Header Ads Widget

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৪



▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-২ 

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৩ 


 আমার ভগ্নিপতির গ্রেফতারি

কিছুদিন পর পুলিশ আমার ভগ্নিপতি পীর জাফর আহমাদকেও মুজাহিদ ভেবে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমাদের পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধায় তারও নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ ছিল না। একপর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, মুজাহিদ হোক বা না হোক সরকার আমাদের ফ্যামিলি ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

বেলারের গ্রেফতারির পর শাকীল আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিল। এখন বাড়িতে না আছে শাকিল, না আছে ফিরোজ। বেলালের পর জাফরের গ্রেফতারিতে ঘরে রীতিমতো মাতম শুরু হয়ে যায়। জাফরের সঙ্গে আমার ছোট বোনের ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। তার গ্রেফতারিতে বোন নিজেকে বিধবা ভেবে মাতম শুরু করে দেয়। আমার মা-ও এই ঘটনায় বেশ মুষড়ে পড়েন। নিজের গর্ভজাত ছেলেদের গ্রেফতারিতেও তিনি এত ভাঙেননি। জাফরের গ্রেফতারির সংবাদ শুনে যখন আমি আলুচাবাগ গিয়ে পৌছি, তখন সেখানে বিপুল লোকের সমাগম। এলাকাবাসী, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন সবাই সেখানে ভিড় জমিয়েছে। তাদের অধিকাংশ লোক আমার ছোট বোন ও মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার পরিবর্তে তিরষ্কার করতে শুরু করে যে, তোমাদের কিসের অভাব ছিল যে, তোমরা এই ঝুঁকিপূর্ণ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছ? এখন মজা বোঝো; একে-একে বাড়ির প্রতিটি সদস্যই তো বন্দি হয়ে গেল। এক নিকটাত্মীয় আমার বোনকে বলছিল, এসবই ফরীদার কর্মের ফল। ও যদি মুজাহিদদের সঙ্গ না দিত, তাহলে তোমাদের এই দশা হতো না।

বাড়ি পৌছে আমি আমার বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমি তাকে বললাম, এই ঘটনার জন্য তোমার কান্নাকাটি করা ঠিক হচ্ছে না। এসবই আল্লাহর ইচ্ছা। একনও তো তেমন কিছুই ঘটেনি। কেবল ধড়পাকড় হচ্ছে মাত্র। আমাদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আমরা একটি অত্যাচারী ও ধোঁকাবাজ সরকারের মোকাবেলায সংঘাতে লিপ্ত হয়েছি। আযাদি আমাদের থেকে কোরবানি দাবি করছে। সে সময়টি আর বেশি দূরে নয়, যখন মায়ের সামনে আমাদের ছেলেদের যবাই করা হবে, স্ত্রীর সামনে স্বামীকে খুন করা হবে, স্বামীর সামনে স্ত্রীর, পিতার সামনে কন্যার, ভাইয়ের সামনে বোনের সম্ভ্রম লুণ্ঠন করা হবে। আবাল-বৃদ্ধ, শিশু-কিশোর নির্বিশেষে কাশ্মিরি মুসলমানদের হত্যা করা হবে। এসবের জন্য এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।

উপস্থিত যেসব নারী-পুরুষ আমার বোন, মা ও পিতাকে তিরষ্কার ও উত্তেজিত করছিল, আমি তাদেরকে উদ্দেশ করে বললাম- 'আমাদের জানা থাকা দরকার, আমাদেরও কারুর ঘর-আপনজন নিরাপদ থাকবে না। অদূর ভবিষ্যতে যেকোনো কাশ্মিরি মুসলিম ঘর থেকে শুধু যুবক ছেলেদেরই নয়, যুবতী মেয়েদের টেনে বের করা হবে এবং প্রকাশ্য রাজপথে জনসম্মুখে তাদের সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হবে। এই মুহূর্তে ভবিষ্যৎপানে যাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হচ্ছে না, তারা আমার কথাগুলো নোট করে রাখুন এবং বকওয়াস বন্ধ করুন।

আমার সঙ্গে কারও ব্যক্তিগত বিরোধ থাকলে তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই, পরোয়া নেই। কিন্তু আমি আপনাদের মুখ থেকে কাশ্মিরের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধী কোনো কথা শুনতে প্রস্তুত নই। আপনারা আমার যতই ঘনিষ্ঠ হন না কেন, এই সূত্রে আমি আপনাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতেও প্রস্তুত আছি।'

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹

আমার এই বক্তব্যে পরিবেশ সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। একটু আগেও যেখানে হতাশা ও নৈরাশ্য বিরাজ করছিল, মুহূর্তের মধ্যে সেখানে আযাদির স্লোগান মুখরিত হয়ে উঠল। সেদিনটা আমি আলুচাবাগেই অবস্থান করি। পরদিন বোনকে সঙ্গে নিয়ে নটিপুরা চলে আসি। বোনকে আমি আমার কাছেই রাখি।

বেশ কিছুদিন পর ফিরোজ সীমান্ত অতিক্রম করে ফিরে আসে এবং পুরোদমে সংগঠনের কাজ শুরু করে দেয়। পীর জাফর আহমাদের মুক্তির জন্য আমরা অনেক চেষ্টা করি। যেহেতু লোকটি মুজাহিদ ছিল না, তাই আমাদের পূর্ণ আশা ছিল, আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে বের করে আনতে পারব। কিন্তু আমাদের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হলো।

যখন এক বছরেরও বেশি সময় কেটে গেল; কিন্তু তার মুক্তির কোনো ব্যবস্থা হলো না, তখন আমরা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তিকে অপহরণ করার সিদ্ধান্ত নিই। লটারিতে নাম এল ভারত সরকারের ঊর্ধ্বতন অফিসার দোরায়ে সোয়ামির। অবশেষে গ্রেফতারির ১৪ মাস পর পীর জাফর আহমাদ মুক্তিলাভ করে। পীর জাফর আহমাদ কিভাবে গ্রেফতার হলো, বন্দীদশায় কিরূপ নির্যাতনের শিকার হলো এবং কিভাবে মুক্তি পেল, শুনুন তারই জবানিতে। মুক্তিলাভের পর পীর জাফর আহমাদ জানান- 'আমি ইসলামাবাদের বাসিন্দা। আলুচাবাগের মোহাম্মাদ ইউসুফ বেগের কন্যাকে বিয়ে করার পর স্বভাবত আমি তার পরিবারের সদস্য হয়ে যাই। কাশ্মিরে সশস্ত্র আযাদি আন্দোলন শুরু হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কাশ্মিরি মুসলমানদের উপর নির্মম নির্যাতনের যে বিভীষিকা নেমে এল, তাতে আমি প্রভাবিত না হয়ে পারিনি। বেগ পরিবারের উপর যখন বিভীষিকা নেমে এল, তখন আমিও তা থেকে রক্ষা পাইনি।


পুলিশি হানা ও তল্লাশির সময় আমার সঙ্গে ভারতীয় পুলিশ যে-নির্মম আচরণ করে, তাতে আমি রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। ক্র্যাকডাউনের সময় আমাদেরকে পশুর মতো হাঁকিয়ে কোনো খোলা জায়গার নিয়ে গিয়ে বরফশীতল কিংবা প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে দিনভর ক্ষুধার্ত ও পিপাসার্ত অবস্থায় দাঁড় করিয়ে রাখত। সন্দেহভাজন যুবকদের আমাদের চোখের সামনে ধরে-ধরে নির্মমভাবে প্রহার করত। কাউকে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে হত্যা করত।

গ্রেফতার করার পর কোনো-কোনো যুবককে গায়েব করে ফেলে তাদের গ্রেফতারির কথা অস্বীকার করা হতো। বাস থেকে নামিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে যখন আমাদের পরিচয়পত্র চাওয়া হতো, তখন আমি ভাবতাম, এ কেমন অত্যাচার! ভিন দেশের সৈনিকরা আমাদের পরিচয়পত্র তলব করছে! এ তো চোরের পুলিশকে শাসানোর মতো হলো। মোটকথা, পায়ে- পায়ে আমাদের উপর অত্যাচার চালানো হতো। তখন আমারও ইচ্ছে হতো, এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠি।

একদিনের ঘটনা, আমি অফিসে যাওয়ার জন্য স্টাফবাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় হঠাৎ একদল টহল পুলিশ এসে আরও কজন যুবকের সঙ্গে আমাকেও ধরে নিয়ে গেল। আমাদেরকে নিউ এয়ারপোর্টের ইন্টারোগেশন সেন্টারে নিয়ে আটক করে রাখা হলো। সেখানে লাগাতার দুঘণ্টা অত্যাচার করার পর আমাদের পাওয়ার টাচ্ দেওয়া হলো।

নিউ এয়ারপোর্টের ইন্টারোগেশন সেন্টারে অবস্থান করার দিনগুলোতে আমি দেখেছি, প্রতিদিন কয়েক ডজন যুবককে পুলিশ বিভিন্ন জায়গা থেকে ধরে সেখানে নিয়ে আসত। মুজাহিদ হতো আর না হতো বিশেষ করে দাঁড়িওয়ালা যুবকদের উপর বেশি অত্যাচার হতো। তাদের উপর এই বলে টর্চার করা হতো, তোমরা স্বীকার করে নাও, আমরা পাকিস্তানি মুজাহিদ।

পাকিস্তানি মুজাহিদকে ধরে আনতে পারলে ফোর্সকে কোম্পানির পক্ষ থেকে পুরস্কার দেওয়া হতো। অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পদোন্নতিও হয়ে যেত। এই লোভে দিনভর ঘুরে-ফিরে ডজন-ডজন যুবক গ্রেফতার করে নিয়ে যেত এবং নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের থেকে পছন্দমতো স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করত। অনেক সময় দৈবাৎ তাদের মধ্যে পাক কিংবা কাশ্মিরি মুজাহিদ পেয়েও যেত। তবে ধৃতদের মধ্যে যারা দাড়িওয়ালা হতো, তাদেরকে জীবনের তরে পঙ্গু করে ছাড়ত। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে যারা মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিত, তাদের লাশ কন্ট্রোল রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হতো।

আমার মুখে দাড়ি ছিল না বলে আমার উপর বেশি অত্যাচার করা হয়নি। তারপরও যখন আমার দেহের উপর ভারী রোলার চালনা করা হতো, তখন আমার জীবন বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হতো। দেহ থেকে রোলার সরিয়ে নেওয়ার পর পেশাবের ছিদ্রপথে একটা সুঁই ঢুকিয়ে দেওয়া হতো, যার ফলে পেশাবের সঙ্গে রক্ত বের হতে শুরু করত। কিছুদিন পর পেশাবের আগে পুঁজ নির্গত হতে শুরু করত।

এক-একটি নির্যাতনের পর বলা হতো, আমরা তোমাকে আমাদের অফিসারের সামনে নিয়ে যাব; সেখানে তুমি নিজেকে পাক মুজাহিদ বলে স্বীকার করবে। অন্যথায় আমরা তোমাকে এর চেয়েও কঠোর শাস্তি দেব। আমি তাদের সামনে বলতাম, ঠিক আছে তা-ই হবে। কিন্তু অফিসারের সামনে গিয়ে অস্বীকার করতাম। তারপর শুরু হতো আরও কঠোর নির্যাতন। উল্লেখ্য, যদিও বলা হতো, অফিসারের সামনে স্বীকারোক্তি দিলে নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, কিন্তু তা ছিল শুধুই প্রতারণা।

টানা তিন দিনের নির্যাতনের পর আমাদেরকে পাপাটু পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গাড়িতে তুলে নিউ এয়ারপোর্ট থেকে যখন আমাদেরকে পাপাটু নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমাদের এক একজনের নাম ধরে বলা হলো, অমুককে অমুক জাহাজে বসাও, অমুককে অমুক জাহাজে। আমি মনে করেছিলাম, বোদ হয় এখানে থেকে জাহাজে করে আমাদেরকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু না, আমাদেরকে বিভিন্ন নম্বরের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। চব্বিশ বর্গফুটের এক একটি সেলে পাঁচজন করে যুবককে ঢোকানো হলো। কক্ষে কোনো জানালা ছিল না। ছিল না কোনো আলোর ব্যবস্থা। ফাঁসির আসামি হলেও এমন সংকীর্ণ ও দুর্ঘন্ধযুক্ত জায়গায় একজনের বেশি লোক রাখার কথা ছিল না। তবে একদিক দিয়ে সুবিধাই হয়েছে যে, আমরা একে অপরের দুর্দশা উপলব্ধি করতে পেরেছি এবং একা থাকার কষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছি।



ইন্টারোগেশন সেন্টারে টর্চারের সময় আমাদের গায়ে যে যখম পড়েছিল কিংবা নির্যাতনের ফলে নীল দাগ পড়ে গিয়েছিল, পেশাবের নালীতে সুঁই ঢোকানোর ফলে কিংবা গরম ইস্ত্রির ঘষার কারণে যে জ্বলন সৃষ্টি হয়েছিল, তার জন্য ঔষধ চেয়ে আমরা অকথ্য ভাষায় গালাগাল ছাড়া কিছুই পাইনি। খাওয়ার জন্য পেয়েছি বালিমাখা ভাত। দিনের বেলা একবার চায়ের নামে পান অযোগ্য তিতা গরম পানি দেওয়া হতো।

পায়খানা-পেশাবের জন্য বাইরে বেরুবার সময় চোখে পট্টি বেঁধে দুবাহু বেঁধে দেওয়া হতো। টয়লেটে সামান্য দেরি হয়ে গেলে বাইরে থেকে রশি ধরে টান দেওয়া হতো। অধিকাংশ সময় পুরোপুরি পেশাব-পায়খানা করার সুযোগই দেওয়া হতো না।

এতসব অত্যাচার-নির্যাতন আমরা এই ভেবে সহ্য করতাম যে, সাজা শেষ হওয়ার পর একসময় আমাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কারণ, ইন্টারোগেশনের পরীক্ষা থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। কিন্তু সেই অন্ধকার সংকীর্ণ স্থানে আসবার মাত্র তিন দিন পর পুনরায় আমাদেরকে ইন্টারোগেশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হলো।

ইন্টারোগেশন সেন্টারে নিয়ে গিয়ে আমাদেরকে লোহার শিকলে বেঁধে মাথা নিচু করে ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হলো। জ্বলন্ত সিগারেট দ্বারা শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে দাগ দেওয়া হলো। যাদের মুখে দাড়ি ছিল, দাড়িগুলো প্লাস দ্বারা ধরে টেনে ছিঁড়ে ফেলা হলো। মোমবাতির আগুন দ্বারা দাড়ি পুড়ে ফেলা হলো। গুপ্তাঙ্গে পাইপ দ্বারা পাউডার জাতীয় কী যেন ঢোকাল, যার ক্রিয়ায় সমস্ত শরীরে জ্বলন শুরু হয়ে গেল।

টানা দশ দিন পর্যন্ত আমাদের উপর এই টর্চার অব্যাহত থাকল। তারা আমাদের থেকে এই স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করছিল যে, আমরা পাকিস্তানি সৈনিক। সাথীরা আমার সঙ্গে পরামর্শ করল, আমরা কথাটা স্বীকার করে নিলেই তো ভালো হয়। হতে পারে, তাতে আমরা টর্চার থেকে রক্ষা পেয়ে যাব। বারামুল্লার এক স্কুল চাপরাশীকে তার বাসগৃহ থেকে তুলে আনা হয়েছিল। স্বীকারোক্তি না দেওয়ার কারণে তার পাদুটো জ্বলন্ত স্টোভের উপর রাখা হলো। জ্বলে-পুড়ে তার দুপা থেকে চর্বি গলে- গলে স্টোভের আগুনে পড়তে থাকল। অবশেষে আর সহ্য করতে না পেরে সে পুলিশের সেখানো বক্তব্য অনুযায়ী স্বীকারোক্তি দিয়ে দিল। তারপর তার পায়ের নিচ থেকে স্টোভ সরিয়ে নেওয়া হলো এবং তাকে মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হলো। এমন ভয়ানক দৃশ্য দেখে আমি ও আমার কয়েকজন সঙ্গী শুধু মুজাহিদই নয়, আমরা পাকিস্তানি মুজাহিদ বলে স্বীকারোক্তি প্রদান করি।

এই স্বীকারোক্তিতে আমরা টর্চার থেকে তো মুক্তি পেলাম; কিন্তু দশম দিনে আমার নাক থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করল। পেশাবে তীব্র ও অসহ্যকর জ্বালা-পোড়া শুরু হলো। সারা গায়ে আঘাত-ক্ষত তো আছেই। আমরা ডাক্তার ফরমায়েশ করলাম। ডাক্তার এলেন বটে; কিন্তু তিনি কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে গড়ে সব রোগীকে Noveigen খেতে দেন।

সেখান থেকে বের করে আমাদেরকে সেন্ট্রাল জেলে রাখা হয়। সেন্ট্রাল গিয়ে বিপুলসংখ্যক কাশ্মিরি যুবক পেলাম। এখানে আমাদেরকে ১৫ দিন রাখা হয়।

গ্রেফতারির সময় আমার হাতের ঘড়ি, পকেটের টাকা, সোনার আংটি, পরিচয়পত্র ও অন্যান্য জিনিসপত্র পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। পরদিন সেন্ট্রাল জেলে রাখার পর যখন আমাদেরকে কোর্ট বেলওয়াল জেল অভিমুখে রওনা করা হয়, তখন আমি আমার এসব জিনিসপত্র দিতে বলি। জবাবে চড়- থাপ্পর আর গালাগাল ছাড়া কিছুই পাইনি।

কিছুদিন পর কোট বেলওয়াল জেল থেকে বের করে আমাদের চোখে পট্টি বেঁধে পুরাতন এয়ারপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়। এয়ারপোর্টে আমাদের জাইঙ্গা ছাড়া পরনের সব কাপড় খুলে ফেলা হয়। এখন আমাদের হাতদুটো বাঁধা, চোখে পট্টি আর সমস্ত শরীর উদোম। এমতাবস্থায় আমাদেরকে কপ্টারে করে জম্মুর উদ্দেশ্যে রওনা করা হয়। সেই কপ্টারে আসন ছিল মাত্র ১০টি। উঠানো হলো ৪০ জনকে। কর্মচারীরা বলে দেয়, জম্মু না পৌঁছা পর্যন্ত যাকে যেভাবে রেখেছি, একটুও নড়াচড়া করবি না. কারো মুখ থেকে টু শব্দটি যেন বের না হয়।

একসময় যখন কপ্টার ল্যান্ড করল, তখন আমাদের বলা হলো, এখন তোমরা জম্মুতে এসে পৌঁছেছ। কপ্টার থামার পর আমাদের লাইন দিয়ে নামানো হলো। তীব্র গরমে গোটা পরিবেশ পুড়ে যাচ্ছিল যেন। চোখবাঁধা মানুষগুলোকে তারা পশুর মতো হাঁকিয়ে নামাচ্ছিল। আমাদেরকে বুঝতে দেওয়া হয়নি, আমাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসামাত্র হঠাৎ আমরা শোরগোলের মতো শব্দ শুনতে পেলাম।

'ভারত মাতার জয়', 'হিন্দুস্তান জিন্দাবাদ', 'পাকিস্তান মুর্দাবাদ' ইত্যাদি স্লোগানের মধ্য দিয়ে আমাদের উপর এমন মারধর শুরু হয়ে যায় যে, প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে উদোম শরীরে আমরা রক্তাক্ত হয়ে যাই। স্লোগান থেকে আমরা অনুমান করলাম যে, ভারতীয় জনতা পার্টি ও সিবসেনার কর্মীরা এয়ারপোর্টে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানাতে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। শ্রীনগর এয়ারপোর্টে কপ্টারে উঠাবার আগে সম্ভবত এজন্যই আমাদেরকে উদোম করে নেওয়া হয়েছিল।

যাহোক মনভরে চরম অত্যাচার-নির্যাতন চালানোর পর সেখান থেকে আমাদেরকে কোর্ট বেলওয়াল নিয়ে যাওয়া হয়। চোখের পট্টি এবং হাতের বাঁধনও খুলে দেওয়া হয়। এখানে বিজেপি নেতা কাশ্মির পণ্ডিত ও সিবসেনার গুণ্ডাদের সঙ্গে আরও কারা যেন আমাদেরকে মারধর করতে থাকে। তারা গাড়ির টায়ারের রাবার হাতে নিয়ে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিল। পিটিয়ে-পিটিয়ে তারা আমাদের গায়ের চামড়া ছিলে ফেলে। মারধরের একপর্যায়ে তারা রাজা নামক এক মুজাহিদকে চিনে ফেলে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলে- 'তুমি তো এর আগেও এই জেলে এসেছিলে। এখন আবারও এসেছ। মনে হচ্ছে, তুমি ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী।'

তাকে আলাদা করে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে প্রহার করে যে, মেঝেয় তার সঙ্গে ফুটবলের মতো আচরণ করে এবং নির্মমভাবে পিষ্ট করে। আমার ধারণা, সেই নির্যাতনেই লোকটি শহীদ হয়ে গেছে। কারণ, তারপর তাকে আমি আর দেখেনি।

কোর্ট বেলওয়াল জেলে আমাদেরকে যে কক্ষে রাখা হয়, তাতে বড়জোর দশজন লোক থাকতে পারে। কিন্তু রাখা হলো আমাদের ৪০ জনকে। প্রচণ্ড গরমে আগুন ঝরছিল যেন। আলোর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। খাবার রীতিমতো দেওয়া হতো। আমরা আসামী ৬৫০ জন। তরকারির জন্য আনা হলো সাত কেজি বেগুন। ভাতের সঙ্গে একটুখানি করে বেগুনের ভর্তা দেওয়া হলো। ভাতের সঙ্গে এত পাথর যে, চাপ দিলেই কড়মড় করে উঠত। ভাত দেওয়া হতো জনপ্রতি ৫০-৬০ গ্রাম চালের। চা এক কাপ করে পেতাম বটে; তবে তাতে দুধের চিহ্নও থাকত না। চিনির পরিবর্তে দেওয়া হতো সেকারিন, তাও পরিমাণে সামান্য।





সরকার কয়েদীদের জন্য মাথাপিছু যে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে, বড়জোর তার দশ ভাগের এক ভাগ কয়েদীদের ভাগ্যে জোটে। জেলকর্মকর্তা ও আমলারা কয়েদীদের ফান্ড লুটেপুটে খেয়ে ফেলে। আমরা প্রতিবাদ জানালে জেলকর্মকর্তা পরিষ্কার বললেন, এসব অর্থ ভাগ হয়ে মন্ত্রী পর্যায়ে পৌঁছে যায়। অতএব তোমাদের হৈচৈ করে লাভ হবে না।

আমাদের সঙ্গীদের কয়েকজন যুবক খাওয়ার অযোগ্য ও স্বল্প খাবারের প্রতিবাদে অনশন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তার শাস্তিস্বরূপ কর্মকর্তারা আমাদেরকে আবার ইন্টারোগেশনের জন্য নিয়ে যায়। আমরা বললাম, এ পর্যন্ত আমাদের তিনবার ইন্টারোগেশন হয়েছে। আপনারা তার এনওসিও পেয়েছেন। জবাবে তারা বলল, এখানে আইন চলে আমাদের। তোমরা বেশি কথা বলছ; এখন তার মজা নাও।

ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে গিয়ে কোনো কথা জিজ্ঞেস না করেই আমাদেরকে উলঙ্গ করে ছয়জনকে একত্রে বেঁধে ফেলে। তারপর বন্দুকের বাঁট দ্বারা আমাদের পেটাতে শুরু করে। কিল-ঘুষি-লাথিও শুরু হয়ে যায় সমানতালে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমাদেরকে এভাবে বেঁধে রাখে। সন্ধ্যার সময় আমাদের কাপড় পরতে বলে। তারপর গাড়িতে বসিয়ে জম্মু সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেয়।

পরে আমরা জানতে পারলাম, সেদিন এক মন্ত্রী জেল পরিদর্শনে এসেছিলেন। ফলে তাকে দেখানোর জন্য জেলের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত লোক সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। আমরা আরও জানতে পেরেছি, সেদিন কয়েকীদের শুধু নতুন পোশাকই পরতে দেওয়া হয়নি; বরং চারপাইতে নতুন চাদরও বিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে মন্ত্রীর চলে যাওয়ার সঙ্গে- সঙ্গে চারপাই থেকে চাদরগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।

মন্ত্রীকে বিভিন্ন সেলে পড়ে থাকা কয়েদীদের ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি এবং তাদেরকে দেখানোও হয়নি। এখানে কিছুদিন রাখার পর আমাদেরকে অধমপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

অধমপুর জেল থেকে বের করে রাজ্যের বাইরে অন্য কোনো জেলে স্থানান্তর করার জন্য আমাদেরকে এয়ারপোর্ট পৌছিয়ে দেওয়া হয়। এখানে দিনভর অপেক্ষা করার পর আমাদেরকে এই বলে ফিরিয়ে নেওয়া হয় যে, বিমান পাওয়া যায়নি।

পরদিন চারটার সময় আমাদেরকে পুনরায় এয়ারপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানের জন্য অপেক্ষা করার সময় এয়ারফোর্সের এক শিখ অফিসার জেল অফিসারকে বলল, এই কয়েদী লোকগুলো গতকাল থেকে না খেয়ে। এদের প্রত্যেককে দুটি করে রুটি খেতে দাও। এদের বিমান কখন আসবে ঠিক নেই। জেল অফিসার যিনি আমাদের সঙ্গে ডিউটিরত ছিলেন বললেন, প্রয়োজন নেই, কারণ, এরা সবাই মুজাহিদ। এরা কাশ্মিরে চরম অরাজক অবস্থার সৃষ্টি করেছে।

এক সময় বিমান এল। তাতে উঠিয়ে আমাদের হরিয়ানা নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে বিমান থেকে আমাদের নামানো হলো। সম্ভব সেটি ছিল আর্মি এয়ারপোর্ট। এখানে আমাদেরকে বাসে করে হরিয়ানা থেকে নয় কিলোমিটার দূরে এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা যে বাসে করে পথ অতিক্রম করছিলাম, তার সামনে ছিল সাইরেন গাড়ি। সামনে-পিছনে সিকিউরিটি গার্ড।

বাসে সিকিউরিটি গার্ড কাশ্মিরি মুজাহিদদের সঙ্গে পাকিস্তানকেও মন্দ- শক্ত বলতে শুরু করে। বিষয়টি আমরা সহ্য করে নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু যখন তারা মুসলমান-মুজাহিদদের সঙ্গে ইসলামেরও বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করে, তখন আর আমরা ধৈর্য ধরে রাখতে পারলাম না। আমরা প্রতিবাদ জানালাম। তার ফল পেলাম সঙ্গে-সঙ্গে। সম্ভবত তারা আমাদের মুখ খোলার অপেক্ষায়ই ছিল। বাসের সিটে বসা অবস্থায়ই তারা আমাদের পিটাতে শুরু করল। সেই মারপিট চলল ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত।


হরিয়ানা শার্শা জেলের বিভিন্ন সেলে ঢোকাবার আগে পাজামা আর আন্ডারওয়ার ছাড়া আমাদের পরনের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলল। পাজামাও পরতে দেওয়া হয় ফিতা ছাড়া। আমরা গিরা দিয়ে পাজামা বেঁধে রাখি। এখানে আমাদেরকে আলাদা আলাদা ডেথ সেলে রাখা হয়। ৩*৬ ফুট-এর এক একটি সেলে চারজন করে কয়েদী রাখা হয়।

আমরা প্রায় সকল কয়েদীই আহত ছিলাম। হাড়-জোড়ার ব্যথা ছিল প্রত্যেকের। কারও জখম থেকে রস নির্গত হচ্ছিল, কারো পুঁজ। ডাক্তার প্রার্থনা করলে ডাক্তার এলেন। কিন্তু গড়পড়তা সবাইকে Calpal খেতে দিলেন। আমাদের সঙ্গে তারেক আহমাদ নামক এক যুবক ছিল। ছেলেটা ব্লাড ক্যান্সারের রোগী। নাজির আহমাদ বাট নামক আরেক যুবকের বাহুতে দুটি গুলী বিদ্ধ হয়েছিল। তার জন্যও কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। আমাদের দাবি সত্ত্বেও তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। কর্মকর্তারা বারবার এই বলে পাশ কেটে যায় যে, তাদের জন্য আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি। অবশেষে নাজির আহমাদ বাটের ক্ষতস্থান থেকে যখন পোকা বের হতে শুরু করল, তখন আমরা অনশন পালন করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের চাপে পড়ে নাজীর আহমাদ বাটকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হলো।

এই জেলে আমার আট মাসেরও অধিক সময় কেটে যায়। একদিন রাত দুটার সময় সিবিআই'র দুজন কর্মকর্তা জেল কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলেন। তারা পীর জাফর আহমাদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমাকে তাদের সামনে উপস্থিত করা হলো আমাকে বলা হলো, শ্রীনগর এখওয়ানুল মুসলিমীন দোরায়ে সোয়ামী নামক এক বুরোক্রেটকে অপহরণ করেছে। তারা বিনিময়ে পীর জাফর আহমদের মুক্তি দাবি করেছে। আজকালের মধ্যে তোমাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হবে। তুমি প্রস্তুত থাকো।

পরদিনই সিবিআই ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা এসে আমাকে সেল থেকে বের করে নিয়ে যান। আমার পরনের পাজামা খুলে তা দ্বারা আমার মাথাটা ঢেকে দেওয়া হয় এবং একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে আমাকে টর্চার করা হয়। সেই টর্চার ছিল এত প্রচণ্ড যে, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমার নাক ও কান থেকে রক্ত বের হয়ে জমাট বেঁধে যায়। একসময়ে আমার জ্ঞান ফিরে এলে আমি দেখলাম, কক্ষে ২০/২৫ জন অফিসার বসে আছেন। তারা আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তোলেন।

এক অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করেন, দোরায়ে সোয়ামীকে অপহরণ করে কোথায় রেখেছিস বল। আমি বললাম, আমি আজ চৌদ্দ মাস হলো আপনাদের হাতে বন্দী, আমি কি করে বলব দোরায়ে সোওয়ামীকে কারা অপহরণ করেছে, কোথায়ইবা রেখেছে? আমার এই অস্বীকৃতির ফলে আমাকে আবার মারধর করা হলো।

পরদিন সকালে আমাকে জীপের মতো একটি বাহনে উঠিয়ে হরিয়ানা পুলিশ স্টেশনে পৌঁছিয়ে সেখানকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে সারারাত আমাকে অন্ধকার এক প্রকোষ্ঠে রাখা হয়। এই সময়ের মধ্যে আমাকে এক তিল খাবার, এক ফোঁটা পানিও দেওয়া হয়নি। তার পরদিন একটি জীপে করে আমাকে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাওয়া হয়। জীপে বসিয়ে আমার উভয় বাহু হাতকড়া দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়। আমার সঙ্গে যে সিপাহী বসা ছিল, সমগ্র পথে সে বসে বসে আমার গায়ে সুঁই ফুটাতে থাকে। লাথি ও চড়থাপ্পড় মারতে থাকে এবং কাশ্মিরি মুজাহিদদের নাম উল্লেখ করে করে গালাগাল করতে থাকে।

এয়ারপোর্ট পৌছার পর আমাকে একটা কপ্টারে উঠানো হলো। কপ্টারে দুজন অফিসারের সঙ্গে আমি একা। বাদামীবাগ পৌঁছিয়ে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আমার মুক্তির পর জনতা ডাউন টাউনে আমাকে সংবর্ধনা প্রদান করে।


দোরায়ে সোয়ামীর অপহরণ

মুজাহিদরা ভারতীয় গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম অফিসার দোরায়ে সোয়ামীর অপহরণ ঘটনার দায়িত্ব স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার বাড়ি টার্গেটে পরিণত হয়। মুহূর্তের মধ্যে ১০/১২টি আর্মি গাড়ি এসে পড়ে। তাদের সঙ্গে সাজোয়াযান ও ওয়ারলেস সজ্জিত জীপ গাড়ি। আমার ঘরের প্রতিটি কোণে তন্নতন্ন করে তল্লাশি চালানো হয়। স্বামী মকবুল জান, পুত্র মুদ্দাসসির ও মাসাররাতের উপর নির্যাতন চালায়। মুদ্দাসসিরের ঘাড়ে বন্দুকের হাতল দ্বারা এত জোরে আঘাত করে যে, ছেলেটা নিচে পড়ে গিয়ে ছটফট করতে থাকে। মকবুল জানকে ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিয়ে চারজন জওয়ান তার পিঠের উপর চড়ে বসে। প্রবল চাপে তার বমি হয়ে যায়। মাসাররাতের ডান বাহুটা এমনভাবে মোচড় দেয় যে, ছেলেটা চিৎকার করতে শুরু করে।

নির্যাতনের এই ধারা আমি চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। কিন্তু আমার নড়াচড়া করারও অনুমতি ছিল না। আর্মিরা আমাদেরকে হেলাল বেগ ও দোরায়ে সোয়ামী সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছিল। ব্যাপক অনুসন্ধান করেও যখন তারা এখানে কিছু পেল না, তখন মকবুল জান ও মুদ্দাসসিরকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলে। সৈন্যরা তাদেরকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলতে শুরু করে।

আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। আমি তাকবীর ধ্বনি তুলে বেষ্টনী ভেঙ্গে ফেলি এবং দৌড়ে মকবুল জান ও মুদ্দাসিরের নিকট চলে যাই। আমি তাদেরকে আর্মির গাড়িতে ওঠা থেকে ঠেকিয়ে রাখি। সেই সঙ্গে আমার বোনও বাড়ির উপর তলায় উঠে জানালা দিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়। তার চিৎকারের আওয়াজ নটিপুরা আযাদ বস্তি ও দেলসুজ কলোনী পর্যন্ত পৌছে যায়।

বোন এই বলে আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছিল-

"হে আল্লাহ! তুমি আমাদের আকুতি শোনো। দেখো, মালাউনরা আমাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করছে। ওরা আমাদের ঘরের সব পুরুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। ইয়া আল্লাহ! তুমি আমাদের রক্ষা করো।"

আমি মকবুল জান ও মুদ্দাসসিরকে বাহু দ্বারা জড়িয়ে ধরে আর্মি অফিসারকে বললাম, "তোমরা হয় আমাদেরকেও তুলে নিয়ে যাও, অন্যথায় এদের ছেড়ে দাও। তৃতীয় কিছু আমি তোমাদের করতে দেব না।"

আমার কথার জবাবে অয়িসার কিছু বলার আগেই এক সিপাহী এগিয়ে এসে আমার মাথার চুল ধরে টান দেয়। আমি তার গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দেই। দুজনের মধ্যে টানা-হেঁচড়া শুরু হয়ে যায়। সিপাহী আমাকে ধাক্কা মেরে পেছনে সরিয়ে দেয় আর আমি নিজেকে সামলে নিয়ে দৌড়ে তার নিকটে এসে একটা ঘা বসিয়ে দেই।

একপর্যায়ে এক সিপাহী আমার সঙ্গে বেশি বাড়াবাড়ি করতে শুরু করলে আমি আহত বাঘিনীর মতো তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমি তার মুখে নখের আচড় কেটে ধাক্কা মেরে ফেলে দিই। লোকটি নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই আমি তার হাত থেকে রাইফেলটা কেড়ে নিই। আমার হাতে এখন রাইফেল। সামনে শত্রু। আমি চরমভাবে ক্ষুব্ধ। রাগের বসে গুলী করে বসি কিনা সেই ভয়ে অফিসার আমাকে শান্ত হতে বলল।

অফিসার আমার থেকে রাইফেলটি ফেরত চায়। আমি দিয়ে দেই। সাথে সাথে বলেও দিই যে, আমার জীবন নিয়েই তবে আপনি এদেরকে নিয়ে যেতে পারবেন; অন্যথায় নয়। আপনি আমাদের সবাইকে গুলী করে মেরে ফেলুন। আমরা বেঁচে থাকতে চাই না। এই জীবন থেকে মৃত্যুই ভালো। কিন্তু মনে রাখবেন, যে নির্মমতা আপনারা আমাদের উপর চালিয়ে যাচ্ছেন, তার আগুনে একদিন আপনাদের পুড়ে মরতেই হবে। আপনাদের প্রত্যেকের ঘর-সংসার একদিন তছনছ হয়ে যাবে। আমাদের স্ত্রী-সন্ত নিরাও আমাদের ন্যায় ছটফট, হাহুতাশ করবে। আমাদের আর্তচিৎকার আপনাদেরকে অশান্তির অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত করবে।

আমার বদ দোয়া আর আমার বোনের আর্তচিৎকারে আর্মি অফিসার হতভম্ব ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। সে মকবুল জান ও মুদ্দাসসিরকে ছেড়ে দিয়ে কোম্পানিকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তবে যাওয়ার সময় মকবুল জানের বুকে কিল-ঘুষির বৃষ্টিবর্ষণ করে যায় এবং মুদ্দাসসিরকে তুলে পার্শ্বের দেওয়ালের গায়ে ছুড়ে মারে। আমি বাপ-বেটা দুজনকে আর্মিদের কবল থেকে ছিনিয়ে আনি। মকবুল জান ও মুদ্দাসসির কয়েক দিন পর্যন্ত চিকিৎসাধীন থাকেন। তাদের দুজনকে ডাক্তার বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন।

এ ঘটনার পর আমি তাদের দুজনকে আর ঘরে থাকতে দিলাম না, যাতে তাদের আর জালেমদের নির্যাতনের শিকার হতে না হয়। সন্ধ্যার পর রাতের খানা খাইয়ে আমি তাদের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিতাম। কয়েকদিন পর্যন্ত যখন আর হানা হলো না, তখন একদিন সন্ধ্যায় আমি তাদের বললাম, বাড়িতে হামলা-তল্লাশি আপাতত বন্ধ হয়েছে মনে হচ্ছে, কাজেই তোমরা আজ থেকে ঘরেই থাকো।

আমার কথা অনুযায়ী তারা সেদিন ঘরেই থেকে যায়। সেদিন আমার মনটাও ভাল ছিল না। বিশেষ করে সেজন্যই আমি স্বামী-পুত্রকে রেখে দিলাম। প্রচণ্ড মাথাব্যথায় আমার ঘুম আসছিল না। ঘরের সব মানুষ ঘুমে অচেতন। আমি তাকিয়ার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছি। রাত একটার সময় হঠাৎ আমার মুখের উপর টর্চ লাইটের আলো পড়ে। আমি হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়ি। ফোর্সের এক সিপাহী প্রচণ্ডভাবে দরজা নক করে বলল, 'দরজা খোল'।

উঠে দরজা খোলার আগে আমি মকবুল জান, মুদ্দাসসির, মাসাররাত ও সায়েমাকে জাগিয়ে তুলি। এ ব্যাপারে আমার ঘরের সবাই প্রশিক্ষিত। রাতে সামান্য ইঙ্গিত পেলেই ছোট-বড় সবাই জেগে উঠে মুহূর্ত মধ্যে সতর্ক হয়ে যায়।



আমার আফসোস হলো, কেন আজ আমি মকবুল জান ও মুদ্দাসসিরকে আটকে রাখলাম। অবশ্য আমি নিজেকে সামলে নিয়ে তাদের বলে দিলাম, তোমাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আমাদের পরিস্থিতির মোকাবেলা করেই চলতে হবে।

ইতিমধ্যে ঘরের দরজা ভাঙ্গার কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড় করে কয়েকজন সিপাহী ভেতরে ঢুকে পড়ে; একজন আমার বুকে ঘুষি মেরে ফেলে দেয়। আমি নিজেকে সামলে নিতে না নিতেই স্বামী ও পুত্রদের উপর কিল-ঘুষি-লাথি শুরু হয়ে যায়। আমার কোমর ও পিঠে লাথি পড়ে। তারা আমাদেরকে হেলাল আহমাদ বেগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল।

কথা জিজ্ঞেস করে সময় দিলে না হয় জবাব দিতাম। কিন্তু মদপান করে লোকগুলো এমন মাতাল হয়ে এসেছে যে, জবাব শোনার পরিবর্তে আমাদের উপর অত্যাচার শুরু করে দেয়। তাদের বক্তব্য হলো, তোরা দরজা খুলতে দেরি করেছিস। ফাঁকে তোরা হেলাল আহমাদ বেগকে লুকিয়ে ফেলেছিস। আমরা বললাম, লুকিয়েই যদি থাকি এ ঘরেই লুকিয়েছি, তোমরা খুঁজে দেখো।

এলোপাতাড়ি মারপিটের ফরে আমার স্বামীর রক্তবমি শুরু হয়ে যায়। এক অফিসার তার অবস্থা দেখে আমাকে পানি পান করাতে বলে। আমি মকবুল জানকে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিই। অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করে, হেলাল বেগ কোথায়?

-আমরা জানি না।

-তোরা সবই জানিস।

-আপনি আমাদের সমস্ত ঘর তন্ন-তন্ন করে খুঁজে দেখুন। থাকলে নিযে যান।

-তা তো দেখব। কিন্তু যদি এখানে না পাই, তাহলে কোথায় আছে তোদের বলতে হবে।

-কোথায় আছে জানি না যখন, বলব কী করে?

-এই এখনই জানবি। রাগত স্বরে বলেই অফিসার সিপাহীদের ঘরে তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দেয়।

ভোর চারটা পর্যন্ত তারা আমার ঘরের প্রতি ইঞ্চি জায়গা তন্ন-তন্ন কর অনুসন্ধান চালায়। আলমারী, বাক্স ইত্যাদি খুলে দেখে। শেষ পর্যন্ত যখন হেলাল আহমাদ বেগকে পেল না, তখন আমার স্বামী মকবুল জানকে নিয়ে যেতে শুরু করল। আমি মকবুল জানের সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াই এবং বলি, আমি একে নিয়ে যেতে দেব না। হয়ত তোমরা ঘরের ছোট- বড়, নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়ে যাও নতুবা কাউকে নয়।

এ সময় মকবুল জানের আবার বমি এসে যায়। তার দেহ কাঁপতে শুরু করে। অবস্থা বেগতিক দেখে অফিসার সিপাহীদের চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।

ফোর্স যে আসামীকে ধরার জন্য এসেছিল, সেই হেলাল আহমাদ বেগ তখন আমার ঘরের উপর তলায় ছিল। তারা চলে গেছে নিশ্চিত হয়ে আমি হেলালকে দেখার জন্য উপর তলায় যাই। হেলাল তার গোপন ঠিকানায় বসে সিপাহীদের চলে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল। আমি তাকে সৈন্যদের চলে যাওয়ার সুসংবাদ শোনালাম। সে বাইরে বেরিয়ে এল এবং আমার সঙ্গে নিচে নেমে মকবুল জানের অবস্থা জানতে চাইল।

হেলাল বেগ আমাদের দুর্গতি দেখে অনেক আফসোস করে। বেশি অত্যাচার হয়েছে মকবুল জানের উপর। হেলাল বেগ তার কাছে ওজরখাহী করতে শুরু করে। তার কারণেই আমাদের উপর বারবার বিভীষিকা নেমে আসছে দাবি করে সে আমাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। আমার স্বামী তাকে বললেন-

"আমাদের উপর তো শুধু ধর-পাকড় আর মারপিটই চলছে। কিন্তু আমাদের সেই ভাইয়ের অবস্থা কী, যারা শত্রুর হাতে খুন হচ্ছে? তোমাকে নিরাপদ রেখে আমরা তোমার উপর অনুগ্রহ করছি না। তুমি এক ব্যক্তি নও, একটি আন্দোলন। আমরা তোমার নেপথ্যে থেকে আন্দোলনের গোড়ায় পানি ঢালছি শুধু। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য আমরা আমাদের সবকিছুই কোরবান করে দিয়েছি। এ আন্দোলনের জন্য আমাদের জীবনও যদি চলে যায় সেটাই হবে আমাদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। কাজেই তুমি যেকথা বলছ, ভবিষ্যতে তেমন কথা আর মুখে এনো না।"

মকবুল জানের কথায় আমার ঈমান, আস্থা ও সাহস বহু গুণ বেড়ে যায়। মাঝে-মধ্যে আমার মনে প্রশ্ন জাগত, পাছে আমার স্বামী-সন্তানরা এমনটা ভাবছে না তো যে, আমি যদি এই স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে মুজাহিদদের সঙ্গ না দিতাম, তাহলে আমাদের এই দুর্গতি হতো না।

আমার স্বামী উদ্দীপনামূলক কথা বলে আমার মর্যাদা রক্ষা করল। মকবুল জানের কথা শেষ হলে আমার পুত্র মুদ্দাসসির যার বয়স তখন পনেরো বা ষোলো বছর হেলাল বেগকে উদ্দেশ্য করে বলল- "আপনি কখনও ভাববেন না, আপার হেফাযত করে আমরা আপনার উপর এহসান করছি। বরং আপনি যে সুযোগ আমাদেরকে দিয়েছেন, তা আমাদের উপরই আপনি অনুগ্রহ করেছেন বলতে হবে। আপনি জিহাদের ময়দানে আপনার নিজের জন্য নয়, ইসলাম ও মুসলিম জাতির জন্য লড়াই করছেন। আর আমরা সেই জাতিরই একটি অংশ। তাই আমরা এই মিশন থেকে দূরে থাকতে পারি কী করে? আমাদের জন্য আনন্দের ও গৌরবের বিষয় যে, আমরা আপনাদের সেবা করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিতে পেরেছি।"

ছেলের ঈমান-আলোকিত ও বীরত্বপূর্ণ বক্তব্য শুনে আমি স্থির থাকতে পারলাম না। আমার মনটা আনন্দে ভরে গেছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া বিভীষিকা ও অত্যাচার-নির্যাতনের কথা ভুলে গেলাম। 'শাবাশ আমার বাছাধন' বলে ছেলেকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আদর করলাম। ভোরের আলো ফোটা পর্যন্ত আমরা একত্রে বসে কাথাবার্তা বলতে থাকি। 

ফজর নামাযের পর এলাকার নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই আমার খবরাখবর জানতে ছুটে আসে। রাতে যখন আমাদের ঘরে হানা দিয়েছিল, সে সময়ে কোম্পনির একটি দল গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছিল। প্রতিবেশীরা জানালার ফাঁক দিয়ে আমাদের ঘরে পরিচালিত তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করছিল। এখন তারা আমাদের কুশল জানতে ছুটে এসেছে। দোরায়ে সোয়ামীর অনুসন্ধানে শ্রীনগর শহরের পার্শ্ববর্তী প্রতিটি গ্রামে ক্র্যাকডাউন করে গ্রামবাসীদের উপর তাণ্ডব চালানো হয়। কিন্তু সরকার ঘটনার কোনো কিনারা করতে পারেনি।


তার উপর যখন কেন্দ্রীয় সরকারের তেল ও পেট্রোলিয়ামের কর্মচারীরা দোরায়ে সোয়ামীকে উদ্ধার করার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে, তখন সরকার এখওয়ানুল মুসলিমীনের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় আসতে বাধ্য হয়। দু পক্ষে আলাপ-আলোচনার জন্য কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির মধ্যস্থতা অবলম্বন করা হয়।

হেলাল আহমাদ বেগ তখন এলাকায় ছিল না। মধ্যস্থতাকারীরা যখন এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে, আমি তাদেরকে সন্তোষজনক জবাব দেইনি। এমনকি নজির সিদ্দিকীকেও হেলাল বেগের সঙ্গে দেখা করাতে রাজি হইনি। অবশেষে যখন আবদুল আহাদ গুরু আমার নিকট এল এবং দোরায়ে সোয়ামীর বিষয়ে হেলার আহমাদ বেগের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেগ চাইল, তখন আমি তার আবেদনে সায় দিলাম।

ড. গুরু আমাকে তার গাড়িতে বসিয়ে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন ড. ছিল। পথে স্বাধীনতা আন্দোলন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য নিজেকে ওয়াক্ত করে দেওয়ার জন্য তারা আমার সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেন। পাশাপাশি কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করারও পরামর্শ দেন।

ইখওয়ানুল মুসলিমীন দোরায়ে সোয়ামীর বিনিময়ে যে কজন মুজাহিদের মুক্তি দাবি করেছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো জাবেদ আহমাদ ও জাফর আহমাদ। সরকার অন্যদের মুক্তি দিতে রাজি হলেও এ দুজনের পরিবর্তে অন্য নাম চায়। হেলাল আহমাদ বেগ এদের ব্যাপারে কোনো প্রকার আপস করতে পরিষ্কার অস্বীকার করে। ফলে বিষয়টা বেশ কদিন পর্যন্ত এভাবেই পড়ে থাকে। আলোচনাও চলতে থাকে।

ইখওয়ানের পক্ষ থেকে আর যাদের নাম দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে আমার ছোট ভাই বেলালও ছিল। সরকার মনে করে, বেলাল বেগকে মুক্ত করানোর কাজে আমার হাত আছে। ফলে গভর্নর সাকসিনা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়, যাতে আমি আমার ভাইয়ের মুক্তির ব্যাপারে বেশি জোর না দেই। কিন্তু আমি তাকে কোনো সুযোগ দেইনি। কিন্তু তিনি মধ্যস্থতাকারীকে বললেন, আমি বহেনজীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি তো বেলাল বেগের মুক্তির দাবি করছেন না।

মধ্যস্থতাকারী ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, এটা সংগঠনের সিদ্ধান্ত। বহেনজীকে আমি চিনি না। তিনি কে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার? এখনই গিয়ে আমি তার বাড়িঘর বোমা মেরে উড়িয়ে দেব। সঙ্গে-সঙ্গে গবর্নর সাকসিনা বললেন, কেন, বহেনজীর ঘর উড়িয়ে দেওয়ার জন্য আপনার কাছে মাল- মসলা আছে কি? মধ্যস্থতাকারী 'হ্যা-না' কিছু বলার আগেই সাকসিনা বললেন, না থাকলে বলুন, আমি ব্যবস্থা করব, আপনি বোমা মেরে ঐ পেত্নীটাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিন। এ কাজের জন্য আমি আপনাকে মোটা অংকের পুরস্কারও দেব।


এ কথোপকথনের পর মধ্যস্থতাকারী সেখান থেকে সোজা আমার বাড়ি চলে এলেন এবং ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আমাকে বললেন, আপনি কি গভর্নরের সঙ্গে বেলাল সম্পর্কে কোন কথা বলেছেন? আমি বললাম, না; তিনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন; কিন্তু আমি সুযোগ দেইনি। মধ্যস্থতাকারী বললেন, আমার মনে হচ্ছে, আপনার জীবন হুমকির সম্মুখীন। আমার ধারণা, আপনার বাড়িতে যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। কাজেই আপনি স্বপরিবারে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যান।

পরদিনই আমরা সেখান থেকে বামনার বাড়িতে চলে যাই। কথাটা এভাবেও বলা চলে যে, আমরা নটিপুরা থেকে বামনায় হিজরত করি।

পর্ব-৫ এখানে.....




Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp