল। তাই তাকে দেখার ও তার সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি ও আমার পরিবারের সবাই উদগ্রীব হয়ে পড়ি। কিন্তু হেলাল বেগ আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়ায় আর তার দেখা পাইনি।

হেলাল আহমাদ বেগ কোথায় লুকিয়ে ছিল, আমারও তা জানা ছিলনা। আমি শুধু এতটুকু জানতাম যে, একটি সংঘবদ্ধ যুবক দল উপত্যকা থেকে অন্য যুবকদের রিক্রুট করে সীমান্তের ওপারে প্রেরণ করেছে এবং তারা সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র হাতে ফিরে আসছে এবং নিয়ে আসা অস্ত্রগুলো প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করার জন্য সংরক্ষণ করে রাখছে। হেলাল বেগ আমার ছোট ভাই বেলাল কেও প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট করে নেয়। কিন্তু নানা কারণে তার ওপারে যাওয়ার প্রোগ্রাম বারবার স্থগিত হতে থাকে। একেক সময় একেকটা বাধা এসে সামনে দাঁড়ায়। অবশেষে ১৯৮৯ সালের শীতের মওসুমে বেলাল তার মিশনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

যাওয়ার আগে বেলাল আমাকে বলে গিয়েছিল- "ভারত আমাদের সঙ্গে যে-আচরণ করছে, তাতে মনে হয়, তারা আমাদেরকে মানুষ নয়, পশু ভাবছে। এটা মূলত আমাদেরই কাপুরুষতা ও হীনম্মন্যতার পরিচয়। দেহ থেকে এই কাপুরুষতা ও হীনম্মন্যতার কম্বল আমাদের ছুড়ে ফেলতে হবে এবং ভারতের নিকট থেকে আযাদি ছিনিয়ে আনার জন্য লড়াই করতে হবে। ভারতের গোলামি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আমাদের জিহাদ করতে হবে। যুবকদের মধ্যে জিহাদের অদম্য স্পৃহা সৃষ্টি করতে হবে এবং পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ভারতের উপর আঘাত হানতে হবে।"

তার এই কথাগুলো তখন আমার কিছু-কিছু বুঝে এলেও বিষয়টির পুরো চিত্র আমার চোখের সামনে ছিল না। সত্য বলতে কি, আমিও ভারতের প্রতি বিতৃষ্ণ ছিলাম। ভারতের বিরুদ্ধে আমার অন্তরে এমন একটি স্ফুলিঙ্গ বিদ্যমান ছিল, যা মাঝে-মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলে উঠত। পাকিস্তান অবস্থানকালে আমার এই স্ফুলিঙ্গ আরো অধিক প্রজ্বলিত হয়ে ওঠে।

আমার বিয়ের বয়স তখন বারো বছর। আমি তিন সন্তানের জননী। স্বামী মকবুল জান, পিতা ইউসুফ বেগ ও তিন সন্তানসহ আমি পাকিস্তানে চাচার বাড়িতে বেড়াতে যাই। আমার চাচা হাবীবুল্লাহ বেগ কাবায়েলি সংঘর্ষের পরপর কাশ্মির ত্যাগ করে পাকিস্তান গিয়ে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বেশ ক-বছর পর্যন্ত তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ ছিলনা। সত্য বলতে কি, আমি আমার চাচাজানকে চিনতামও না। কারণ, তিনি যখন কাশ্মির ত্যাগ করেন, তখন আমি একেবারে ছোট। যখন প্রথমবারের মতো তিনি পাকিস্তান থেকে কাশ্মির বেড়াতে আসেন, তখন

সবেমাত্র আমি যৌবনে পা দিয়েছি তিনি এক মাস আমাদের বাড়িতে ছিলেন। সে-সময়ে বয়সে কম হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার আব্বা-আম্মাকে বুঝিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়ে যান। তার সখ ছিল আমাকে বধূবেশে দেখবেন।

পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার সময় তিনি আমাদেরকে তার পাকিস্তানের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে যান। আমরা তার দাওযাত কবুল করেছিলাম। আমাদের সেই পাকিস্তান যাওয়ার সখ পূরণ হতে বারোটি বছর লেগে যায়।

পাকিস্তান গিয়ে আমরা যে কদিন ছিলাম, বেশ আদর আপ্যায়নের মধ্যেই ছিলাম। যেসব কাশ্মিরি পাকিস্তান গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে, সবাই আমাদের সাদর আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণের এই এমনভাবে চলতে থাকে যে, আমরা এক বাড়িতে লাঞ্চ করলে ডিনার করতাম আরেক বাড়িতে। এক বাড়িতে নাস্তা খেতাম তো চা পান করতাম অন্য বাড়িতে।

সে-সময়ে এক কাশ্মিরি শিয়া আমাদের দাওয়াত করেন। খানাপিনার পর কাশ্মিরের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা ওঠে। একপর্যায়ে মেজবান আমাদের তিরষ্কার করতে শুরু করেন। তিনি কাশ্মিরি জনগণকে কাপুরুষ মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি, এমনও বলেছেন যে, আমরা ব্রাহ্মণের জাত, আমরা হিন্দুস্তানী হয়ে গেছি। তার মতে, কাশ্মির হলো পাকিস্তানের ধমনী আর আমরা পাকিস্তানের সেই ধনমীটাকে কাফির-মুশরিকদের হাতে তুলে দিয়েছি। 

তার বক্তব্য হলো- "আমাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র আত্মমর্যাদাবোধ নেই। আমরা মুসলমান হয়ে হিন্দুদের অধীনে বসবাস করছি। কাফির-মুশরিকদের আনুগত্য করছি। হিন্দুস্তান মুসলমানদের বড় দুশমন। ভারত বিভক্তি থেকে এ পর্যন্ত হিন্দুস্তানে অসংখ্য মুসলিম-বিধ্বংসী দাঙ্গা হয়েছে। সেসব দাঙ্গায় মুসলমানদের শুধু নির্মমভাবে হত্যা-ই করা হয়নি, তাদের সহায়-সম্পদও লুট করা হয়েছে, দোকানপাট, কলকারখানা, বাড়িঘর ভস্মীভূত করা হয়েছে, মুসলিম নারীদের সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। এ সবকিছু দেখা সত্ত্বেও তোমরা সেই হিন্দুস্তানের অধীনে বসবাস করছ, তাদের বানানো পুতুল শাসকদের আনুগত্য করছ।"

মেজবানের কথাগুলো সেদিন আমার মনে দারুণ রেখাপাত করে, কথাগুলো আমার শিরায় শিরায় মিশে যায়, যা পরবর্তী কালে প্রজ্জ্বলিত স্ফুলিঙ্গের রূপ ধারণ করে। আমার ছোট ভাই বেলাল আহমাদ বেগ তার ভগ্নিপতির কারখানায় কাজ করত। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ভোরবেলা যথারীতি সে কারখানায় চলে যায়। দিনটি ছিল সোমবার। কারখানায় গিয়ে সে ছোট ভাই ফিরোজের হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলে দেয়, এটি বড় ভাই শাকিল বেগের হাতে পৌঁছিয়ে দিয়ো। সন্ধ্যায় ফিরোজ বাড়ি এসে বেলারের চিঠিটা শাকিলের হাতে দেয়। শাকিল চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করে-

"আমি ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক মিশনে যাচ্ছি। আপনারা আমাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন না এবং আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার কথাও জানাজানি হতে দিবেন না। ইনশাআল্লাহ আমি এক মাস পর ফিরে আসব। পত্রখানা পাওয়ার পর আমার পিত্রালয়ে রীতিমতো মাতম শুরু হয়ে যায়। তাদের কারও বুঝে আসছিল না, এসব কী ঘটছে। কাশ্মিরি মুসলমানদের ভারতের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করা তাদের কাছে ছিল এক অশ্রুতপূর্ব কথা। ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা মুখে আনা ছিল তখন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

এই একটুখানি একটা ছেলের সীমান্তের ওপারে যাওয়া ছিল 'বাগের দুধ দোহন'-এর নামান্তর। আর আমার পিত্রালয়ের লোকদের দৃষ্টিতে এটা পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। আমার বাবা-মা, ভাই-বোন সকলের বুকফাটা কান্না আসে। কিন্তু ক্রন্দন করারও তো উপায় নেই। কারণ, বেলাল বিষয়টা জানাজানি করতে নিষেধ করে দিয়েছে।

পরদিন ভোরবেলা আমার এক ভাই এসে আমাকে নিযে যায়। আমিও বেলালের চিঠি সম্পর্কে অবহিত হই। আমি চিঠিখানা পাঠ করি। সঙ্গে- সঙ্গে আমি চিঠির বক্তব্যের গভীরে পৌছে যেতে সক্ষম হই। ঘরের সবাইকে ধৈর্যধারণের পরামর্শ দিই এবং সতর্ক করে দিই, বাইরের কেউ যেন এ ব্যাপারে কিছু জানতে না পারে। আমি সবাইকে বোঝাবার চেষ্টা করি, সীমান্তের ওপারে একা আমাদের বেলালই যায়নি, আরো অনেক যুবকও গিয়েছে, আরো অনেকে যাবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।

"আচ্ছা, আমাদের বেলাল ফিরে এসে কি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে?” আমার আব্বা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। তার প্রশ্নের ধরন এমন যে, তার মতে এটা অসম্ভব ব্যাপার। জবাবে আমি বললাম, জানি না, বেলাল ফিরে এসে কী করতে পারবে। তবে আপনি দেখবেন, অদূর ভবিষ্যতে এখানকার অনেক অসম্ভবই সম্ভব হয়ে যাবে।

আমি আমার পিতা, ভাই শাকিল ও ফিরোজকে নিজ-নিজ কাজে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিই এবং মাকে সঙ্গে করে আমার নটিপুরার বাড়িতে নিয়ে আসি। পুত্রের বিরহে তিনি চরম বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন

আমার ছোট বোন সংবাদ পেয়ে বিষয়টা জানার জন্য আমার বাড়িতে এল। আমি তাকেও শান্ত করার জন্য কিছুদিন আমার বাড়িতে রেখে দিই। সেই পরিস্থিতিতে আমাকে মুরুব্বী হয়ে মা ও বোনকে সান্ত্বনা দিতে হয়েছিল।

আমার মা ও বোন পালাক্রমে কিছুদিনের জন্য বাড়িতে যেতেন আবার আমার কাছে ফিরে আসতেন। এভাবে এক মাস কেটে যায়। হঠাৎ একদিন লোকমুখে খবর ছড়িয়ে পড়ল, বেলাল ফিরে এসেছে। তখন মা ও বোন আলুবাচাগের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। বেলালের ফিরে আসার সংবাদ শুনে আমি তাকে একনজর দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়ি। কিন্তু ফিরে এসে সে সোজাসুজি বাড়িতে না এসে হঠাৎ করে কোথায় যেন লুকিয়ে যায়। 

আমি লোকমুখে শুনলাম, তারা বেলালকে অমুক জায়গায় দেখেছে, তমুক জায়গায় দেখেছে। একজন বলল, আমি তাকে ঈদগাহে দেখেছি। আরেকজন বলল, আমি বেলালকে ট্যাক্সিতে করে ঐদিকে যেতে দেখেছি। এসব শুনে আমি আরও বিচলিত হয়ে পড়ি। ভাইটাকে আমার বুকে জড়িয়ে নিতে মন চাইছিল। তার সেই হাত দুটিতে আমার চুমো খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল, যে- হাতে সে মাতৃভূমির আযাদির জন্য বন্দুক ধারণ করেছে।

কাশ্মিরকে আযাদ করার জন্য আমার ভাই জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমার এর চেয়ে বড় গৌরব আর কি আছে! আহ! আমি যদি পুরুষ হতাম! কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার আমার মনে হচ্ছিল, কে যেন আমাকে বলছে, প্রয়োজন কী, নারী হয়েও তুমি পুরুষ অপেক্ষা বড় কাজ করতে পার। ওঠো, অলসতা ছেড়ে গাঝাড়া দিয়ে দাঁড়াও, কাজ করে দেখাও।

আমার বোরকা পরার অভ্যাস ছিল না। কিন্তু আজ আমি বোরকা পরে মুজাহিদ ভাইয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। আমি শুনেছি, বেলাল নাকি দাড়ি রেখেছে। ভাবলাম, ভাই আমাকে বেপর্দা দেখে অসন্তুষ্ট হয় কিনা। আমি স্থানে-স্থানে বিভিন্নজনকে আমার মুজাহিদ ভাই সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম।

এ সময় আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সংবাদ শুনে হেলাল আহমাদ বেগ মাকে দেখতে এলেন। দেখামাত্র মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন এবং মাথায় চুম্বন করে কাঁপা কণ্ঠে বললেন, মনে হচ্ছে, আমি আমার বেলালকে জড়িয়ে ধরেছি। বেলাল বলল, হ্যাঁ, আম্মাজান, আমিও আপনার সন্তান। মা বললেন, হ্যাঁ, তা ঠিক।

মা হেলাল বেগকে বেলাল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন, আমার বাছা কোথায়? ছেলেটা আমাদের দেখা দেয় না কেন? আমার ওকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। হেলাল বেগ মাকে বলল, আমি বেলালকে সঙ্গে করে আপনাদের কাছে নিয়ে আসব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। ও যেখানেই থাকুক নিরাপদ আছে।

সে-সময়েই একদিন মা অসুস্থ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার জন্য ট্যাক্সিতে বসে আছেন। এমন সময়ে হঠাৎ তার সামনে-পেছনে, ডানে-বায়ে চারটা ট্যাক্সি এসে দাঁড়িয়ে যায়। তার একটাতে বেলাল, মুশতাক, আলতাফ ও শাহীন বসা। তারা ট্যাক্সি থেকে নেমে আসে। দেখে মা-ও ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়েন। আনন্দের আতিশয্যে মা বেলালকে বুকে জড়িয়ে ধরতে উদ্যত হন। কিন্তু বেলাল মাকে রাস্তায় এসব করতে বারণ করে বলল, আপনি ঘরে যান; আমরাও আসছি।

চার যুবক মায়ের পেছনে-পেছনে ঘরে ঢোকে। তারা এখানে বসেই সিদ্ধান্ত নেয়, আগামীকাল নটিপুরায় আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবে। আমি অধীর অপেক্ষায় প্রহর গুণতে শুরু করলাম।

চলবে...............


পর্ব-২ এখানে.......

Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp