পর্ব-৫
▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-২
▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৩
▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৪
🔷 আরেকটা জখম 🔷
আমার সবচেয়ে ছোট ভাই ফিরোজ প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছে তিন মাস হলো। এই তিন মাসে সে কয়েকটি অপারেশনেও অংশ নিয়েছে। সরকার তাকে গ্রেফতার করার জন্য জোর তৎপরতা শুরু করে। বেশ কবার ফোর্সকে ফাঁকি দিয়ে সে গ্রেফতার এড়াতেও সক্ষম হয়। অবশেষে দুর্ভাগ্যবশত একদিন রোজবড়শাহ পুলের কাছে তাকে গ্রেফতার করা হয়।
সকালে ফিরোজ গ্রেফতার হয় আর সন্ধ্যায় একই সময় আলুচাবাগ ও নটিপুরার বাড়িতে হানা হয়। ফিরোজের অস্ত্র তুলে দেওয়ার নাম করে ফোর্স ঘরের একে একে প্রত্যেকে রক্তাক্ত করে।
ফিরোজের গ্রেফতারের সংবাদ পাওয়ামাত্র তার সমুদয় ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। ফোর্স যখন আমাদের কাছে কোনো অস্ত্র পেল না, তখন তারা আমার ভাই শাকিলকে আব্বা-আম্মার চোখের সামনে এমন পেটাল যে, তার উভয় বাহু জোড়া থেকে আলাদা হয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখে আমার মা হাউমাউ করে জান্না জুড়ে দেন। সে এক হৃদয়বিদারক ও অসহনীয় দৃশ্য।
মা কাঁদছিলেন আর আমি তাকে কাঁদতে বারণ করছিলাম। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, যে ছেলেটির উপর এমন নির্যাতন চলছে, তিনি তার জন্মদায়িনী মা। আমি মাকে বলছিলাম, মা জিহাদে কাঁদতে নেই। কান্নাকাটি করলে মানুষের মধ্যে দুর্বলতা আসে। মা আমার প্রতি এমনভাবে তাকালেন, যেন আমাকে বলছিলেন- কেন, তুমি কি শাকিলের বোন নও? এসব তুমি কী বলছে? আমার নিজের কাছেও অবাক লাগছিল যে, এমন ভয়ানক ও নির্মম দৃশ্য দেখার পরও আমার চোখে পানি এল না কেন? আমি কি পাষাণ, নাকি এ আমার ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা! যে-সময় শাকিলকে পিতামাতা ও দু-বোনের সামনে পাষাণ ভারতীয় সৈন্যরা পদতলে পিষ্ট করছিল, তার হাড়গোড় ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করছিল,
ঠিক তখন ফিরোজ সরকারের নির্যাতন সেন্টারে তার চেয়েও নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়ে আর্তচিৎকার করছিল।
আমার এক ভাই জেলখানায়, এক ভাই ইন্টারোগেশন সেন্টারে আর তৃতীয় ভাই আমাদেরই সামনে নির্মমতা সহ্য করছে! আমরা তাকে রক্ষা করতে চাইছি বটে; কিন্তু আমাদের এতটুকু নড়াচড়া করার অধিকারও নেই। অবশেষে সৈন্যরা শাকিলকে টেনে-হেঁচড়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়। এখন ঘরে আব্বাজান ছাড়া আর কোনো পুরুষ নেই। শাকিলকে নিয়ে যাওয়ার পর আমাদের ঘরের অবস্থা এমন থমথমে রূপ ধারণ করে, যেন ঘরে কেউ মারা গেছে আর এইমাত্র তার লাশ দাফন করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবাই একটি কক্ষে বসে নিঃশব্দে হাহুতাশ করছে শুধু। তখন ভয়ে পাড়া-প্রতিবেশীর কেউ আমাদের খবরও নিতে আসছে না।
সারাটা রাত আমরা না খেয়ে, না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিই। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না। শাকিলের সঙ্গে হায়েনাদের আচরণের কথা স্মরণ করে সবাই আফসোস করছিলাম শুধু। আমার গ্রেফতারির কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু গ্রেফতারকৃত যুবকদের কাশ্মিরি মুসলমান ও পাকিস্তানের সমর্থক মনে করে তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা দেখলে হিংস্র পশুরা পর্যন্ত আঁৎকে উঠবে। ভয়টা হলো এখানে।
পরদিন সকালে প্রতিবেশী, মহল্লাবাসী ও আত্মীয়-স্বজনদের আসা- যাওয়া শুরু হয়। এক পরিবারের তিন ছেলে এক জামাতা শত্রুর হাতে বন্দী! এ এক দুঃসহ ও যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা। আমার খালা ও মামা এর দোষ আমার উপর চাপাতে চেষ্টা করে। কিন্তু এবার অন্য কেউ এরূপ কথা বলতে সাহস দেখায়নি। কারণ, তার জবাব আগেই জাফর আহমাদের গ্রেফতারির সময় আমার পক্ষ থেকে তারা পেয়েছিল। ভাগ্যক্রমে কেউ আমার সেই জবাবের কথা ভুলেছি।
জামাতার পরে পুত্র ফিরোজ ও শাকিলের গ্রেফতারিতে আমার পিতা বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তিনি এই বলে নিজেও কারাবরণ করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন যে, আমি এখন আর বেঁচে থাকব কার জন্য...?
তিনি ঘরে উপস্থিত লোকদের উদ্দেশে বললেন "আমাদের এখন আর আছে কী? এই জীবন থেকে মৃত্যুই ভালো। এখন আমিও জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমার কলিজার টুকরোরা যে-পথের পথিক হয়েছে, আমিও সেপথ অবলম্বন করব। আল্লাহ যা ইচ্ছে করেন, তা-ই হবে। এখন একা আমি-ই নই, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেরই অস্ত্র হাতে তুলে নিতে হবে। মানুষের জীবন-মৃত্যু সবই আল্লাহর হাতে। আমাদের মনে রাখতে হবে, জুলুম করা যেমন অন্যায়, জুলুম সহ্য করাও তেমনি অপরাধ। কাজেই আমাদের বাঁচবার পথ খুঁজে বের করতে হবে।"
আব্বাজানের এ বক্তব্যে আমার হিম্মত বহুগুণ বেড়ে যায়। অথচ ইতিপূর্বে উল্টো আমি তাকে সাহাস জোগাতাম।
শাকিল আহমাদ মুজাহিদ ছিল না। তাকে তুলে নেওয়া হয়েছে ফিরোজ আহমদের অস্ত্রের পরিবর্তে। আর ঘরে তল্লাশি চালিয়ে কোনো অস্ত্র বা আপত্তিজনক কিছু পাওয়া যায়নি। তাই আমাদের আশা ছিল, শাকিলকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তা হলো না। সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমরা তার মুক্তির জন্য চেষ্টা-তদবির শুরু করে দিলাম।
আমি যখন আলুচাবাগ থেকে বামনা ফিরে আসি, তখন এখানেও বিভিন্ন স্তরের মানুষ আমাকে সান্ত্বনা দিতে আসে। এ সুযোগে আমি তাদের বললাম- "এখনও কিছুই হয়নি। আমাদের এর চেয়েও কঠিন পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা দরকার। আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জালেম ও প্রতারক দুশমন রাষ্ট্রের মোকাবেলা করছি। আমরা বৃহৎ একটা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করছি। আমাদের আরও অনেক কিছু দেখার বাকি আছে।
ভারতের গোলামি থেকে মুক্তি লাভের জন্য যেসব কুরবানির প্রয়োজন, তার জন্য আমাদের প্রত্যেককে এখন থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। আজ আমাদের পরিবারের সঙ্গে যা কিছু হচ্ছে, আগামীতে আপনারা এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতির শিকার হবেন। আপনাদের স্মরণ করতে হবে, এখানে খুন- খারাবি ছাড়াও লুটতরাজের বাজারও সরগরম হবে।
এখানে রক্তের বন্যা বইবে। বাড়িঘর ধ্বংস হবে। নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হবে। তবে সফলতা আমাদেরই পদচুম্বন করবে। আমরা ইনশাআল্লাহ আমাদের এই মহান লক্ষ্যে অবশ্যই কামিয়াব হব। ইতিহাস সাক্ষী, চূড়ান্ত বিজয় সবসময় সত্যেরই হয়। আমরা মৃত্যুর জন্য লড়াই করছি। কাজেই বিজয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। দুশমন তাদের সব প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে অত্যাচারের পথ বেছে নিয়েছে। জুলুমের এই নৌকা ডোবাতেই হবে। আমরা ভারতের মাথায় অপমানের তিলক এঁটে দেওয়ার কসম খেয়েছি। সেই শপথ আপনাদেরও নিতে হবে। এখানকার প্রতিটি মানুষকে চাই সে পুরুষ হোক বা নারী, শিশু হোক বা বৃদ্ধ অস্ত্র হাতে জিহাদের ময়দানে অবতীর্ণ হতেই হবে। দুশমনকে এমন শিক্ষা দিতে হবে, যা সব অত্যাচারী শাসকের জন্য দৃষ্টান্তমূলক উপাখ্যানে পরিণত হয়।"
বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪
🌹 ধন্যবাদ 🌹
শাকিল আহমাদের মুক্তির জন্য আমরা কাসেম খা'র সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি বিশ হাজার টাকা অগ্রিম নিয়ে নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজ কিছুই করলেন না। হেলাল আহমাদ বেগ যখন জানতে পারে, আমরা শাকিলের মুক্তির জন্য চেষ্টা করছি, তখন সে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে তাকে মুক্ত করে আনে। এই পঁচিশ হাজার টাকা নাজির আহমাদ সিদ্দিকীর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ঊর্ধ্বতন অফিসার পর্যন্ত পৌছিয়ে দেওয়া হয়। কোম্পানির অফিসার এই টাকার বিনিময়ে শাকিল আহমাদের মুক্তিকে সম্ভব বানিয়ে দেন।
নাজির সিদ্দিকীর আর্মি, বিএসএফ ও সিআরপিএফ-এর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তিনি ফৌজ ও ফোর্সের এই তিন শাখার কমিশন এজেন্ট ছিলেন। এই সিদ্দিকীর মাধ্যমে আমরা টাকার বিনিময়ে কয়েকশ' মুজাহিদকে মুক্ত করিয়েছি। আমার পুত্র মুদ্দাসসিরকে এই নাজির সিদ্দিকীই পনেরো হাজার টাকার বিনিময়ে মাত্র তিন দিনে মুক্ত করে ঘরে পৌছিয়ে দিয়েছিলেন।
নাহিদা সোজ-এর অপহরণ
শাকীল আহমাদ বেগের মুক্তিলাভের কিছুদিন পর ন্যাশনাল কনফারেন্সের পার্লামেন্ট সদস্য সাইফুদ্দীন সোজ-এর কন্যা নাহিদা সোজের অপহরণের ঘটনা ঘটে। নাহিদা সোজ হলো দ্বিতীয় মেয়ে, যাকে আযাদি আন্দোলনের অংশ হিসেবে অপহরণ করা হলো। তার আগে অপহরণ করা হয়েছিল ভারত সরকারের হোম মিনিস্টার মুফতী সাঈদের কন্যা রাবেয়াকে। রাবেয়াকে অপহরণ করেছিল লিবারেশন ফ্রন্ট। ইখওয়ানুল মুসলিমীন নাহিদা সোজের অপহরণের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নেয় এবং কয়েকজন বন্দী মুজাহিদের মুক্তির দাবি জানায়। এ দায়িত্ব স্বীকারের সংবাদ আমাকে বিচলিত ও সতর্ক করে তোলে।
ইখওয়ানুল মুসলিমীন যদি কোনো পুরুষকে অপহরণ করত, তাহলে আমাকে এত ভাবনায় পড়তে হতো না। একটি যুবতী মেয়ের ব্যাপার। তার যথাযথ দেখাশোনা করা আমার জন্য ফরজ হয়ে দাঁড়ায়। আমি ইখওয়ানের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জিজ্ঞেস করলাম, নাহিদার দেখাশোনার জন্য তোমরা কাকে নিয়োগ করেছ? তারা আমাকে এমন চারজন মুজাহিদের নাম বলল, যাদের প্রত্যেকের উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। কিন্তু তারপরও অধিক সাবধানতার জন্য আমি আমার ছোট বোন ডেউজিকে বললাম, তুমি চব্বিশ ঘণ্টা নাহিদার দেখাশোনা করবে। কোন দিক থেকেই যেন তার কোনো অসুবিধা না হয়। তুমি সারাক্ষণ তার সাথে থাকবে, একত্রে খাবে, ঘুমাবে। এক মুহূর্তের জন্যও তুমি তার থেকে আলাদা হবে না।
আমি ডেউজিকে বিশেষভাবে বললাম, ও আমাদেরই বোন। কাজেই তার দেখাশোনা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়দায়িত্বও আমাদের পালন করতে হবে। আমার যেহেতু আরও ব্যস্ততা আছে, সেজন্য এ কাজটা আমি তোমার উপর অর্পণ করলাম। ঘটনার একটা সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তুমি সারাক্ষণ ছায়ার মতো তার সঙ্গে থাকবে। তার কখন কী প্রয়োজন হয় দেখবে, ব্যবস্থা করবে। দুঃখ-দরদ উপলব্ধি করে তার মনোরঞ্জন করবে। আমার বোন সঙ্গে-সঙ্গে প্রস্তুত হয়ে যায়। আমি একটা গাড়িতে তুলে দিয়ে তাকে গোপন ঠিকানায় রওনা করিয়ে দিই।
[এ পর্যায়ে কাহিনী লিপিবদ্ধকারী সাংবাদিক শাওকিন কাশ্মিরি ফরীদা আপাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, কিছুক্ষণের জন্য আপনি অবসর নিন। আমি ডেউজির সঙ্গে কথা বলতে চাই। ফরীদা আপা উঠে চলে গেলেন, ডেইজি এলেন। এবারের কথোপকথন ডেইজির সঙ্গে।
'আপনি কি বলতে পারেন, অপহৃতা নাহিদা সোজকে কোথায় রাখা হয়েছিল?'
'না। কারণ, জায়গাটা ছিল আমার একেবারে অপরিচিতি। শুধু এতটুকু বলতে পারি যে, শ্রীনগর থেকে সেখান পর্যন্ত পৌছতে আমার সোয়া ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়েছিল।'
'আপনি কি নাহিদাকে আগে থেকে চিনতেন?'
'না।'
'নাহিদাকে যে-ঘরে রাখা হয়েছিল, সেখানে তার সঙ্গে অন্য কেউ ছিল কি? পুরুষ বা মহিলা?' 'কামরায় সে একা ছিল। তবে এলাকার সর্বত্র মুজাহিদরা ছড়িয়ে ছিল এবং তাকে যে-ঘরে রাখা হয়েছিল, সেই ঘরে চারজন মুজাহিদ পাহারায় নিয়োজিত ছিল। ঘরে মহিলা ছিল বটে; তবে তাদেরকে নাহিদার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। আমার বোন যদি তার দেখাশোনার জন্য আমাকে না পাঠাতেন, তাহলে হয়ত সেই ঘরের কোনো মহিলা আমার স্থান দখল করে নিত। কারণ, ইখওয়ানের আমীর নাহিদার তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পুরুষের পরিবর্তে কোনো মহিলার হাতে ন্যস্ত করবেন বলে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন।'
'আপনি যখন প্রথমবারের মতো তার কাছে গেলেন, তখন ও আপনাকে কী বলল?'
'আমাকে দেখে সে আনন্দিত হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রথমে তার সন্দেহ হয়েছিল আমাকেও তার মতো অপহরণ করে আনা হয়েছে। কিন্তু যখন আমি তাকে বললাম, আমি তোমার বোন হয়ে তোমার দেখাশোনা ও সেবার জন্য এসেছি, তখন সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।' 'নাহিদা কি আপনার কাছে জানতে চেয়েছিল, আপনি কে, কোথা থেকে এসেছেন?'
'হ্যাঁ। আমি তাকে বলেছি, আমর নাম ইয়াসমীন। আমি হযরতবালের বাসিন্দা।' 'অর্থাৎ- আপনি আপনার আসল নাম-ঠিকানা বলেননি, না?'
'হ্যাঁ, তাই। আযাদির লড়াইয়ে কখনও-কখনও আসল পরিচয় গোপন করে কৌশল অবলম্বন করতে হয়।'
'নাহিদা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল না তো?'
'না; বিলকুল নয়। তার উপর আমি তাকে সাহস জোগাই এবং নিশ্চয়তা প্রদান করি, তোমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করা হবে না। আমি তাকে অনুভবই করতে দেইনি, ও অপহৃতা কিংবা তার কোনো ক্ষতি হতে পারে। ও নিজেও জানত, এসবই রাজনীতির মারপ্যাঁচ। তাছাড়া তার এই বিশ্বাস ছিল, তার পিতা তার মুক্তির জন্য সম্ভব সবকিছুই করবেন।'
'নাহিদা কি তার পিতার কাছে এমন কোনো বার্তা পাঠিয়েছিল, যাতে সে তাকে তাড়াতাড়ি মুক্ত করে নেওয়ার অনুরোধ করেছিল?'
'না, নাহিদা সরাসরি কোনো বার্তা পাঠায়নি। তবে তার পক্ষ থেকে ইখওয়ানের প্রচার শাখা সেই কাজ আঞ্জাম দিত।'
'নাহিদা আপনার সঙ্গে কত দিন ছিল?'
'বোধহয় ৯ দিন। এ সময়ে সে আমার বান্ধবীতে পরিণত হয়ে যায়। সে আমাকে তাকিদ দিয়ে বলেছিল, মুক্তি পাওয়ার পর আমি অবশ্যই যেন তাদের বাসায় বেড়াতে যাই এবং তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। আমাকে সে ফোন নম্বরও দিয়েছিল। কিন্তু আমি সৌজন্য আশ্বাস দিলেও ওয়াদা দেইনি।'
'মুক্তিলাভের পর আপনি কি কখনও তার সঙ্গে দেখা করেছেন?'
'না, আমি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইনি, তাকে আমার আসল রূপ দেখাতে চাইনি। এমনটা করলে আমি সংগঠনের শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে অপরাধী হতাম। আমার বড় বোন আমার উপর যে-দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, আমাকে সে পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা আবশ্যক ছিল। নিজের ইচ্ছায় আমি না সামনে অগ্রসর হতে পারতাম, না পেছনে সরতে পারতাম। ফরীদা আমার বড় বোন বটে; কিন্তু এই পরিচয় শুধু ঘরোয়া পরিবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আযাদির লড়াইয়ে আমি তাকে আমার কমান্ডার হিসেবে মান্য করি। সে কারণে তার নির্দেশ লংঘন করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।'
'অনেকে নারী অপহরণের বিরোধিতা করছেন, একে গর্হিত ও অন্যায় কাজ মনের করছেন। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী?'
'রাবেয়া সাঈদ, নাহিদা সোজ, ক্ষেমলতা প্রমুখের অপহরণ-ঘটনা কাশ্মিরে এ-ই প্রথম। জিহাদে সবকিছু জায়েয নয় বটে, কিন্তু পরিস্থিতি নাজায়েযকেও জায়েয বানিয়ে দেয়। মুজাহিদরাও মানুষ। ভুল-ত্রুটি তাদেরও হয়। কিন্তু আমাদের তিনটি সংগঠন দুটি যুবতী মেয়ে ও একজন বয়স্কা মহিলাকে অপহরণ করে তাদেরকে সম্মানের সাথে রেখেছিল। তাদের সযত্ন রক্ষণাবেক্ষণ করেছে এবং উপহার দিয়ে মুক্তি প্রদান করেছে। রাবেয়া সাঈদ, নাহিদা সোজ ও ক্ষেমলতা প্রমুখ যেসব মুজাহিদের তত্ত্বাবধানে ছিল, তাদের সদাচার ও উন্নত চরিত্রে তারা মুগ্ধ হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পর তারা মুজাহিদদের আচরণ ও চরিত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তার বিপরীতে ভারতীয় ফোর্স এ পর্যন্ত যত কুমারী ও বিবাহিতা মহিলাকে অপহরণ করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের সঙ্গে তারা কীরূপ আচরণ করেছে, তা কারো অজানা নয়। ভারতীয় হায়েনাদের অত্যাচারে এ পর্যন্ত বেশ কজন নারী পাগল পর্যন্ত হয়ে গেছে। আত্মহত্যা করেছে অনেকজন।'
'আচ্ছা, আপনি যান; বহেনজীকে পাঠিয়ে দিন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।' কিছুক্ষণ পর ফরীদা চা নিয়ে এলেন। এসেই বলে উঠলেন- 'নাহিদা সোজের অপহরণ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ঘরে একের পর এক হানা পড়তে শুরু করে। এই শংকা আমার আগে থেকেই ছিল। তাই আমি, মকবুল জান ও মুদ্দাসসির আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাই। ঘরে ছিল আমার মা,
ননদ নারগিস ও কন্যা সায়েমা। ইখওয়ান যখন নাহিদা সোজ-এর অপহরণের দায়িত্ব স্বীকার করে, তখন নটিপুরা ও দেলসুজ কলোনী ঘেরাও দিয়ে আমাদের বাড়িতে হানা দেওয়া হয়। বিএসএফ-এর একটি কোম্পানি ছোট ও বড় গাড়িতে করে এসেছিল। ওয়ারলেস-সজ্জিত কয়েকটি জীপ গাড়িও তাদের সঙ্গে ছিল।
এক প্লাটুন মহিলা পুলিশও ছিল। ঘেরাওয়ে বিএসএফ-এর সঙ্গে রেগুলার আর্মিও ছিল। আমাদের ঘরে ঢুকেই মহিলা পুলিশ আমার মাকে ঝাপটে ধরে। মায়ের সঙ্গে নারগিস-সায়েমাকেও মারপিট করে। তারা তাদেরকে 'বহেনজি' সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল। তারা যখন বুঝতে পারে, এবার এরা হেলাল আহমাদ বেগ বা অন্য কোনো মুজাহিদের পরিবর্তে 'বহেনজী' ধরতে এসেছে, তখন আমার মা বললেন...।'
আমি (কাহিনী লিপিবদ্ধকারী শাওকিন কাশ্মিরি) এখানে ফরীদাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এ ব্যাপারে আমি আপনার মায়ের সঙ্গে কথা বলব। আপনি আবারও বিশ্রাম নিন। বহেনজীর মা পার্শ্বেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি সঙ্গে-সঙ্গে এসে বলে উঠলেন-
তারা আমাকে জিজ্ঞেস করে, বহেনজী কোথায়?
আমি বললাম, ও এখানে নেই।
জিজ্ঞেস করে, কোথায় আছে?
বললাম, তার ভাইদের সঙ্গে দেখা করার জন্য জুধপুর গেছে। তার স্বামীও তার সঙ্গে আছে। জুধপুর থেকে মধ্যপ্রদেশ যাবে। কারণ, তার এক ভাই ও ভগ্নিপতি পৃথক দুটি জেলে বন্দী।
জিজ্ঞেস করে, আপনি তার কী হন?
বললাম, আমি তার শাশুড়ি। তার মাও এখানে নেই।
কিন্তু আমার এ জবাবে তারা আশ্বস্ত হলো না। এক অফিসার মহিলা পুলিশকে ইঙ্গিতে নির্দেশ দেয়। সঙ্গে-সঙ্গে আমার পিঠে হান্টারের আঘাত পড়তে শুরু করে। আমাকে পেটাতে দেখে নারগিস ও সায়েমা চিৎকার জুড়ে দেয়। পুলিশ তাদেরকে টেনে-হেঁচড়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আমার আশংকা হলো, দূরে সরিয়ে নিয়ে তাদেরকে আমার সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করে কিনা। তাহলে তো মুশকিল হয়ে যাবে। তাদের সত্য কথায় যখন আমার বক্তব্য মিথ্যা প্রমাণিত হবে, তখন তো আর আমার উপায় থাকবে না।'
'আপনার আশংকা কি সত্য প্রমাণিত হলো?'
'হ্যাঁ, তাদেরকে একত্রে নয়, পৃথক পৃথক জিজ্ঞাসা করে যে, বহেনজী কোথায় এবং আমি বহেনজীর কী হই?'
'তারা কী বলল?'
'ঠিক তা, যা আমি বলেছি। আমার কথাগুলো তারা মুখস্থ করে রেখেছিল এবং মনে-মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল, যদি প্রশ্নের সম্মুখীন হই, তাহলে একথা-ই বলতে হবে। অর্থাৎ- তারা বলে, আমি বহেনজীর শাশুড়ি এবং বেহনজী স্বামীর সঙ্গে জুধপুর গেছেন তার ভাইয়ের সঙ্গে জেলে দেখা করার জন্য।'
'আচ্ছা, সত্যি-সত্যি এত ছোট্ট মেয়েগুলো ফোর্সকে বোকা বানিয়ে ছাড়ল।'
'হ্যাঁ, আমাদের অবুঝ ছেলেমেয়েরা বড়দের বক্তব্য শোনার পর পরবর্তী সময়ে সেই অনুপাতে কথা বলতে বড় সেয়ানা। কারণ, তারা ভালো কইে জানে, আমরা যদি বড়দের বক্তব্য সমর্থন না করি, তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদেরও পিটুনি খেতে হবে। সেজন্য আমরা বড়রা যখন কথা বলি, তখন ঐ পিচ্চিরা এসে কান পেতে শোনে এবং হৃদয়ঙ্গম করে।'
'তারপর কী হলো?'
'তারপর তারা আমাদের ঘরে তন্ন-তন্ন করে তল্লাশি চালাল। ঘরের আসবাবপত্র তছনছ করে ফেলল। মহিলা পুলিশ দ্বারা আমার উপর এত নির্যাতন চালানো হলো যে, আমার দেহের প্রতিটি জোড়া ব্যথা হয়ে গেল।'
এত বিশাল ফৌজ ও ফোর্স ব্যর্থ হয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে চাচ্ছিল না। তাদের বহেনজীকে চা-ই চাই। অবশেষে তারা আমাকে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমার চোখে পট্টি বেঁধে একটি গাড়িতে তুলে নেয়। নারগিসকেও আমার সঙ্গে নিয়ে যায়। পাপাটু নিয়ে গিয়ে আমাকে এক অফিসারের সামনে পেশ করা হয়।
এখানে আমার চোখ খুলে দেওয়া হয়। অফিসারকে জানানো হয়, বহেনজী ওখানে নেই, আমরা তার শাশুড়িকে তুলে এনেছি। এবার শাশুড়িকে ছাড়িয়ে নিতে বহেনজীকে আমাদের হাতে ধরা দিতেই হবে। অফিসার আমাকে নীরিক্ষা করে দেখে এবং জিজ্ঞেস করে- 'তোমার বয়স কত?
আমি বললাম, ষাট বছর।
'নাহ' বলেই সে আমার মাথা থেকে ওড়নাটা সরিয়ে নেয় এবং চুলে হাত দিয়ে বলে, 'তোমার চুল তো এখনও কালো। ষাট বছর বয়সে তো মানুষের চুল পেকে যায়।'
আমি তার একথার কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।
অফিসার বলল, পরিষ্কার করে বল বহেনজী কোথায়?
বললাম, আমি পরিষ্কার করেই বলছি, আমার বউ জুধপুর গেছে।
অফিসার বলল, নাহিদা সোজ কোথায় আছে নিশ্চয়ই জান।
আমি বললাম, না, আমি তার কিছুই জানি না।
অফিসার বলল, হেলাল বেগের সঙ্গে তোমার নিশ্চয়ই দেখা হবে। নাহিদাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তাকে বলতে পারবে? একটা নির্দোষ মেয়েকে অপহরণ করা মানবতাপরিপন্থী কাজ। কোনো ধর্মই এ কাজের অনুমতি দেয় না। তুমি তাকে বিষয়টা বোঝাতে পার। এ দাযিত্বটা মাথায় নিলেই তোমাকে ছেড়ে দেব।
আমি অফিসারের এ বক্তব্যেরও কোনো জবাব দিলাম না। তারা ব্যর্থ হয়ে কিছুক্ষণ পর নারগিসের সঙ্গে আমাকে বাড়ি পৌছিয়ে দেয়। আমাদের রওনা হওয়ার সময় অফিসার সিপাহীদের বলে দেয়, 'বহেনজীর ঘরে তার যে ছোট ছেলেটা আছে, তাকে তুলে নিয়ে এসো।'
সন্ধ্যার সময় যখন আমাদের ঘরে রেখে আসা হয়, তখন সিপাহীরা সায়েমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি বহেনজীর কী হও?
সায়েমা জবাব দেয়, তিনি আমার ফুফী। আমি সুরায় থাকি। আজই এখানে এসেছি। এসে শুনলাম, ফুফীজান জুধপুর গেছেন তার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে। 'বহেনজীর ছোট ছেলেটা এখানেই আছে, না?' তারা মাসাররাতের প্রতি তাকিয়ে সায়েমাকে জিজ্ঞেস করে।
সায়েমা 'হ্যাঁ'সূচক জবাব দেয়।
পুলিশ মাসাররাতকে তুলে নিয়ে যায়। পুলিশ যখন তাকে ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তার মা প্রতিবেশীর ঘর থেকে দৃশ্যটা দেখছিলেন। মাসাররাতেরও মায়ের প্রতি চোখ পড়ে। মা তার শিশুপুত্রকে ইশারায় আল্লাহ হাফেজ বলে বিদায় দেন। মাসাররাত গ্রেফতার হওয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল। সিপাহীরা যখন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, তখনই সে বোন সায়েমাকে বলেছিল, এবার পালা আমার। আমি কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকি। সায়েমা তাকে যেতে দেয়নি। বলে, আমি একা ভয় পাব। অন্তত তুমি আমার সঙ্গে থাকো।
ঠিক এ সময় হঠাৎ করে মাসাররাত ভেতরে প্রবেশ করে। আমি (শাওকিন কাশ্মিরি) তাকে বললাম, এসো, আমার কাছে বসো। ছেলেটা আমার পাশে এসে বসলে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, সিপাহীরা যখন তোমাকে তুলে নিয়ে যায়, তখন তারা তোমার সঙ্গে কেমন আচরণ করে?
জবাবে সে বলল, রাতে আমাকে পাপাটু নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকাল-সকাল গাড়িতে বসিয়ে আমাকে রাজভুব নিয়ে গবর্নর সাকসিনার সামনে পেশ করা হয়।
গবর্নর তোমাকে কী বললেন?
সম্ভবত তিনি আমাকে ছোট্ট ছেলে মনে করে অনুমান করলেন, মারপিট করে নয়, আদর-সোহাগ দিয়েই একে ঘায়েল করতে হবে। সোহাগ পেলে আমি সব কথা বলে দেব। তিনি আমাকে বিস্কুট খেতে দিলেন এবং নরম সূরে বললেন, একটি নিরীহ নির্দোষ মেয়েকে অপহরণ করা অন্যায় কাজ। তুমি ছোট, হয়ত এ কারণে তুমি ন্যায়-অন্যায় বুঝবে না। সংক্ষেপে বোঝো, কেউ যদি তোমার বোন কিংবা মাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়, তাহলে তোমার কাছে কেমন লাগবে? খারাপ লাগবে না?
বললাম, হ্যাঁ, অনেক খারাপ লাগবে। আমি খুব কান্নাকাটি করব।
গভর্নর বললেন, নাহিদার বাপ-মা অনেক পেরেশান। তারা মেয়েকে হারিয়ে কান্নাকাটি করছে। তুমি কি জান, মেয়েটাকে কোথায় রাখা আছে?
আমি বললাম, কিছু জানি না।
গভর্নর বললেন, তুমি কি একথা বোঝ যে, ওরা একটা নিরপরাধ মেয়েকে অপহরণ করে অন্যায় করেছে?
জি, এটা তো ভারী অন্যায় কাজ।
গভর্নর বললেন, তাহলে তুমি তোমার মাকে বলো, তিনি যেন নাহিদাকে ছেড়ে দেন।
নাহিদাকে ছেড়ে দেন
আমি বললাম, কিন্তু তিনি তো এখানে নেই; আমার মামার সঙ্গে দেখা করতে বাইরে গেছেন।
গভর্নর বললেন, দেখো বাছা, মিথ্যে কথা বলো না। আমি জানি, তোমার মা এখানে এবং এই শহরেই আছেন। তুমি তার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলো- এই নাও ফোন নম্বর মিলাও।
আমি বললাম, ওখানে ফোন আছে কিনা আমার জানা নেই।
গভর্নর বললেন, কোথায়? তোমার মা যেখানে আছেন সেখানে?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
গভর্নর বললেন, কোথায় আছেন বলো।
বললাম, আমি তো আপনাকে বললামই যে, আম্মীজান মামার বাড়িতে গেছেন।
গভর্নর বললেন, দেখো, সত্য কথা না বললে কিন্তু পিটুনি খাবে। তুমি তোমার মায়ের কাছে ফোন করো। তাকে বলো, যেন হেলাল বেগের সঙ্গে কথা বলে নাহিদাকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। এটি একটি নেক কাজ। এই নেক কাজে তুমি আমাকে সাহায্য করো।
আমি বললাম, নেজ কাজে আমি আপনাকে সাহায্য অবশ্যই করব। কিন্তু আমার মা যে এখানে নেই; আপনার কথাটা আমি তাকে বলি কী করে?
গভর্নর বললেন, দেখো, সত্য কথা বললে আমি তোমাকে এখনই ছেড়ে দেব, অন্যথায় নাহিদা মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়া পাবে না। তার আমি বদলে তোমাকেই বন্দী করে রাখব। তাকে যদি খুন করা হয়, তাহলে তোমাকেও আমরা খুন করে ফেলব।
মোটকথা, কথা বের করার জন্য আমাকে সাধ্যপরিমাণ খোশামোদ করা হয়। নরম-গরম উভয় রকম আচরণ দ্বারা আমাকে ঘায়ের করার চেষ্টা করা হয়। হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু সিপাহীরা যে উদ্দেশ্যে আমাকে তুলে নিয়ে গভর্নরের সামনে পেশ করে, তা পূরণ হলো না। কিংবা বলতে পারেন, আমি তা পূরণ হতে দেইনি।
তারা সম্ভবত ভুলে গিয়েছিল, যে মহিলা সম্পর্কে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আমার শিরায় তারই রক্ত প্রবহমান। আমি সে মহিলারই গর্ভজাত। বয়সটা শুধু কম। তারা জানে না, আমি এমন এক মহিলার কোলে লালিত-পালিত হয়েছি, যিনি জীবন দিতে পারেন, শত্রুকে তথ্য দিতে পারেন না।
যাহোক, তারপর আমাকে অজ্ঞাত একস্থানে নিয়ে গিয়ে লকাপে আটকে রাখা হয়। পরদিন রাতে আমাকে পাঁচজন অফিসারের সামনে পেশ করা হয়।
তারা তোমাকে কী জিজ্ঞেস করল?'
'তারা আমাকে আমার মামার দোকানের ঠিকানা দিতে বললেন। আমি বললাম, মামার দোকান কোথায় আমি জানি না। কারণ, আমি কখনও তার দোকানে যাইনি।'
'তারা বলল, আচ্ছা, তার বাড়িটা দেখিয়ে দাও।'
'আমি বললাম, এই রাতে অন্ধকারে আমি তার বাড়ি খুঁজে পাব কোথায়?'
একথা বলামাত্র এক অফিসার আমার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেয় এবং কর্কশ কণ্ঠে বলে, 'শয়তান কোথাকার, মামার বাড়ি চিনিস না। আমাদের ধোঁকা দিচ্ছিস?'
আমি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম, 'বাড়ি তো চিনি, কিন্তু এই অন্ধকার রাতে খুঁজে বের করতে পারব না বলেছি।'
'তারা বলল, আমাদের কাছে লাইট আছে।'
'আমি বললাম, ঠিক আছে চলুন।'
তারা আমাকে বিএসএফ-এর একটি কোম্পানির সঙ্গে আলুচাবাগ রওনা করিয়ে দেয়। বিএসএফ-এর এ দলটি আমাকে নিয়ে যখন আলুচাবাগ গিয়ে পৌঁছয়, ঠিক তখনই আর্মির অপর একটি কোম্পানি আলুচাবাগে তল্লাশি চালিয়ে ফেরত যাচ্ছিল। সেনা-অফিসাররা বিএসএফ- এর সঙ্গে একটা কিশোরকে দেখে জিজ্ঞেস করে, এই ছোকড়াটাকে কোথা থেকে ধরে আনলে? নিয়ে যাচ্ছইবা কোথায়?
'তারা বলল, এটা বেগ পরিবারের সন্তান; যেনতেন বাচ্চা মনে করবেন না।'
আর্মিরা আমার মামার বাড়ি থেকে বের হলো আর বিএসএফ-এর সদস্যরা আমাকে নিয়ে প্রবেশ করল। আমি মামার ঘরটা দেখিয়ে দিলাম। তা না করে আমার উপায় ছিল না। তাছাড়া আমার প্রবল ধারণা ছিল, এ পরিস্থিতিতে মামার ঘরে কেউ নেই। আমার ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হলো। ঘরে কাউকে পাওয়া গেল না। ঘরের দরজা-জানালা ভেঙ্গে চুরমার করা হয়েছে। মূল্যবান জিনিসপত্র কিছুই নেই। সব লুট হয়ে গেছে।
বিএসএফ মামার ঘরে কাউকে না পেয়ে প্রতিবেশী লোকদের ডেকে এনে জিজ্ঞেস করল, মোহাম্মদ ইউসুফ বেগ ও তার পরিবারের অন্য সদস্যরা কোথায়? তারা অজ্ঞতা প্রকাশ করলে বিএসএফ তাদেরকে এই বলে বেদম প্রহার করল যে, তোরা সবই জানিস; কিন্তু বলচিস না। তোরাও সন্ত্রাসী। এখান থেকে কয়েকটি যুবককে নিরাপত্তা হেফাযতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফিরিয়ে এনে আমাকে পুনরায় লকাপে আটকে রাখা হয়। নাহিদা সোজ- এর মুক্তির এক দিন পর আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
মাসাররাত-এর বক্তব্য শেষ হওয়ামাত্র তার নানী অর্থাৎ ফরীদার মা বলে উঠলেন, ফরীদাকে খুঁজে বের করার জন্য ফৌজ ও ফোর্সের তিনটি শাখা তৎপরতা চালায়। জায়গায়-জায়গায় হানা দিতে থাকে ও অবরোধ করে যার-তার পরিচয়পত্র চেক করতে থাকে। তখন সরকারের টার্গেট ছিল দুটি। নাহিদা সোজ-এর নিঃশর্ত মুক্তি ও ফরীদার গ্রেফতারি। ফরীদাকে গ্রেফতার করে সরকার ইখওয়ানের কয়েকজন মুজাহিদের মুক্তি দাবি প্রত্যাহার করাতে বাধ্য করতে পারত।
কিন্তু তাতে ব্যর্থ হওয়ার পর সিআরপিএফ-এর এক অফিসার নির্দেশ দিল, বহেনজীকে পাওয়া না গেলে তার মাকে তুলে নিয়ে আসো।
সঙ্গে সঙ্গে দশ-বারটা গাড়ি ও জিপে করে সশস্ত্র বাহিনী ছুটে আসে এবং আমাকে ধরে চোখে পট্টি বেঁধে টেনে-হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। দেখে নারগিস ও সায়েমা চিৎকার জুড়ে দেয়। তাদের কান্না ও চিৎকারের শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত আমাকে ধাওয়া করতে থাকে। গাড়িতে বসিয়ে সৈন্যরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিল সে কথা আমিও জিজ্ঞেস করিনি, তারাও বলেনি। আমি মনে-মনে আল্লাহর নিকট দোয়া করতে থাকি, আল্লাহ! তুমি আমার জীবন নিয়ে যাও, দুঃখ করব না; কিন্তু আমার ইজ্জত রক্ষা করো।
কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থেমে যায়। আমাকে গাড়ি থেকে নামানো হয়। তারা আমাকে পাহাড়ি পথে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করে। আমি দুপা হাঁটছি আর পড়ে যাচ্ছি। চোখে পট্টি থাকার কারণে আমাকে নিয়ে তিরষ্কার করে। তারা বলা সত্ত্বেও আমি তাদের সহযোগিতা নিতে অস্বীকার করি। তাদের হাত ধরতেই আমি রাজি হইনি। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর তারা আমাকে সিঁড়িতে চড়িয়ে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে চোখ খুলে দিয়ে আমাকে একজন অফিসারের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। সিআরপি'র কয়েকজন অফিসারও সে সময় সেখানে উপস্থিত ছিল।
তারা আমাকে ফরীদা ও নাহিদা সোজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে এবং হুমকি প্রদান করে যে, আমি যদি সত্য কথা না বলি, তাহলে আমাকে মেরে ফেলা হবে। আমি ঘরে বসে ফোর্সকে যে কথা বলেছিলাম, এখানেও সেই একই কথা বলি। তারা আমাকে বক্তব্য পালটানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু আমি অটল থাকি। ফলে বাধ্য হয়ে তারা আমাকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে যায়।
'এই বহেনজী গেলেন কোথায়? ডাকো তো।' আমি মুদ্দাসসিরকে বললাম। মুদ্দাসসির তার মাকে ডেকে আনে। ফরীদা এসে তার অসম্পূর্ণ বক্তব্য সম্পূর্ণ করে- সেদিন গভীর রাতে মা আমার কাছে এসে বললেন, তখন তার চেহারায় চরম বিষণ্ণতা ও চোখে অশ্রু টলমল করছিল। আমি তাকে বললাম, মা! আপনি যদি বলেন, তাহলে আমি নিজে ধরা দিয়ে মাসাররাতকে ছাড়িয়ে আনি। মা বললেন, না, এটা হতে পারে না। তুমি ধরা দেবে, আমি তা মেনে নেই কী করে!
আমি বললাম, তাহলে আপনার চোখে পনি কেন? এটা তো ভীরুতার আলামত। অথচ আমাদের সর্বাবস্থায়ই সাহস রাখতে হবে। আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিচ্ছি, আমার মাসুম ছেলের কোনো অসুবিধা হবে না। দেখবেন, ও নিরাপদেই ফিরে এসেছে।
আমি মুখে তো এসব বললাম, কিন্তু ভেতর থেকে কলিজাটা চুরচুর হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমি মাকে অনুভব করতে দেইনি, আমার মনেও অস্থিরতা কাজ করছে।
পরদিন সকাল-সকাল আমি হেলাল বেগের সঙ্গে দেখা করতে রওনা হই। আমি তাকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে অবহিত করি। মা ও নারগিসের গ্রেফতারির পর মাসাররাতের নিরাপত্তা হেফাযতে নিয়ে যাওয়ার
ঘটনাও শোনাই। হেলাল অত্যন্ত দুঃখিত হয়। আমি তার ভাবান্তর দেখে বললাম-
দেখো, এমন মনে করো না যে, আমি তোমার কাছে আমার নিরপরাধ পুত্রের গ্রেফতারির অভিযোগ নিয়ে এসেছি। মনে রেখো, প্রিয় মাতৃভূমির আযাদির স্বার্থে আমার চোখের সামনে যদি আমার কলিজার টুকরাকে খণ্ড- বিখণ্ডও করে ফেলা হয়, তবুও আমি ভেঙ্গে যাওয়ার নই। এ যাবত আমার যেসব পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে, তা আমাকে লোহায় পরিণত করে দিয়েছে। আমি তোমাকে যেকথাটা বলতে এসেছি, তাহলো, আমার মাসারাত অনেক কিছুই জানে। শিশু শরীর হয়ত বেশি টর্চার সহ্য করতে পারবে না। কাজেই তুমি ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলো। তোমাকে কোনো অবস্থাতেই জালেমদের হাতে ধরা দেওয়া যাবে না। অন্যথায় তা হবে আযাদি আন্দোলনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কাজেই আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। তোমার এখানে আসবার আগে আমি আরও কয়েকটি পয়েন্টে সতর্ক করে এসেছি।
হেলাল আমার পরামর্শ মেনে নেয় এবং বলে, মুদ্দাসসিরকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। নাহিদা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাকে আমি আমার সঙ্গে রাখব।
নাহিদার মুক্তির ডিমান্ডে যে মুজাহিদদের মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল, তাদের মধ্যে বেলার ছিল অন্যতম। কিন্তু বেলালের পরিবর্তে অপর দুটি ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হলো। নাহিদার বিনিময়ে মোট পাঁচজন মুজাহিদকে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব হয়।
আমার বোন ডেউজির ধারণা ছিল, ডিমান্ড অনুযায়ী ভাই বেলালও মুক্তি পেয়েছে। সে অস্থিরচিত্তে বেলালের সঙ্গে দেখা করার আশা নিয়ে আমার বাড়িতে ছুটে আসে। কিন্তু এসে বেলালকে না পেয়ে সে অত্যন্ত ব্যথিত হয়। তদুপরি যখন জানতে পারে, নাহিদার পরিবর্তে মাসাররাতকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তখন সে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললাম, যে যুবকরা মুক্তি পেয়েছে, তারাও তো আমাদের ভাই। তুমি তাদেরই বেলাল মনে করো। আর মাসাররাতের ঘটনা তো আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়। তবে আমি নিশ্চিত, তাকেও ছেড়ে দেওয়া হবে।
নাহিদা সোজ-এর মুক্তির এক দিন পর আমার দশ বছর বয়সের ছেলে মাসাররাতকেও ছেড়ে দেওয়া হলো।
পর্ব-৬ এখানে........
🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹
🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹
🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹🌹
0 Comments