এক অন্ধ ভক্ত মুরিদের অন্ধ ভক্তী |
ভক্তি যেখানে অন্ধ
আবু তাহের বর্ধমানী
পীরপরস্তি এমন এক মারাত্মক ব্যাধি, যা মানুষকে একেবারে অন্ধ করে দেয়। কয়েক বছর আগের কথা বলছি, তখন আমি কলকাতায় মাসিক তওহীদের সম্পাদনার কাজে লিপ্ত ছিলাম। একদিন এক ব্যবসায়িক হাজী সাহেব মাগরিবের নামাযের পর আমাকে বললেন, আজ এক কাণ্ড ঘটে গেছে, দাদ ভাল করতে যেয়ে কুষ্ঠব্যাধি হয়ে গেছে।
আমি বললাম, কি ব্যাপার; বললেন, এক ফকীর 'দে বাবা খাজা দে দেলাদে- দে বাবা খাজা দে দেলাদে' বলে চিৎকার করতে করতে এসে আমার সামনে দাঁড়ালো, আমি জোরসে এক ধমক দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিলাম। খানিকটা যেই গেছে, আবার তাকে ডাক দিলাম- একটু বুঝিয়ে বলব বলে।
ফকির ঘুরে এল। তার হাতে একটা টাকা দিয়ে বললাম, ঐ মালাবা হোটেলে গোশত রুটি কিনে খাস। আর খবরদার, খাজা বাবার কাছে কিছু চাস্ না, খাজা বাবার কিছুই দিবার ক্ষমতা নেই। আল্লাহর কাছে চাইবি- আল্লাহই দেনেওয়ালা। ফকির টাকাটা হাতে পেয়ে বলছে, 'বাহরে খাজা বাহ্, দুশমন সে ভী তু দেলাতা হ্যায়? দে বাবা খাজা দে-দেলাদে।' বলতে বলতে ফকীর চলে গেল। আমি বললাম, হাজী সাহেব! ভক্তি যেখানে অন্ধ, প্রমাণ সেখানে অচল। অন্ধ ভক্তের কাছে কুরআনে দলীল, বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনু মাজাহ প্রভৃতি হাদীসের দলীল অচল।
এ প্রসঙ্গে আর এক ঘটনা শুনুন। অনেকদিন আগের ঘটনা। এক পীর সাহেব তাঁর এক শিষ্যকে বললেন- বাবা সহীরুদ্দীন! আমার গাইটা তাল পুকুরের পারে চরছে, সন্ধ্যার সময় নিয়ে এসে গোয়ালে বেঁধে দিসতো বাবা।
সহীরুদ্দীন বলল হুজুর, আপনি গাই একটা কিনেছেন শুনেছি কিন্তু চোখে এখনো দেখিনি। পীর সাহেব বললন, গাই বেশ মোটাসোটা, রং সাদা আর শিং দু'টো ছোট ছোট। একথা শুনে ঠিক সন্ধ্যার সময় সহীরুদ্দীন তাল পুকুরের পার থেকে গাই এনে পীর সাহেবের গোয়ালে বেঁধে দিল।
আর ভালভাবে খল-ভূষী খেতে দিয়ে গোয়ালের দরজা বন্ধ করে দিল। সকাল বেলায় পীর সাহেবের স্ত্রী গোয়াল ঘরে যেয়ে দেখে, খুব বড় তাড়া এক ষাঁড় বাঁধা রয়েছে। পীর সাহেবের স্ত্রী তো কেঁদেই আকুল। পীর সাহেবও বিচলিত হয়ে সহীরুদ্দীনের কাছে যেয়ে বললেন, বাবা সহীর আমার গাই কই? দুধ না হলে আমার চলে না।
সম্মানিত পাঠক! লিখাগুলো আমরা অনেক পরিশ্রম করে যত্নের সাথে লিখি। এর জন্য বিনিময় চাইনা। শুধুমাত্র ছবিগুলোতে একবার ক্লিক দিন। |
তোর পীর মায়েরও চলে না- তাই চার সের দুধের গাই কিনে এনেছি, সেই গাই আমার কোথায় দিলি বাবা? সহীর বলল হুজুর, আপনার আদেশ শিরোধার্য করে সন্ধ্যার সময় গাই এনে গোয়ালে বেঁধে দিয়েছি। শুধু তাই নয়, ভালভাবে খল-ভুষা খেতে দিয়েছি।
পীর সাহেব বললেন, গরুতো একটা বাঁধা রয়েছে রে বাবা, কিন্তু ওটা তো আমার গাই নয়, একটা ষাঁড় বাঁধা রয়েছে। আমার গাই কোথায় গেল? সহীর বলল হুজুর! আপনাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম, গাইটা কেমন? আপনি বললেন, বেশ মোটাসোটা, রং সাদা আর শিং দু'টো ছোট ছোটও বটে- অমনি আপনার গাই হাঁকিয়ে নিয়ে এসে আপনার গোয়ালে বেঁধে দিলাম।
পীর সাহেব বললেন, একটু পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলি না কেন? সহীর বলল, দেখতে তো বলেননি হুজুর, বললে নিশ্চয়ই দেখতাম। আপনি সব সময় আমাদেরকে বলেন, আমি যা বলব তাই শুনবি, এর বাইরে একচুল যাবি না। তাহলে কেমন করে আপনার কথার বাইরে যেতে পারি হুজুর বলুন।
বলাবাহুল্য, একেই বলে অন্ধভক্তি। এই অন্ধভক্তি পীর পূজকদেরকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তারা পীর ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। তারা মনে করে পীর মুক্ত, পীর সর্বস্তরে বিরাজিত, পীর সবকিছুই জানেন। পীরের মূর্তি মনের মাঝে এঁকে নিয়ে ধ্যান করলে, সেই মূর্তির মাঝে পীরের রূহ এসে তার মনে ফয়েজ বা প্রেরণা যোগায়। এই বিশ্বাসে পীর পূজকরা পীরের মূর্তি মানসপটে এঁকে নিয়ে পীরের ধ্যানে মশগুল থাকে।
শুধু পীর পূজকদের দু'চারটা ওযীফা এখানে পাঠকদেরকে উপহার দিচ্ছি। লালনের ভক্তরা বলে-লালনের মত কামেল পীর ত্রিভুবনে নাই অতএব লালনের সবে তরীক ধর ভাই।
এনায়েতপুরের ভক্তরা চোখ বন্ধ করে মাথা হিলিয়ে হিলিয়ে ওযীফা পাঠ করে-
যত নবী ওলী সব হবে মালগাড়ী আর ইঞ্জিন হয়ে নিয়ে যাবে এনায়েতপুরী
ভাসানী সাহেবের অন্ধভক্তদের ওযীফা শুনুন।
দয়াল ভাসানী, দয়াল ভাসানী
তোমার ঘাটে এলাম আমি, পার করে নাও।
দয়াল ভাসানী
তোমার হালে হাল ধরেছি, পার করে নাও।
কি যে দয়াল তুমি, বুঝেও বুঝি না আমি।
তোমার দয়ায়, তোমার দু'আয়
ভাসিছে মোর জীবন তরী
এক ওসীলায় আমায় তুমি পার করে নাও।
দয়াল রে-
তুমি যে কি যাদু জানো, হৃদয় ধরে টানো
ওগো দয়াল, ওগো নিঠুর ভাসানী
তুমিই আমার খাজা, তুমিই আমার রাজা
আমায় খাস প্রজা করে নাও।
(হক কথা ২১/৩/৮৩)
আর একদল ঢোলে তালি মেরে মেরে ঘাড় হিলিয়ে হিলিয়ে কি ওযীফা পাঠ করে শুনুন-
এমদাদ কুন এমদাদ কুন আয বান্দেগম আযাদ কুন দরূদীন ও দুনিয়া শাদ কুন ইয়া শেখ আব্দুল কাদেরা।
অর্থাৎ আমাকে মদদ কর, আমাকে মদদ কর, দুঃখ দুশ্চিন্তা হতে আমাকে মুক্ত কর, দীন ও দুনিয়ায় আমাকে সুখী কর, হে শেখ আব্দুল কাদের।
আর একদলের ওযীফা শুনুন-
পুরা কর তু আরজু মেরী
আয় বাবা খাজা আজমিরী
আয় বাবা খাজা আজমিরী।
সম্মানিত পাঠক! লিখাগুলো আমরা অনেক পরিশ্রম করে যত্নের সাথে লিখি। এর জন্য বিনিময় চাইনা। শুধুমাত্র ছবিগুলোতে একবার ক্লিক দিন। |
তারা আরও বলে থাকে-
মদদ কুন ইয়া মঈনুদ্দীন চিশতি মদদ কুন ইয়া মঈনুদ্দীন চিশতি।
তারা খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রহমাতুল্লাহ আলাইহি নিরানব্বইটা নাম তৈরী করে নিয়ে নিয়মিতভাবে সেই নামের ওযীফা পাঠ করে থাকে।
সে নামগুলি হচ্ছে এই-
আউয়ালো ইয়া মঈনুদ্দীন, আখেরো ইয়া মঈনুদ্দীন, জাহেরো ইয়া মঈনুদ্দীন, বাতেনো ইয়া মঈনুদ্দীন, জাব্বারো ইয়া মঈনুদ্দীন, গাফফারো ইয়া মঈনুদ্দীন, সাত্তারো ইয়া মঈনুদ্দীন, কুদ্দুসো ঈয়া মঈনুদ্দীন, রাহমানু ইয়া মঈনুদ্দীন ইত্যাদি। অর্থাৎ আল্লাহ রব্বুল আলামীনের যে নিরানব্বইটা গুণবাচক নাম রয়েছে, ঐ নামগুলি সব খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির নামে লাগিয়ে দিয়ে মঈনুদ্দীন চিশতিকে আল্লাহর আসনে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
আরো পড়ুনঃ- চালাক পীর ও তাদের আউট নলেজ। আবু তাহের বর্ধমানী
এ ধরনের বহু কথা রয়েছে। বইয়ের কলেবর বেড়ে যাওয়ার ভয়ে ক্ষান্ত হলাম। শির্ক আর কাকে বলে; এরূপ আকিদার নামই শির্ক। যারা মানুষ হয়ে মানুষকে আল্লাহর আসনে বসায়; যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথার উপর অপরের কথাকে গুরুত্ব দেয়, মুশরিক তারাই। কবি বলেন:
খোদাসে আওর বুজুরগুঁ সে ভী কহনা এহী হ্যায় শেরক্ ইয়ারো ইসে বাচ্চা খোদা ফরমা চুকা কুরআন কে আনদর মেরে মুহতাজ হ্যায় পীর ও পয়গম্বর নেহী তাকত সেওয়া মেরে কিসীমে জো কাম আয়ে তুম্হারী বেকাসী মে জো মুহতাজ হো বে দুদ্রে কা ভালা উল্সে মদদ কা মানা কিয়া?
আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই অন্ধত্ব থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করুন এই প্রার্থনা করি।
0 Comments