Header Ads Widget

▶️ আধার রাতের বন্দিনী। পর্ব-১

অন্যদিনের মত আজও গোসল ও খানাপিনা সেরে কিতাবাদী- খাতা-কলম নিয়ে ছাত্রাবাস হতে ক্লাসরুমে প্রবেশ করি। ক্লাস শুরুর আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। ছাত্ররা নিজ নিজ আসনে বসে হুজুর আগমনের পথ-পানে অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে। দপ্তরী তৃতীয় তলায় ঝুলান ঘন্টায় দশটি আঘাত হানার সাথে সাথে প্রথম প্রিয়ডের হুজুর ক্লাসে আসবেন। 

কিন্তু আজ অন্যদিনের মত ঘন্টাধ্বনি শোনা যায়নি। এল পাগলা ঘন্টার বিপদধ্বনি। পাগলা ঘন্টা শোনার সাথে সাথে ছাত্ররা যার যার কিতাবাদী যথাস্থানে রেখে দিয়ে ছুটল মসজিদপানে। এক এক করে অল্পক্ষণের মধ্যেই মসজিদটি কানায় কানায় ভরে গেল। এখন কেউ আর রুমে নেই, নেই আঙ্গিনায়। বড় হুজুর মলিনমুখে মিম্বরের হাতলে হাত রেখে আমাদের দিকে ফিরে দাঁড়ালেন। তার চোখ দু'টি লাল, অশ্রুভেজা। তিনি ক্ষীণ আওয়াজে ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুরে বললেন, "বাবারা! দরূদ-এস্তেগফার পড়ে খুব বিনয়ের সাথে একাগ্রচিত্তে দোয়ায়ে ইউনুস পাঠ কর। দেশের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ।"

আমরা নিয়মানুযায়ী দরূদ-এস্তেগফার পড়ে গুন্ গুন্ শব্দে 'লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নী কুন্তু মিনায যোয়ালিমীন' পড়তে লাগলাম। এক ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পর হিসাব করে দেখা গেল, সোয়া লাখেরও অধিক পড়া হয়েছে। বড় হুজুর আবার উচ্চস্বরে দরূদ- এস্তেগফার পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলেন। 'আমীন! আমীন!' রবে মসজিদ প্রকম্পিত হয়ে উঠল।

দীর্ঘ মুনাজাত শেষে বড় হুজুর মিম্বরে দাঁড়িয়ে বললেন, "হে আমার আজীজ তালাবা ও সহকারী আসাতিজাবৃন্দ! সমরকন্দের জামে মসজিদের খতীবসহ দশ-বারজন আলেমকে কমিউনিস্টরা ধরে নিয়ে এক জায়গায় বিবস্ত্র করে ব্রাশফায়ারে শহীদ করে দিয়েছে।" শুনে শত শত ছাত্রের জবান থেকে 'ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন' বেরিয়ে এল। 

হুজুর আরো বললেন, "ওরা শহরের বড় বড় বেশ কয়েকটি মাদ্রাসার ওস্তাদ-ছাত্রদেরকে ধরে নিয়ে গেছে। তাদেরকে কোথায় কিভাবে রেখেছে, তার সন্ধান আজও মেলেনি। আমাদের মাদ্রাসাসহ আরো কয়েকটি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের নামও তালিকাভুক্ত করেছে। কম্বিং অপারেশন চালিয়ে দু'-একদিনের মধ্যে আমাদেরকেও ধরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা চলছে। থানার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মাধ্যমে আমি এ সংবাদ পেয়েছি। তাই আজ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হল। তোমরা নিজ নিজ দায়িত্বে ছামানাপত্র নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মাদ্রাসা ত্যাগ কর। দ্বিতীয় নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ বাড়ীতে অবস্থান করতে থাক আর খুব বেশী বেশী দোআ করতে থাক।"

এতটুকু বলতে না বলতে বড় হুজুর অবোধ বালকের ন্যায় হাউ- মাউ করে কেঁদে ফেললেন। সবার চোখে পানি, 

সকলের চেহারায় মলিনতার ছাপ। ঠিক এই মুহূর্তে অচেনা এক যুবক জুতা পায়ে পবিত্র মসজিদে ঢুকল। পরনে তার হাফপ্যান্ট, গায়ে হাফশার্ট, বুকে লাগান কাস্তে- হাতুড়ি মার্কা স্টিকার। মোটা মোটা গোঁফ, চোখ দু'টি টকটকে লাল, হাতে হ্যান্ডমাইক। কটিদেশে ঝুলান ইয়া বড় খঞ্জর। দেখলেই মনে হয়, সে যেন নরখাদক-জল্লাদ। মসজিদে প্রবেশ করেই হ্যান্ড মাইকটি অন্ করে তেজোদ্বীপ্ত কণ্ঠে বলতে শুরু করল, "হে এদেশের আবর্জনা-জঞ্জাল মৌলবাদী ও রুহানীরা! 

আমাদের চরম ও পরম মুক্তিদাতা লেনিনের আদর্শ গ্রহণ কর। তবেই তোমরা পরম সুখে এদেশে বসবাস করতে পারবে। এখন আর মরুদেশের ধর্ম, মোহাম্মদের ধর্ম এদেশে চলবে না। মিস্টার লেনিন, স্টালিন আর কার্ল মার্কসের মতবাদ, চিন্তা ও আদর্শ ছাড়া অন্যসব মতবাদ অচল। কেউ যদি এর বিরোধিতা কর, তবে তার পরিণাম হবে খুবই ভয়াবহ।"

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹

যুবকটি এ কথাগুলো বলল সমরকন্দের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ জামিয়া আরাবিয়ার শাহী মসজিদে দাঁড়িয়ে কয়েক ডজন ওস্তাদ ও শত শত ছাত্রের সম্মুখে। কেউ মাথা উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে চোখ রাঙ্গিয়ে পাপিষ্ঠ যুবকের কথার উত্তর দিতে হিম্মত পেলেন না। 

হিম্মত হল না প্রতিবাদ জানানোর। তার বক্তৃতার জবাব দেয়ার জন্য আমি অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়াতে চাইলাম, কিন্তু পাশের ছাত্রদের বাধার কারণে তা পারলামনা। খুব কষ্ট করেই হজম করতে হল সে দৃশ্য। যুবকটি বিনা বাধায়, বিনা প্রতিরোধে যা ইচ্ছা তাই বলে নিরাপদে মসজিদ ত্যাগ করল।

ওস্তাদ-ছাত্ররা নিঃশব্দে যার যার রুমের দিকে মন্থর গতিতে অগ্রসর হতে লাগল। কারো মুখে হাসি নেই, ভাষা নেই; আছে শুধু আঁখি-ভরা পানি। মুহূর্তের মধ্যে কে যেন হৃদয়ের আনন্দ কেড়ে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল গালভরা হাসি আর কিতাব পড়ার গুন গুন রব। মাঝে মধ্যে দু'-একজন ছাত্র অবুঝ মনকে বুঝ মানাতে ব্যর্থ হয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। একে অপরের দিকে অপলক নেত্রে তাকিয়ে কি যেন অবলোকন করছিল। সেই করুণ দৃশ্য আমি আজও ভুলতে পারিনি।

সকলেই যার যার রুমে প্রবেশ করে নিজ নিজ কিতাবাদী ও কাঁথা- বালিশ গুছিয়ে গাট্টি তৈরীর কাজে ব্যস্ত। আমি সবগুলো রুম ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। 

অল্পক্ষণের মধ্যে ছাত্ররা নিজ নিজ সামানা কাঁধে বা মাথায় বহন করে চোখের পানিতে আলবিদায় জানিয়ে গৃহাভিমুখে যাত্রা করল। আমার সেদিন আর বাড়ী যাওয়ার সুযোগ হল না। কারণ, সমরকন্দ থেকে জামবুল বহু দূরের পথ। রেলগাড়ীতেও দু'-তিনদিন সময় লেগে যায়। তাই পরদিন সকাল সাতটার ট্রেনে যাবার মনস্থির করলাম। দিনের সূর্য্য ক্রমশই পশ্চিমাকাশে পালাবার রাস্তা খুঁজছে। সমস্ত মাদ্রাসায় আমার মতো হতভাগা সাত-আটজন ছাড়া আর কোন ছাত্র নেই। আর আছেন দু'তিনজন ওস্তাদ। দারে জাদীদের বাগানের কোলঘেঁষে আমি যখন পশ্চিমদিকে যাচ্ছিলাম, তখন আমার ওস্তাদ জালাল উদ্দিন বুখারী আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন।

আমি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে আসসালামু আলাইকুম বলে তার পাশে দাঁড়ালাম। ডাকার কারণ জিজ্ঞাসার পরিবর্তে আমার হৃদয়ের গভীর থেকে অবোধ বালকের ন্যায় কান্নার রোল বেরিয়ে এল। হুজুর আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে বললেন, "বাবা। আল্লাহ জানেন কোন মুহূর্তে কি ঘটে যায়। জানিনা এটাই জীবনের শেষ মুলাকাত কিনা। ইসলামের এ চরম দুর্দিনে মুসলমানদের বিশেষ করে আলেম-ওলামাদের কি অবস্থা হয়?" তিনি এক পর্যায়ে নিজেকে সামলাতে না পেরে উচ্চস্বরে কেঁদে ফেললেন। তারপর আত্মসংবরণ করে বললেন, "গত তিনদিন আগে বুখারা থেকে বেশ কয়েকজন নামকরা আলেমকে বলসেভিকরা ধরে নিয়ে সাইবেরীয়ার তুষারাঞ্চলে প্রেরণ করেছে। সেখানে শুধু বরফ আর বরফ, জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই।" তারপর আমার মাথায় তার পবিত্র হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, "বাবা! মাদ্রাসায় বেশী সময় অবস্থান করো না, বাড়ী ফিরে যাও। কিতাবাদী যতটুকু পড়া হয়েছে, তা মুতালাআ কর। আর আল্লাহর নিকট বেশী বেশী দোয়া করতে থাক।"

এই উপদেশগুলো দিয়ে তিনি তার রুমে চলে গেলেন। আমি আবার পূর্বের ন্যায় প্রতিটি রুম ঘুরে-ফিরে দেখছিলাম। হায়! যেখানে সকাল-সন্ধ্যা, ভোর-বিহানে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতের গুন্ গুন্ রবে জামেয়ার আকাশ-বাতাস মুখরিত থাকত, রুমে রুমে চলত বিভিন্ন বিষয়ের কিতাবাদীর তাকরার; সেখানে আজ বিরাজ করছে নীরবতা, নিস্তব্ধতা ও খাঁ খাঁ পরিবেশ। মসজিদ-মাদ্রাসার আকাশচুম্বি ইমারতগুলো যেন স্বজনহারার বিরহ বেদনায় আর্তনাদ করছে। এমন এক করুণ দৃশ্য অবলোকন করা আমার পক্ষে একেবারে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল, যা আমি কোনদিন ভাবতেও পারিনি। তাই আমিও রুমাল অশ্রুসিক্ত করতে করতে নিজ কক্ষে ফিরে এলাম। এমনি এক অবর্ণনীয় বেদনা বক্ষে ধারণ করে ছটফট করে রজনী পোহালাম।



[দুই]

ফজরের নামায আদায় করে রুমে গিয়ে ছামানাপত্র গুছিয়ে টাঙ্গায় চড়ে সকাল সাতটা বাজার বিশ মিনিট আগেই রেল স্টেশনে পৌছলাম। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে আসা আমার জীবনের এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। অশ্রুসজল নয়নে মাদ্রাসার দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো নেত্রযুগলের তপ্ত অশ্রু উপহার দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। স্টেশনে এসে জামবুলের টিকিট সংগ্রহ করে ট্রেনের অপেক্ষায় একটি বেঞ্চে বসলাম। অন্যদিনের মতো স্টেশনে তেমন লোকজন নেই। কেমন যেন একটা নীরবতা-নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।

ট্রেন সকাল সাতটায় স্টেশনে আসার কথা থাকলেও দু'ঘন্টা বিলম্বে এসে দাঁড়াল। আমি আমার ছামানাপত্র নিয়ে একটা সীট দখল করে বসলাম। আমার পাশের সীটে দু'তিনজন হুজুর উপবিষ্ট। সামনের সীটে কয়েকজন যুবক বসে সিগারেট টানছে। মাত্র কয়েক মিনিট পর গার্ড বাঁশি বাজিয়ে সবুজ নিশান নাড়তে লাগল। গাড়ীটি প্রলয় শিংগা ফুঁকিয়ে সবগুলো চাকা একযোগে গড়িয়ে গড়িয়ে চিরচেনা পথে এগিয়ে চলল। বন-বাদার, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পাগলের মতো ছুটে চলছে। দু'চারটি স্টেশন পেরিয়ে ট্রেন বড় একটি স্টেশনে এসে দাঁড়াল।

ট্রেনটি দাঁড়ানোর সাথে সাথে কমিউনিস্ট যুবকরা প্রতিটি কম্পার্টমেন্টে গিয়ে তল্লাশি চালায়। দাড়ি-টুপিওয়ালা হুজুর বা মাদ্রাসা ছাত্র পেলে ধরে নিয়ে যায়। সারাটা ট্রেনে এক আতংক বিরাজ করছিল। ট্রেনটি প্রতিটি স্টেশনে ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট করে বিলম্ব করছে। আমার সামনের সীটের বখাটে যুবকরা আমার পাশের হুজুরদেরকে 'মৌলবাদী- রুহানী' শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করতে লাগল। কেউ বলছে, "ও মোল্লা! এত বড় দাড়ি দিয়ে কি কর? দাড়ির সেবা-যত্ন করতে যে তৈল ব্যবহার কর, তা কোথায় পাও?” আবার কেউ বলছে, "বাপরে বাপ, এত বড় জামা! মোল্লারাই কাপড়ের দর বাড়াচ্ছে।" এ ধরনের নানা ব্যাঙ্গাত্মক কথা ও অট্টহাসিতে কম্পার্টমেন্ট প্রকম্পিত।

আমি হুজুরদের জিজ্ঞেস করলাম, আপনার। কোথায় যাবেন? হুজুর উত্তর দিলেন, ছামারগান। ছামারগান এখনো বহুদূর। সবটুকু পথ পাড়ি দেয়া দুরূহ। তাই হুজুরগণ পরস্পর পরামর্শ করে সামনের স্টেশনে নেমে অন্য উপায়ে বা পদব্রজে বাকি পথ অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তারা আমাকেও পরামর্শ দিলেন, "বাবা! অবস্থা খুব সঙ্গীন, তুমিও রেলপথে না গিয়ে অন্য পথ তালাশ কর।"

আমি উত্তর দিলাম, "হুজুর, তাকদীরে যা আছে, তা-ই হবে, এর বেশী কিছু নয়।” এসব আলাপ করতে করতে ট্রেনটি উলিশিয়ান স্টেশনে এসে দাঁড়াল। সাথে সাথে হুজুরগণ ঝটপট ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে একাকী বসে রইলাম।

রাত এগারটা। পেটে ক্ষুধার অনল দাউ দাউ করে জ্বলছে। ক্ষুধার তাড়না সইতে না পেরে একপা-দু'পা করে কম্পার্টমেন্টের পর কম্পার্টমেন্ট পার হয়ে কেন্টিনে গেলাম। আমি মেসিয়ার থেকে খাবার এবং কোন্টার দাম কত জেনে নিলাম। তারপর হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসলাম। মেসিয়ার এসে কি খাব জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম, ভাই আমি তো মুসাফির, যেতে হবে বহুদূর, অর্থকড়িও তেমন নেই। কাজেই অল্প পয়সার মধ্যে সামান্য কিছু খানা দাও।

মেসিয়ার চার আনা দামের দু'টি রুটি আর চার আনা দামের একটি গোস্তের কাবাব, মোট আট আনার খাবার পরিবেশন করল। আমি বিস্মিল্লাহি ওয়া আলা বারাকাতিল্লাহ বলে খেতে লাগলাম। এগুলো খেতে না খেতে মেসিয়ার আরো কিছু খাবার এনে বলল, "এসব খাবারও আপনার জন্য, এগুলোও খেয়ে নিন।" আমি বললাম, না ভাই, আমার কাছে এত পয়সা হবে না। মেসিয়ার বলল, "আপনাকে পয়সা দিতে হবে না। আপনার পাশে যে ভদ্রলোকটি বসে খানা খাচ্ছিলেন, উনি পয়সা পরিশোধ করে দিয়ে বলে গেছেন আপনাকে এসব দিতে।"

আমি অনেক ভেবে-চিন্তে সবগুলো খানা খেয়ে নিলাম। খানা খেয়ে কম্পার্টমেন্টে আসার পথে এক ভদ্রলোক আমাকে ডাকলেন। আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি, খাবার গাড়ীর সেই ভদ্রলোক। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে সালাম-মুসাফাহা করে জিজ্ঞেস করলাম, জনাব! আমাকে ডাকছেন কেন?

ভদ্রলোকটি তার স্নেহমাখা হাতটি আমার মাথায় বুলিয়ে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা! তুমি কোথায় যাবে?

বললাম, জামবুল।

তোমার সাথে আর কেউ আছেন?

বললাম, কেউ নেই, আমি একা।

বাবা! জামবুল তো বহুদূর। দু'তিন দিনের পথ। কোথা থেকে এলে?

বললাম, সমরকন্দ থেকে।

সেখানে কি কর তুমি?

বললাম, লেখাপড়া করি।

এতসব প্রশ্ন করার পরও ভদ্রলোক আরো কিছু জানতে চাইলেন। আমি এক এক করে তার প্রশ্নের উত্তর দিলাম। এক পর্যায়ে ভদ্রলোক কাতর স্বরে বললেন, "বাবা! দেশের অবস্থা খুবই নাজুক! আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, দ্বীনদার, পরহেজগার ও মাদ্রাসার ছাত্রদের উপর চলছে বলসেভিকদের, জুলুম-নির্যাতন। তুমি একা এতদূর পথ কি করে যাবে? তুমি যে তালেবে এলেম, তা তোমার নূরানী চেহারাই প্রমাণ করছে।" এই বলে তিনি তার ব্যাগ থেকে একটি শার্ট আর একটি প্যান্ট বের করে আমাকে বললেন, "যাও, তোমার পোশাক পাল্টিয়ে এগুলো পরে নাও। তাহলে কেউ তোমাকে মাদ্রাসার ছাত্র বলে সহজে চিনবে না।"

সুন্নতী পোশাক শরীর হতে আলাদা করা আমার পক্ষে ছিল বেদনাদায়ক। তবু মুরুব্বী মানুষ বারবার পীড়াপীড়ি করায় পোশাক পরিবর্তন করতে বাধ্য হলাম। টয়লেটে গিয়ে পোশাক পাল্টিয়ে আসলে ভদ্রলোকটি কাস্তে-হাতুড়ি মার্কা একটি স্টিকার আমার বুকের পকেটে পিন দিয়ে এঁটে দিলেন। অতঃপর কিছু উপদেশ দিয়ে বললেন, "আমি কাজাকিস্তান পর্যন্ত যাব। কোন অসুবিধা হলে আমাকে জানাবে। আর খাওয়া-দাওয়া আমার সাথে করবে। খাওয়ার সময় আমার এখানে চলে আসবে।"

ভদ্রলোকের অমায়িক ব্যবহারে আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। বিপদে এমন বন্ধু পাওয়া ক'জনের ভাগ্যে জুটে? তাই আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে আমার কম্পার্টমেন্টের সীটে এসে বসলাম। দু'পা সামনে বাড়িয়ে দিয়ে ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম।

ফজরের ওয়াক্ত। গাড়ী আশেকাবাদ স্টেশনে এসে দাঁড়াল। টিটির কাছ থেকে জানতে পারলাম, এখানে মাল উঠানামা হবে। গাড়ী ছাড়তে দেড়-দু'ঘন্টা বিলম্ব করবে। এ সুবাদে মসজিদে গিয়ে নামায পড়ে নেয়া যায়। তাই ট্রেনে থেকে নেমে রেলওয়ে জামে মসজিদের দিকে চললাম। মসজিদে গিয়ে দু'চারজন মুসল্লী ছাড়া আর কোন লোক আশপাশে দৃষ্টিগোচর হল না। ইমাম-মুয়াজ্জিনেরও কোন হদিস নেই।

আযান হয়েছে কিনা, এক মুসল্লীকে জিজ্ঞেস করায় তিনি চুপি চুপি বললেন, "আজ দু'দিন হল এ মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে কমিউনিস্টরা মসজিদের ভেতরেই শহীদ করে দিয়েছে। ঘাতকরা লেনিনের প্রাইভেট গুন্ডাবাহিনী।

শহীদের তাজা খুনে এখনো মসজিদ সিক্ত। আজান, ইকামত, জামাত সবই বন্ধ হয়ে গেছে। মুসল্লীরাও আসে না। অগত্যা আমি নিজেই আযান দিয়ে বারান্দায় সুন্নত পড়তে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার দেখাদেখি আরো তিন-চারজন মুসল্লী এলো। তারপর জামাতের সাথেই দু'রাকাত ফরয আদায় করলাম।

মোনাজাত সেরে মসজিদের গেটে আসার সাথে সাথে গোঁফওয়ালা এক যুবক চোখ দু'টো কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, "আযান কে দিয়েছে? নামায কে পড়াচ্ছে? কার এতবড় বুকের পাটা? কে সে ব্যক্তি? মাত্র দু'দিন হল এ মসজিদ থেকে দু'জন মৌলবাদী রূহানী শয়তানকে পশুর মত জবাই করে বেহুদা কাজ থেকে ঘরটি মুক্ত করেছি। আবার কোথেকে অবাঞ্ছিত হতভাগা এসে উচ্চস্বরে আযান নামক শব্দগুলো শুনাল? সে কি জানে না, দু'দিন পর মসজিদ নামক ঘরটিকে আমরা ক্লাব বানাব! এখানে আমোদ-প্রমোদ হবে, এখানে চলবে নাচ-গান, বসবে পানশালা ও মদের আসর।"

যুবকের অকথ্য বকাবকি আমার বুকে অস্থিরতার অনল প্রজ্বলিত করে দিল। নির্বাক আননে বিষবাক্য এনে দিল। ঘুমন্ত সিংহ শাবকের গায় অসির খোঁচা হানল। আগপাছ চিন্তা করার সামান্যতম ফুরসত না পেয়ে আমি ব্যাঘ্রের হুংকার ছেড়ে বললাম, “হে পাপিষ্ঠ নরাধম! আমাদের পবিত্র মসজিদ শহীদের খুনে লাল করে দিয়ে ক্লাব আর মদ্যশালায় রূপান্তরিত করবে? নর্তকীদের আড্ডাখানা বানাবে? মদপান করে নাচ-গান করবে? আর মুসলমানরা শুধু গ্যালারীর দর্শক সেজে নীরবে সয়ে যাবে? তা কখনো সম্ভব নয়।"

কথাগুলো বলতে না বলতে আমার উপর নেমে এল কমিউনিস্ট হায়েনাদের অসহনীয় নির্যাতন। মুহূর্তের মধ্যে আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে শায়িত। কে বা কারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, তা জানি না। আমার পাশে ডাক্তার ও কয়েকজন লোক দাঁড়ান। রক্তে জামা- কাপড় ভিজে আছে। মাথায় ও হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কে যেন হাত দিয়ে তুলির সাহায্যে রক্তগুলো মুছে দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখি ট্রেনের সেই ভদ্রলোক। একটু পরে কয়েকজন ধরাধরি করে আমাকে নিয়ে গেল ট্রেনে। শুইয়ে দিল ঐ ভদ্রলোকটির সীটে। তিনি আমার একপাশে বসে জামাত সবই বন্ধ হয়ে গেছে। মুসল্লীরাও আসে না। অগত্যা আমি নিজেই আযান দিয়ে বারান্দায় সুন্নত পড়তে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার দেখাদেখি আরো তিন-চারজন মুসল্লী এলো। তারপর জামাতের সাথেই দু'রাকাত ফরয আদায় করলাম।

মোনাজাত সেরে মসজিদের গেটে আসার সাথে সাথে গোঁফওয়ালা এক যুবক চোখ দু'টো কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, "আযান কে দিয়েছে? নামায কে পড়াচ্ছে? কার এতবড় বুকের পাটা? কে সে ব্যক্তি? মাত্র দু'দিন হল এ মসজিদ থেকে দু'জন মৌলবাদী রূহানী শয়তানকে পশুর মত জবাই করে বেহুদা কাজ থেকে ঘরটি মুক্ত করেছি। আবার কোথেকে অবাঞ্ছিত হতভাগা এসে উচ্চস্বরে আযান নামক শব্দগুলো শুনাল? সে কি জানে না, দু'দিন পর মসজিদ নামক ঘরটিকে আমরা ক্লাব বানাব! এখানে আমোদ-প্রমোদ হবে, এখানে চলবে নাচ-গান, বসবে পানশালা ও মদের আসর।"

যুবকের অকথ্য বকাবকি আমার বুকে অস্থিরতার অনল প্রজ্বলিত করে দিল। নির্বাক আননে বিষবাক্য এনে দিল। ঘুমন্ত সিংহ শাবকের গায় অসির খোঁচা হানল। আগপাছ চিন্তা করার সামান্যতম ফুরসত না পেয়ে আমি ব্যাঘ্রের হুংকার ছেড়ে বললাম, “হে পাপিষ্ঠ নরাধম! আমাদের পবিত্র মসজিদ শহীদের খুনে লাল করে দিয়ে ক্লাব আর মদ্যশালায় রূপান্তরিত করবে? নর্তকীদের আড্ডাখানা বানাবে? মদপান করে নাচ-গান করবে? আর মুসলমানরা শুধু গ্যালারীর দর্শক সেজে নীরবে সয়ে যাবে? তা কখনো সম্ভব নয়।"

কথাগুলো বলতে না বলতে আমার উপর নেমে এল কমিউনিস্ট হায়েনাদের অসহনীয় নির্যাতন। মুহূর্তের মধ্যে আমি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম। সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে দেখি আমি হাসপাতালের বেডে শায়িত। কে বা কারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, তা জানি না। আমার পাশে ডাক্তার ও কয়েকজন লোক দাঁড়ান। রক্তে জামা- কাপড় ভিজে আছে। মাথায় ও হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। কে যেন হাত দিয়ে তুলির সাহায্যে রক্তগুলো মুছে দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখি ট্রেনের সেই ভদ্রলোক। একটু পরে কয়েকজন ধরাধরি করে আমাকে নিয়ে গেল ট্রেনে। শুইয়ে দিল ঐ ভদ্রলোকটির সীটে। তিনি আমার একপাশে বসে

থেকে নামিয়ে টাঙ্গায় নিয়ে গেলাম। টাঙ্গা ছুটছে ঠক্ ঠক্ ঠক্। বহুদিন পর বাড়ী যাচ্ছি। এক অনাবিল শান্তিতে হৃদয় পুলকিত। আম্মু হয়ত আমার আগমনের পথপানে চেয়ে আছেন। হয়ত অনেক জিনিস নিজে না খেয়ে আমার জন্য যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। হয়ত আমাকে দেখার অভিলাসে প্রহরের পর প্রহর অঘুম নয়নে এন্তেজার করছেন। দেশের নাজুক পরিস্থিতির কারণে হয়ত জায়নামাযে বসে দোআ করছেন।

আমি এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে বাড়ীর নিকট এসে গেলাম, তা ভাবতেও পারিনি। টাঙ্গাওয়ালা বললেন, "বাবা! তুমি বাড়ী এসে গেছ, জলদী নাম।" একা একা খুব কষ্ট অনুভব করছিলাম। তাই টাঙ্গাওয়ালা আমার লাগেজপত্র বাড়ীতে পৌছিয়ে দিল। আমি বাড়ীতে প্রবেশ করলাম। আমার সালামের শব্দ শুনে আম্মু একরকম দৌড়ে কাছে এলেন। রক্তমাখা কাপড়-চোপড় আর মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। আমি আম্মুকে অনেক বুঝিয়ে সান্ত্বনা দিলাম ও ধৈর্যধারণ করতে বললাম। আম্মু আমাকে আলতোভাবে তার নরম বিছানায় শুইয়ে দিলেন।

আম্মু এক এক করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জানতে চাইলেন। আমিও শান্তভাবে আমার অবস্থা, মাদ্রাসার হালত ও তাসখন্দ, সমরকন্দ, বুখারা, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির বর্ণনা করলাম। আমিই মায়ের একমাত্র আদরের সন্তান। আমার এক ভাই এক বোন পাঁচ বছর আগে মারা যায়। 

এখন আমিই বাবা-মায়ের একমাত্র সম্পদ, একমাত্র স্বপ্ন। তাই আমিই তাদের সবগুলো ভালবাসার একচ্ছত্র উত্তরাধিকারী। এ ভালবাসার মধ্যে অন্য কোন শরীক নেই। দুঃখ-কষ্ট কি জিনিস, তা অনুভব করার সুযোগ আমার হয়নি কোনদিন। 


[তিন]

দাদা আমীরজান বাগদাদী ছিলেন সে যুগের বড় আলেম। তিনি বাগদাদের ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসায়ে নেজামিয়ায় অধ্যয়ন করেন। তিনি কয়েকটি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। পবিত্র কুরআন-হাদীস ছাড়াও এলমে ফেকাহ, এল্মে মান্তেক, এল্মে ফাছাহাত, এলমে বালাগাত ও এলমে তাসাউফে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তিনি বহুদিন


চলবে......................


"২য় পর্ব দেখতে এখানে চাপুন"


▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️▶️

Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp