বেলাল আহমাদ বেগ-এর আমার বাড়িতে আগমন
পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার ভাই বেলার আহমাদ বেগ আমার বাড়িতে আসে। সঙ্গে আসে হেলাল, নেছার যোগি, ওমর মুখতার, আলতাফ খান ও আরো কয়েকজন যুবক। তারা সবাই সশস্ত্র। আমার ঘরে কাশ্মিরের এই মুজাহিদদের পদধূলি পেয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আমি একবার তাদের প্রতি একবার আমার ঘরের প্রতি তাকাতে লাগলাম। আমি যে এত বড় ভাগ্যবতী মহিলা আমার যেন তা বিশ্বাসই হচ্ছিল না। গর্বে আমার বুকটা ফুলে গেছে। মনে হচ্ছিল, যেন আমার ঘরে কোনো অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেছে।
কাশ্মিরি যুবকদের সশস্ত্র অবস্থায় দেখে আমার মনে হলো, যেন শত-শত বছরের গোলামির পর আমার ঘরে আযাদি এসে গেছে। এই সশস্ত্র যুবকদের আমার কাছে মনে হলো, যেন এরা নিষ্পাপ ফেরেশতা, যারা আমাকে কামিয়াবির সংবাদ জানাতে আমার ঘরে এসেছে। সশস্ত্র যুবকদের আগমনে আমার মাথা গর্বে উঁচু হয়ে গেছে। আমার বারবার সন্দেহ হচ্ছিল, এ আমি স্বপ্ন দেখেছি না তো। এই যুবকরা আমার বছর বছরান্তের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করে দিয়েছে। আমার ঘরে তাদের এই আগমন বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ এক শুভ লক্ষণ এর চেয়ে কম নয়। তারা আমার সম্পদ। তারা আমার মাথার তাজ। আমি তাদের যেতে দেব কেন? তাই আমি তাদেরকে আমার ঘরেই থেকে যাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। বেলাল আহমাদ বেগ আমার প্রস্তাব কবুল করে নেয়। আমার ঘরে নতুন করে আনন্দের জোয়ার আসে।
আমার ভাই বেলাল আহমাদ বেগ এখন একটি জিহাদি সংগঠনের একজন দায়িত্বশীল। সংগঠনের নাম 'স্টুডেন্টস লিবারেশন ফ্রন্ট'। সংক্ষেপে এসএলএফ। আমার ঘর এখন এই সংগঠনের প্রধান কার্যালয়। ধীরে-ধীরে এসএলএফ-এর অন্যান্য নেতা-কর্মীরাও আমার ঘরে আসা- যাওয়া করতে শুরু করে। এখান থেকেই তাদের সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে।
এখন দিন-রাত বিপুলসংখ্যক সশস্ত্র যুবক আমার ঘরে আসা-যাওয়া করছে। আমি তাদের জন্য ক্যাম্প খুলে দিলাম। কারও পোশাকের প্রয়োজন দেখা দিলে আমি সেই প্রয়োজন পূরণ করার চেষ্টা করছি। কারও জুতা কিংবা বুটের প্রয়োজন হলে আমি তার ব্যবস্থা করছি। আমি আগেই সবাইকে জানিয়ে রেখেছি, জীবনের প্রয়োজনাদির ব্যাপারে নিশ্চিত থেকে তোমরা কাজ করে যাও। যখনই কোনো জিনিসের প্রয়োজন হবে, বড় বোন মনে করে আমার কাছ থেকে চেয়ে নিয়ো। আমি আমার ঘরটা মুজাহিদদের জন্য ওয়াক্ফ্ফ করে দিলাম।
আমার ঘরে সশস্ত্র যুবকদের আনাগোনা দেখে নটিপুরার অধিবাসীরা তথা আমার প্রতিবেশীরা; বিশেষ করে আশপাশের দোকানদাররা আমার বাড়ির প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখতে শুরু করে দেয়। আমার ঘরটাকে 'মুজাহিদ মনযিল' মনে করে তারা নিজ উদ্যোগেই এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়, যাতে কেউ এ-ঘরের প্রতি বাঁকা দৃষ্টিতে দেখার সাহস দেখাতে না পারে।
অল্প সময়ের মধ্যে আমার বাড়ি ও আমার পরিবার এলাকার মানুষের কাছে সম্মানের পাত্র হয়ে যায়। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন মুজাহিদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আসতে শুরু করে। আমার বাড়িটা একটা মেলার রূপ ধারণ করে।
কয়েক মাস পর্যন্ত এই ধারা চলতে থাকে। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে জনসাধারণের ব্যাপক সমর্থন ও অংশগ্রহণ মুজাহিদদের সাহস ও আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তোলে। মসজিদে-মসজিদে কাশ্মিরের স্বাধীনতা ও ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার স্লোগান শুরু হয়ে যায়। মানুষ রাজপথে নেমেও মিছিল করতে শুরু করে।
একদিন নটিপুরা, দেলসুজ কলোনি ও আবাদ বস্তির বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ-শিশু বিশাল এক মিছিল নিয়ে কাশ্মিরের স্বাধীনতার স্লোগান দিতে-দিতে রামবাগ অভিমুখে এগিয়ে যায়। মিছিলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুজাহিদও উপস্থিত ছিল। বেলাল আহমাদ বেগ ও নেছার জোগি মিছিলে আমার সঙ্গে ছিল। অন্যভাবে বলা যায়, আমি তাদের ছায়া হয়ে তাদের সঙ্গে যাচ্ছিলাম।
বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪
🌹 ধন্যবাদ 🌹
বেলাল আহমাদ ও নেছার জোগির বিশ্বাসই হচ্ছিল না, এত অল্প সময়ের মধ্যে তাদের মিশন সফলতা লাভ করবে এবং এত দ্রুত জনগণ তাদের আহ্বানে লাব্বাইক বলে ময়দানে নেমে আসবে। মিছিলে জনতার ঢল দেখে মুজাহিদরা সীমাহীন আনন্দিত হয়।
নেছার জোগি আনন্দের আতিশয্যে মিছিলের মধ্যে তার বন্দুকটা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। মিছিলে অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ মানুষ এই প্রথমবারের মতো একজন কাশ্মিরি যুবকের হাতে অস্ত্র দেখতে পেয়ে আনন্দে তালি বাজাতে শুরু করে।
আবেগের অতিশয্যে নেছার জোগি খোলা আকাশের দিকে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। জনতা নেছার জোগিকে কাঁধে তুলে নেয় এবং আকাশ-বাতাস মুখরিত করে স্বাধীনতার স্লোগান দিতে দিতে সম্মুখ পানে এগিয়ে যায়।
এই অভাবিতপূর্ণ দৃশ্য দেখে আমার দু-চোখে আনন্দের অশ্রু নেমে আসে। কিন্তু এই অশ্রু শুকাতে-না-শুকাতেই হঠাৎ একদিন ভারতীয় পুলিশ নেছার জোগিকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। নেছার জোগির গ্রেফতারের সংবাদ আমার মনে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দেয়। আমাদের এই অঞ্চলে একজন মুজাহিদকে গ্রেফতার করার ঘটনা এ-ই প্রথম।
সময়টা ছিল রমযান মাস। সন্ধ্যায় ইফতারের সময় হেলাল আমাকে নেছারের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ দেয়। সংবাদ শুনে আমি অস্থির হয়ে পড়ি। হেলাল আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তারপরও সে আমাকে বিচলিত দেখে বলল- আপনি ধৈর্যধারণ করুন। সাহস হারাবেন না। আমি অতিশীঘ্র নেছার ভাইকে ছাড়িয়ে আনব। কীভাবে? আমি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করলাম।
হেলাল বলল, আপনি অপেক্ষা করুন এবং দেখুন কী ঘটে। আল্লাহ ইচ্ছা করলে নেছার ভাই অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্ত হয়ে ফিরে আসবে।
আমার পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও হেলাল বলল না সে কীভাবে নেছার জোগিকে মুক্ত করবে। কয়েক দিন পর হঠাৎ খবর পেলাম কাশ্মির ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর মুশিরুল হক, এইচএমটি'র জেনারেল ম্যানেজার খিড়া ও মুশিরুল হকের প্রাইভেট সেক্রেটারি আবদুল গনী অপহৃত হয়েছেন।
এই তিন ব্যক্তির অপহরণের ঘটনার সংবাদে প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। ঘটনাটা দেশে-বিদেশে সর্বত্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিভিন্ন মহল থেকে অপহৃতদের উদ্ধার করার দাবি উত্থাপিত হয়। সরকারও তাদের উদ্ধারে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে দেয়।
কাশ্মিরে সশস্ত্র সংগ্রামে অপহরণের ঘটনা এটিই প্রথম। তাই ঘটনাটি সর্বত্র বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। সাধারণ মানুষের কাছে এটি একটি অবিশ্বাস্য দুর্ধর্ষ অভিযান। কাশ্মিরে এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে, তা কারও কল্পনায়ও ছিল না।
'স্টুডেন্টস লিবারেশন ফ্রন্ট' এই অপহরণ ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করে। পুলিশ সংগঠনের দায়িত্বশীলদের গ্রেফতার করার জন্য ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে। আমার ঘরেও হানা আসতে শুরু করে। শুধু আমার নটিপুরার বাড়িতেই নয়, আলুচাবাগে আমার পিতার বাড়িতেও পুলিশ কয়েকবার হানা দেয়।
এসএলএফ নেছার জোগি, গোলাম নবী বাট ও ফাইয়াজ আহমাদের মুক্তি দাবি করে। এই দাবির পর আমার বাড়িসহ যেখানে-সেখানে পুলিশ হানা ও ব্যাপক তল্লাশি শুরু হয়ে যায়।
অবস্থার ভয়াবহতা আঁচ করে আমি ও আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। আলুচাবাগের বাড়িতে আমার মা-বাবা, ভাই-বোনদের উপর পুলিশ নির্মম অত্যাচার শুরু করে দেয়, যাতে তারা আমার ও বেলালের ব্যাপারে সন্ধান দেয় এবং মুশিরুল হক ও খিড়া সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
অপহৃতদের উদ্ধারের লক্ষ্যে পুলিশ সর্বত্র এমন কঠোর প্রহরা ও নজরদারি বসায় যে, অপহৃতদের প্রয়োজনে স্থানান্তর করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। গভর্নর জগমোহন স্থানে-স্থানে সোর্স বসিয়ে রেখেছেন। দেশ- বিদেশ থেকে জগমোহনের উপর মুজাহদিদের দাবি পূরণ করে অপহৃতদের মুক্ত করে আনার চাপ যত বাড়তে থাকে, জগমোহন ততোধিক গোঁড়ামির পথ অবলম্বন করতে থাকেন। এসএলএফ-এর পক্ষ থেকে হুমকি দেওয়া হয়, যদি তাদের দাবি পূরণ করে বন্দি মুজাহিদদের মুক্তি দেওয়া না হয়, তাহলে তারা অপহৃতদের হত্যা করে ফেলবে।
কিন্তু মুখে হুমকি দিলেও অপহৃতদের হত্যা করার পরিকল্পনা মুজাহিদদের ছিল না। যখন ভারতীয় বাহিনী ও পুলিশের দ্বারা মুজাহিদরা চরমভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ে এবং মিশনের সফলতা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন মুজাহিদরা খিড়াকে বটামালনা নামক স্থানে নিয়ে ছেড়ে দেয়। গায়ের পোশাক পাল্টিয়ে তাকে মুক্তি দিয়ে দেয়। ছাড়ার সময় তাকে বলে দেওয়া হয়, যেন কন্ট্রোল রুমে গিয়ে তিনি পুলিশের হাতে ধরা দেন এবং বলেন, আমি জঙ্গল থেকে অপহরণকারীদের হাত থেকে পালিয়ে এসেছি।
কিন্তু খিড়া পুলিশ কন্ট্রোল রুমে না গিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি টহল বাহিনীর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দেন। সেই টহল বাহিনী ওয়ারলেস মারফত হেডকোয়ার্টারে সংবাদ জানায়। কী জানি, ওরা সেখান থেকে কী নির্দেশ পেল, রিপ্লাই পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে তারা সেখানেই খিড়াকে গুলি করে হত্যা করে ফেলে।
কারফিউ থাকা সত্ত্বেও আমাদের যুবকরা পরিস্থিতির উপর কঠোর নজর রাখতে সচেষ্ট থাকে। পুলিশের হাতে খিড়ার নিহত হওয়ার সংবাদ
পেয়ে তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। কারণ, ইতিমধ্যে তাদের অপর একটি দল মুশিরুল হককে নিয়ে লাসজান অভিমুখে রওনা হয়ে গেছে। ওখানে তাকে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। তাছাড়া পুলিশ খিড়াকে হত্যা করে তার দায়ভার এসএলএফ-এর উপর চাপানোর কারণে এলাকায় নতুন করে সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি হওয়ারও আশংকা আছে।
গভর্নর জগমোহন খিড়াকে হত্যা করে যে ষড়যন্ত্র আঁটে, তা এসএলএফ-এর জন্য বিরাট এক পরীক্ষার চেয়ে কম নয়। এমতাবস্থায় যদি মুশিরুল হককে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা হয়, তাহলে সংগঠনের উপর সাম্প্রদায়িকতার ছাপ পড়ে যাবে নিশ্চয়ই। তাই তড়িঘড়ি করে মুশিরুল হককে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয় এবং দুজন যুবককে তৎক্ষণাৎ লাসজান অভিমুখে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যাতে তারা মুশিরুল হককে নিয়ে যাওয়া সাথীদের নতুন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে অবহিত করে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তারা পথ ভুলে লাসজানের পরিবর্তে বারজানের পথে রওনা হয়। কাজ আর হলো না। প্রথম দলটি মুশিরুল হককে লাসজানের একস্থানে ছেড়ে দিয়ে আসে। পুলিশ খিড়ার মতো তাকেও খুন করে ফেলে।
এবার আবদুল গনীর মুক্তিলাভের পালা। তাকে ছেড়ে দিয়ে বলা হলো, এদিক-ওদিক কোথাও না গিয়ে সোজা বাড়ি চলে যাও। কিন্তু তা না করে আবদুল গনী চলে যায় পার্শ্ববর্তী এক বাংকারে। ভারতীয় বাহিনী সেখানে তাকেও হত্যা করে লাশটা রাস্তায় ফেলে দেয়।
এসএলএফ হুমকি দিয়েছিল, তাদের দাবি মানা হলে অপহৃতদের হত্যা করা হবে। এখন তারা একে-একে সবাই খুন হলো। খুন করল সরকার। কিন্তু দোষ চাপানো হলো এসএলএফ'র উপর। অপহরণকারীদের নিরাপদে রাখতে ব্যর্থ হয়ে মুজাহিদরা তাদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু মুক্তিদানের পদ্ধতির ভুলে লোকগুলো প্রাণ হারাল এবং সরকারও মুজাহিদদের নামে দুর্নাম ছড়াবার সুযোগ পেয়ে গেল।
এভাবে ছেড়ে না দিয়ে যদি তারা অপহৃতদের সরাসরি কাশ্মির পুলিশ কিংবা সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিত, তাহলে ঘটনাটা এভাবে ঘটত না। কিন্তু ঘটনা যে এমন ঘটতে পারে, জগমোহন যে এমন ষড়যন্ত্র পাকাতে পারে, অনভিজ্ঞ মুজাহিদরা আগে তা আন্দাজ করতে পারেনি। মুজাহিদদের ধারণা ছিল, তাদের দাবি পূরণ করা ছাড়াই অপহৃতদের মুক্তি পাওয়াকে সরকার নিজের কৃতিত্ব বলে চিহ্নিত করবে। এই ভুলের জন্য মুজাহিদরা অনুতপ্ত হয় এবং ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হয়ে যায়।
অপহৃতরা নিহত হওয়ার পর পুলিশ ও ভারতীয় বাহিনীর হানা-তল্লাশি বন্ধ হয়ে যায়। মুজাহিদরা পুনরায় ধীরে-ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করে।
আমার বাড়িতে মুজাহিদদের আনাগোনা আবার শুরু হয়ে যায়। তবে পূর্বের তুলনায় অনেক সতর্কতার সাথে। আটক মুজাহিদদের মুক্ত করার জন্য তারা নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়।
তিন বছর পর ডক্টর খুসার অপহৃত হওয়ার সংবাদ পেলাম। আবার জেগে ওঠে সরকার। শুরু হয় অনুসন্ধান। অনুসন্ধানের নামে হয়রানি আর অত্যাচার-নির্যাতন। কিন্তু প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো। ডক্টর খুসাকে পুলিশ কোথাও খুঁজে পেল না। অপহরণকারীরা বিনিময়ে আটক তিন মুজাহিদের মুক্তি দাবি করল। অগত্যা সরকার নেছার জোগিসহ তিন মুজাহিদকে মুক্তি দিয়ে দেয়। অপহরণকারীরাও ডক্টর খুসাকে ছেড়ে দেয়। সমস্যার আপাতত একটি সমাধান হলো। পরিস্থিতিও শান্ত হলো।
কয়েক দিন পরের ঘটনা। হেলাল আহমাদ বেগ খালেদ রাজাকে জরুরি এক মিশনে ইসলামাবাদ প্রেরণ করে। সনগম পোলের নিকট পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ফেলে। সংবাদ পাওয়ামাত্র মুজাহিদরা নিজ- নিজ দায়িত্বে সবাই নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপন করে। হেলাল আহমাদ বেগও তার অবস্থান পরিবর্তন করে ফেলে।
কারণ, চাপের মুখে খালেদ রাজা মুজাহিদদের অবস্থানের কথা বলেও দিতে পারে। কিন্তু কয়েক দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন আমার বাড়িতে বা অন্য কোথাও হানা হলো ন, তখন ধীরে-ধীরে হেলাল বেগ ও অন্যান্য সাথীরা আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। আমার ঘরে তাদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।
সে সময়েরই ঘটনা। একদিন চারজন মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে যাচ্ছিল। এজাজ ও বেলালের একস্থানে এবং সালিম ও মুশতাককে অন্য এক স্থানে যাওয়ার কথা। রওনা হওয়ার সময় আমি সালিমকে উদ্দশ্য করে বললাম, তুমি কিন্তু সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে চলবে। ধরা খেলে কোনো অবস্থাতেই কোনো তথ্য যেন ফাঁস না হয়।
কেন জানি সে সময়ে হঠাৎ করে তাদের ব্যাপারে আমার মনে ভয় জেগে গেল। এত ভয় তো আমার পাওয়ার কথা নয়। আবার কেনইবা জানি আমার মন বলে উঠল, সালিম আর ফিরে আসবে না। শত চেষ্টা করেও তখন আমি নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না।
যাহোক, চার যুবক দুভাগে বিভক্ত হয়ে দুপথে রওনা হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর বারামুল্লার আবদুল কাইয়ুম এসে সংবাদ দিল, সালিম জরগরকে এইমাত্র রামবাগ পুলের নিকট থেকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে।
সংবাদটা কানে আসামাত্র মনে হলো, যেন আকাশটা ভেঙে আমার মাথায় পড়েছে। আমি নিজেকেই তিরষ্কার করতে শুরু করলাম, কেন আমি সলিমের ব্যাপারে দুঃশ্চিন্তা মাথায় ঢুকতে দিয়েছিলাম, কেন আমি আগেই তার ব্যাপারে আশংকাবোধ করেছিলাম! সলিম জরগরের গ্রেফতার হওয়ার দায়ভার নিজের মাথায় চেপে নিয়ে আমি আফসোস করতে লাগলাম। মনে হলো, যেন আমিই সলিমকে গ্রেফতার করেছি। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, পথে তার গ্রেফতার হওয়ার এতই যখন আশংকা ছিল, তাহলে তুমি কেন ওকে যেতে দিলে? কেন তুমি ওকে যেতে বারণ করলে না।
আমি কাইয়ুমকে বললাম, সালিম যেখানে গ্রেফতার হয়েছে, তুমি আমাকে সেখানে নিয়ে যাও। কাইয়ুম বলল, আপনি ওখানে গিয়ে কী করবেন? আমি বললাম, ওসব বুঝি না; তুমি আমাকে নিয়ে যাও।
আমার জিদ দেখে কাইয়ুম অস্থির হয়ে যায়। তার ধারণা, সংবাদটা আমার মস্তিষ্কে গভীর প্রভাব ফেলেছে। সে আমাকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করে। কিন্তু আমি আমার দাবিতে অটল থাকলাম যে, যেকোনোভাবে হোক তুমি আমাকে ওখানে নিয়ে যাও। অগত্যা সে আমাকে তার গাড়িতে তুলে রামবাগ নিয়ে যায়। সেখানে আমি মানুষের প্রচণ্ড ভিড় এবং বিপুলসংখ্যক পুলিশের উপস্থিতি দেখতে পেলাম। জনতা সালিম জরগরের গ্রেফতারের ব্যাপারে বলাবলি করছে। আমি সেখান থেকে দ্রুত কেটে পড়লাম এবং কাইয়ুমকে কিছু না বলে একটা ট্যাক্সিতে চড়ে বসলাম।
আমার ইঙ্গিত পেয়ে চালক স্টার্ট দিয়ে ট্রাক্সি ছুটাল। আমি একটু পর- পর ট্যাক্সি থামিয়ে মুজাহিদদের গোপন অবস্থানগুলোতে গিয়ে-গিয়ে সংবাদ দিতে শুরু করি যে, সালিম জরগর গ্রেফতার হয়েছে, তোমরা সতর্ক হয়ে যাও এবং দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করো। আমি দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত ট্যাক্সি থামিয়ে এভাবে মুজাহিদদের সতক্য করতে থাকি।
মিশন শেষ করে ফিরে আসার সময় রামবাগ পৌছে পূর্বের অপেক্ষা অধিক ভিড় দেখতে পেলাম এবং পুলিশের উপস্থিতি আগের চেয়ে অনেক বেশি মনে হলো। মন বলল, নতুন কোন ঘটনা ঘটে থাকবে। আমি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতে-না-করতে পুলিশ এসে আমার ট্যাক্সিটা ঘিরে ফেলল। পুলিশ আমার ট্যাক্সিতে তল্লাশি চালাল। আমি মহিলা এবং একা বলে তারা আমাকে ছেড়ে দিল।
এখানে নতুন করে কী ঘটল জানার জন্য আমার মনে প্রচণ্ড কৌতূহল জাগল। আমি এক ব্যক্তিকে ইঙ্গিতে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করলাম। লোকটি বলল, হেলাল বেগ ও জাবেদ পুলিশের চোখে ধুলা দিয়ে পালিয়ে গেছে। সেজন্য পুলিশের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমি ড্রাইভারকে সারায়েবালার দিকে যেতে বললাম।
সারায়েবালা গিয়ে আমি আমার পিতাকে পেলাম। তার নিকট হেলালের সংবাদ জিজ্ঞেস করলাম। তিনি কিছু বলতে পারলেন না। আমি এক দোকানীর নিকট গিয়ে হেলাল সম্পর্কে জানতে চাইলাম। দোকানী বলল, হেলাল ভালো আছে, জায়গামতো পৌঁছে গেছে। আমি শান্ত হলাম এবং বাড়ি ফিরে এলাম।
ট্যাক্সিচালক আমার পরিচিত ছিল না। তাই আমার গতিবিধিতে সে বিস্মিত হয়ে পড়ল যে, আমি কে, এসব কি-ইবা করছি। আমি কোথাও একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদারকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে আবার রওনা হলাম। আরেকটু সামনে অগ্রসর হলাম। একজনের সঙ্গে দেখা হলো। গাড়ি থামিয়ে তাকে কোথাও পাঠিয়ে দিলাম। আবার একটু অগ্রসর হলাম। হঠাৎ চালককে গাড়ি থামাতে বললাম। একজনের কানে-কানে কিছু বলে আবার রওনা হলাম। কারও বাড়ির সামনে ট্যাক্সি থামিয়ে রেখে ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং ঘরের নারী-পুরুষ কাউকে বাইরে নিয়ে এসে তৎক্ষণাৎ তাকে কোথাও রওনা করিয়ে দিলাম।
আমার এসব কর্মকাণ্ড ও আচরণ দেখে ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে রহস্যময়ী নারী ভাবতে শুরু করল। আমার মনে হলো, হয়ত লোকটা আমাকে মানসিক বিপর্যস্ত নারী ভেবে বসেছিল। কিন্তু আমি তাকে কিছু বুঝতে দিতে অপারগ ছিলাম। সবশেষে যখন নিশ্চিত হলাম, আশপাশের সব জায়গায় সংবাদ পৌছে গেছে, তখন আমি বাড়ি ফিরে এলাম।
বলাবাহুল্য, একটি সশস্ত্র সংগঠনের কোনো সদস্য যদি গ্রেফতার হয়, তাহলে সংগঠনের অন্যান্য সদস্যদের তৎক্ষণাৎ অবস্থানই পরিবর্তন করতে হয় না, অস্ত্রশস্ত্রও স্থানান্তর করে লুকিয়ে ফেলতে হয়। অর্থাৎ- সংগঠনের গোটা সিস্টেমটাই মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে ফেলতে হয়। এই সিস্টেম পরিবর্তনের যে দৌড়-ঝাঁপ পোহাতে হয়, তা কেবল সেই ব্যক্তি-ই অনুমান করতে পারে, যার উপর এই দায়িত্ব চাপে। আমি সেদিন বিষয়টা হাড়ে- হাড়ে টের পেয়েছিলাম।
আমি যখন বাড়িতে ফিরে আসি, ততক্ষণে মুজাহিদদের কেউ-কেউ ফিরে এসেছে। তারপরও কতজন আসবে, কে-কে আসবে, তার কিছুই আমার জানা ছিল না। এটা কখনও জানা সম্ভব হতো না। কিন্তু তারপরও যথারীতি সবার জন্যই রান্না করতে হতো।
দিনভর ছোটাছুটি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে এসে আমি মুজাহিদদের জন্য রান্নার কাজ শুরু করে দিলাম। কাজের জন্য বাইরের কোনো লোক নিয়োগ করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য পুরো দায়িত্ব চাপল আমার ও আমার ছেলেমেয়েদের উপর। সাধারণত আমি প্রতিদিন দশ থেকে বারোজন মুজাহিদের জন্য রান্না করতাম। কোনো-কোনোদিন পনেরো-বিশজন যুবকও আমার ঘরে খানা খেত। আমি এমনভাবে রান্না করতাম যে, দশজনের স্থানে হঠাৎ পনেরোজন হয়ে গেলেও যাতে সমস্যা না হয়।
আমি মুজাহিদদের জন্য যে পাতিলে রান্না করতাম, তার নাম রাখা হয়েছিল 'জান বাবা সাহেবের পাতিল'। জান বাবা নামক এক বুযুর্গ ছিলেন। তাঁর আস্তানায় সব সময় লঙ্গরখানা চালু থাকত। আমার অবস্থাও ছিল মোটামুটি সেই রকম। আমার অর্থ-সম্পদ ও শক্তি-সামর্থ্য মুজাহিদদের কিছুটা উপকারে আসছিল বলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করতাম। তাতে আমার যে কী আনন্দ লাগত, তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। একটি মুসলিম ভূখণ্ডে ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতা আন্দোলনের কিছুটা হলেও উপকার করতে পারা সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার।
আমি রান্না-বান্না করে মুজাহিদদের আহার করিয়ে আপাতত যার-যার নিরাপদ অবস্থনে চলে যেতে বলতাম। কারণ, এখানে পুলিশি হানা হবে তা নিশ্চিত। আমার নির্দেশমতো একে-একে সবাই চলে গেল।
বেশি বিলম্ব হলো না। আমার বাড়িতে একের-পর-এক পুলিশি হানা শুরু হয়ে গেল। আমার পরিবারের সকল সদস্যকে পুলিশ মারধর করতে শুরু করল। মুজাহিদদের সন্ধান পাওয়ার জন্য তারা আমার নির্দোষ সন্ত ানদের উপর নির্যাতন চালিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, আমাকেও একাধিকবার চুল ধরে টানা-হেঁচড়া করে ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। প্রতিটি হানার সময় পুলিশ আমার স্বামীর উপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালায়।
এই ধারা অব্যাহত থাকল। একপর্যায়ে পুলিশ মুশতাককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কিছু দিন পর আমার ভাই বেলালও গ্রেফতার হয়।
0 Comments