Header Ads Widget

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৭

                                      


                           পর্ব-৭ 

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-২

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৩

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৪

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৫

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৬

১১১১১১১

ফিরোজ আহমাদ বেগ

সীমান্তের ওপার থেকে বেলাল বেগ ফিরে আসার পর তার সশস্ত্র মুজাহিদ হওয়ার গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এবার হেলাল আহমাদ বেগের পর বেলাল আহমাদ বেগের ঘরে হানা পড়তে শুরু করে। হানার সময় ভাইয়ের অবস্থান বলার জন্য আমাদের উপর মারপিট চলতে থাকে। আমি (ফিরোজ আহমাদ বেগ) যথারীতি নিজের কাজ চালিয়ে যেতে থাকি। এক পর্যায়ে নেছার আহমাদ জোগিকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তার মুক্তির জন্য যখন মুশিরুল হক ও খিড়া অপহৃত হয়, তখন আমাদের ঘরে যেনা কেয়ামত শুরু হয়ে যায়। একের পর এক হানা চলতে থাকে। মারপিট, জুলুম-নির্যাতন অব্যাহত থাকে। আমি ও ভাই শাকিল আত্মগোপন করি। শাকিল ও আমার অনুপস্থিতিতে যখন আব্বা-আম্মার উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়, তখন আমিও অস্ত্র হাতে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ভারতীয় ফৌজ ও ফোর্সের অত্যাচার দেখে আমি বললাম, এখন কাশ্মিরের প্রত্যেক মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া দরকার। শিশু-বৃদ্ধ কারুরই আর নিরস্ত্র থাকার সুযোগ নেই। নিজের ইজ্জতের হেফাযতের জন্য নারীদেরও এখনই হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া আবশ্যক।

১৯৯১ সালের জুন মাসে আমি সীমান্তের ওপারে যাই। ক্যাম্পে হাজির হওয়ার দিনকয়েক পর ইখওয়ানুল মুসলিমীনের আমীর হেলাল আহমাদ বেগের সঙ্গে মুজাফফরাবাদে আমার সাক্ষাৎ হয়। আমাকে দেখে তিনি চমকে উঠে বললেন, 'তোমাকে এখানে কে আসতে বলল? পিতামাতাকে কার কাছে রেখে এসেছ? বৃদ্ধ মা-বাবা ছাড়া তোমাদের ঘরে আর কে আছে?'

আমি তাকে বিস্তারিত সব বললাম। তিনি বললেন, 'ঠিক আছে, যখন এসেই পড়েছ দ্রুত প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে পিতামাতার কাছে চলে যাও। ঘরে বৃদ্ধ মা-বাবার তোমাকে একান্ত প্রয়োজন।'

আমি আযাদ কাশ্মির ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে দীর্ঘ এক বছর অবস্থান করি। এক বছর পর যখন আমি শ্রীনগর পৌছি, সে সময় দোরায়ে সোয়ামীকে মুক্ত করে দেওয়া হয়। আমি শুনেছি, তাকে নাকি ইখওয়ানুল মুসলিমীন অপহরণ করেছিল। তার বিনিময়ে ৫জন মুজাহিদকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ডাউন টাউনে জাভেদ আহমাদ শালাহ'র সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি আমাকে তার কাছে রেখে যান। তিনি যখন যে হাইড আউটে থাকছেন, আমাকেও সেখানে সঙ্গে রাখছেন। এ সময়ে একদিন আমার একসঙ্গী গ্রেফতার হয়ে যায়। আমি হাইড আউট পরিবর্তন করে আমীর আকদালের দিকে রওনা হই। বুডশাহ পুলের নিকট পৌঁছলে আমিও ধরা পড়ে যাই। ভারতীয় বাহিনী আমাকে ধরে নিয়ে যায়।

এ ঘটনা ১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাসের। আমার গ্রেফতারির ঘটনা এ-ই প্রথম। আমাকে বুডশাহ পুলের সন্নিকটস্থ উখারা বিল্ডিংয়ে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখান থেকে বের করে গাগরপুল নামক স্থানে এক হোটেলে নিয়ে যায়। আমার দু-চোখে পট্টি বেঁধে দেওয়া হয়। দুবাহু কোমরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। আমাকে মিলিট্যান্ট ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। আমি পরিষ্কার অস্বীকার করি যে, আমি মিলিট্যান্ট নই। তারা অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে আমার থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করে।

আমার কাছে কোনো তথ্য না পেয়ে তারা আমাকে হরিয়ানা পাঠিয়ে দেয়। এখানে আমাকে এত বেশি টর্চার করা হয় যে, আমার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করে। পিঠে গরম ইস্ত্রি রেখে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আমি চিৎকার করতে শুরু করি। ঠিক সে সময় মুখোশপরা দুই যুবককে ভেতরে নিয়ে আসা হয় এবং তাদেরকে আমার পরিচয় দেওয়া হয়, আমি ভয়ঙ্কর মিলিট্যান্ট বেলাল আহমাদের ভাই এবং ইখওয়ানুল মুসলিমীনের আমীর হেলাল বেগের আত্মীয়।

২২২২২২২২২

তারপরই শুরু হয় নির্যাতনের নতুন মাত্রা। আমাকে শিকল দ্বারা বেঁধে ছাদের সঙ্গে ঝুলানো হয়। নিচে একটা টেবিলের উপর জ্বলন্তস্টোভ রাখা হয়। স্টোভের অগ্নিশিখা আমার মাথা স্পর্শ করছে। যখন আমার মাথার চুল পড়তে শুরু করে, তখন আমি স্বীকার করে নিই, হ্যাঁ, আমি মিলিট্যান্ট। তারা আমাকে আমার ও অন্যান্য মুজাহিদদের অস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। আমি আমার অজ্ঞতার কথা জানিয়ে দিই।

আবারও নির্যাতন শুরু হয়ে যায়।

এবার তারা আমাকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে আবার ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে এবং বিদ্যুতের শক দেয়। শক খেয়ে যখনই আমার শরীর কেঁপে ওঠে, সঙ্গে-সঙ্গে তারা আমার শরীরে ছুচালো সুইয়ের খোঁচা মারে। সহ্য করতে না পেরে আমি স্বীকার করে নিই, আমার ব্যক্তিগত সব জিনিসপত্র আমার বাড়িতে রাখা আছে। ফলে রাত দশটার সময় আমাকে গাড়িতে তুলে আমার বাড়িতে নিয়ে যায়। সাত-আট গাড়ি সৈন্য আমার সঙ্গে আসে।

সৈন্যরা আমাদের ঘরটা চারদিক থেকে ঘিরে তল্লাশি শুরু করে দেয়। কিন্তু তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত কিছুই পেল না। অগত্যা আমার ভাই শাকিলকে জিজ্ঞেস করে, তোর ভাইয়ের রাইফেল কোথায়? শাকিল এ ব্যাপারে অজ্ঞতা প্রকাশ করলে সৈন্যরা তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে পদপিষ্ট করে এবং তার হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। তারা আমাদের দু'-ভাইকে ঘরেও বেদম প্রহার করে এবং অর্ধ অচেতন অবস্থায় হরিনওয়াস নিয়ে গিয়ে নির্যাতন চালাতে থাকে। শাকিল পনেরো দিন পর্যন্ত আমার সঙ্গে অবস্থান করে। দুজনকে আলাদা-আলাদা সেলে রাখা হলেও টর্চারের সময় এক কক্ষে নিয়ে আসা হতো।

পনেরো দিন পর শাকিলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে তারা আমাকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করে। তারা আমাকে বলল, তুমি যদি আমাদের তিনজন লোককে ধরিয়ে দাও, তাহলে আমরা তোমাকে প্রচুর অর্থ-সম্পদ দেব, দিল্লীতে থাকার জন্য কোয়ার্টার দেব এবং তোমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করব। চাকরি চাইলে তাও দেব। হেলাল বেগ. জাভেদ শালাহ ও বহেনজীকে আমাদের প্রয়োজন।

আমি বললাম, এই বহেনজী কে?

তারা বলল, তোমার বোন! চেন না বুঝি? ফরীদা যার নাম।

আমি বললাম, এ নামে আমার কোনো বোন নেই।

তারা বলল, কী বলছ তুমি? ফরীদা যদি বেলালের বোন হয়, তাহলে তোমার বোন নয় কেন?

আমি বললাম, না, ফরীদা নামে আমার কোনো বোন নেই।

তারা বলল, ঠিক আছে, বেলালের বহেনজীকে ধরিয়ে দাও।

বললাম, আমি কী করে বলব তিনি কোথায় আছেন?

তারা বলল, তোমার সবই জানা আছে। দেখো বেটা, তুমি যদি বহেনজীকে ধরিয়ে দিতে পার, তাহলে আমরা তোমাকে ছেড়েও দেব আবার পুরস্কৃতও করব।

আমি বললাম, আলুচাবাগে বেলাল নামে কয়েকটা ছেলে আছে। আপনারা কোন বেলালের বোনের কথা বলচেন?

তারা বলল, আচ্ছা, তুমি জাভেদ শালাহ আর খোরশেদ বেগের ঠিকানা বলো।

আমি বললাম, আমি খোরশেদ বেগকে চিনি ঠিক; কিন্তু বর্তমানে সে কোথায় থাকে সঠিক বলতে পারব না। আর জাভেদ শালাহকে আজ পর্যন্ত কখনও দেখেনি।

তারা বলল, হেলাল বেগকে তো জান নিশ্চয়ই?

আমি বললাম, হ্যাঁ, ভালো করেই জানি। শৈশব থেকেই তার সঙ্গে আমার পরিচয়।

তারা বলল, এখন দেখলে চিনবে তো।

আমি বললাম, কেন চিনব না?

তারা বলল, তাহলে আমাদের সঙ্গে চলো; সে কোথায় আছে দেখিয়ে দাও।

আমি বললাম, তিনি তো এখানে নেই। দোরায়ে সোয়ামীর মুক্তির বিনিময়ে জাভেদ শালাহকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তিনি পাকিস্তান চলে গেছেন।

৩৩৩৩৩৩৩৩৩

আমার মুখ থেকে এই জবাব শুনে অফিসার ইন্সপেক্টরকে বললেন, 'ভেতর থেকে আলতাফ খানের ফাইলটা নিয়ে আসো।' খানিজ পর ইন্সপেক্টর আলতাফ খানের ফাইল নিয়ে এলে অফিসার তাতে তার জবানবন্দি পড়ে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'এর বক্তব্য আলতাফ খানের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তার অর্থ হেলাল বেগ এখানে নেই।'

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹

অফিসার নিশ্চিত হয়ে যান, আমি যা বলছি সবই সত্য।

শাকিলের মুক্তির বিশ দিন পর আমার এখানে অনেকগুলো যুবককে একত্রিত করা হয়। তাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা হলো। প্রোগ্রাম হলো, হরিনাওয়াসের সব কয়েদীকে বিভিন্ন জেলে স্থানান্তর করা হবে। আমাকে জন্মগামী দলে শামিল করা হলো। জম্ম নিয়ে যাওয়ার জন্য চোখে পট্টি ও হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে গাড়িতে তোলার আগে আমাদের নাম ডাকা হয়। তন্মধ্যে নূর মোহাম্মদ কালওয়াল, জেনারেল মুসা ও আলতাফ খান আমার পরিচিত নাম। আলতাফ খানের নাম শুনে আমি বেশ আনন্দিত হলাম। কারণ, আলতাফ খান আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সেও হয়ত আমার নাম শুনে খুশি হয়ে থাকবে।

কোর্ট বিলওয়াল পৌছার পর এখনও আমাদের চোখের পট্টি খোলা হয়নি। হাতও বন্ধনমুক্ত হয়নি। ভারতীয় জনতা পার্টি ও শিবসেনার গুন্ডারা এবং সঙ্গে কতিপয় কাশ্মিরি পণ্ডিত আমাদেরকে এমনভাবে মারপিট করে যে, আমরা সবাই রক্তাক্ত হয়ে পড়ি। মারপিটের সঙ্গে তারা আমাদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে থাকে।

ঘটনাক্রমে আলতাফ খানকে আমার সঙ্গে এক সেলে রাখা হয়। অন্যান্য কয়েদীদের মতো আমরা দুজনও রক্তাক্ত, আহত। কিন্তু একে অপরকে পেয়ে আমরা সব দুঃখ-বেদনার কথা ভুলে যাই। এখানে আমরা প্রায় এক বছর অবস্থান করি।

রমযানের এক রাতে আমরা তারাবীহর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময়ে সংবাদ এল, আগামীকাল আমি মুক্তি পাচ্ছি। আলতাফ খানের জন্য সংবাদ এল, তাকে শ্রীনগর স্থানান্তর করা হবে। এ রাতে আমরা একতিলও ঘুমাইনি। দুজন বসে-বসে কথা বলে রাত কাটাই। পরদিন ভোর ছটার সময় আমাদের এয়ারপোর্ট পৌছিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ফ্লাইট না পাওয়ায় তালাবতিলু নামক স্থানে একটি সেলে রেখে দেয়। খাটুয়া জেল থেকে আবদুল মজিদ মীর এবং নাসির আহমাদ বাটকেও এনে আমাদের সঙ্গে রাখা হয়।

পরদিন আমাদের শ্রীনগর পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে আমাদের জেমাইসিতে রাখা হয়। ড. হায়দার, আবদুল মজীদ ও জম্মুর পারভীন নামক এক মহিলাকে পূর্ব থেকেই এখানে রাখা হয়েছে। আমাদের এ সাতজনকে এখান থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

আমরা মুক্তি পাই ১৯৯৩ সালের ১৭ মার্চ। আমি কিছুদিন ওয়ান্টাপুরা অবস্থান করে বামনা চলে যাই। ২৪ ও ২৫ মার্চ মধ্যরাতে হানা হয়। এই হানা-অভিযানে আমাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ধরা পড়ে গেলে আমি জাভেদ আহমাদ শালাহকে বললাম, অনুমতি দিন; আমি ফায়ার করি। তিনি নিষেধ করলেন। কারণ, তাতে ইউসুফ বেগের গোটা পরিবার ধ্বংসের মুখে নিপতিত হওয়ার আশংকা ছিল। তাই আমরা সেই ঝুঁকি না নিয়ে নিজেরাই ধরা দিলাম। তারপর যা ঘটল, তা বর্ণনার অতীত।

কয়েক দিন টর্চারের পর আরও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদেরকে পাপাটু পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সে সময়ে আমি জানতে পারলাম, অস্ত্র দেখানোর জন্য হাইড আউট নিয়ে যাওয়ার সময় পথে জাভেদ আহমাদ শালাহ ও মোহাম্মাদ সিদ্দিকী সুফী পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।

তথ্য আদায় করার জন্য আমাদের উপর যে নির্যাতন চালানো হয়, তা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ ও জুলুম-নির্যাতনের পর আমাকে সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি ১৯৯৪ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পাই।

৪৪৪৪৪৪৪

মোহাম্মাদ মকবুল জান

আমি সব সময় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড তো দূরের কথা, নিজের পারিবারিক ব্যাপার-স্যাপার থেকেও আমি উদাসীন ছিলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে কারখানায় চলে যেতাম আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম। ঘর গেরস্থলির যাবতীয় কর্মকাণ্ড আঞ্জাম দিত আমার স্ত্রী ফরীদা। আমিও কখনও তার কাজে হস্ত ক্ষেপ করতাম না, সেও কখনও কোনো অভিযোগ করত না। আল্লাহ আমাকে অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও বুদ্ধিমতী স্ত্রী দান করেছেন।

আমার স্ত্রী ফরীদা যখন যখন কাশ্মিরের আযাদি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, তখন আমি তার এ কাজেও কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করিনি। সত্য কথা বলতে কি, বিয়ের পর আমি যেখানে প্রতিটি কাজে তাকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছি, তেমনি আযাদি আন্দোলনেও তাকে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিনি। এই আযাদি আন্দোলনকে আমি একটি নেক কাজ মনে করি।

মূলত ১৯৭৭ সাল থেকেই আমার মন-মস্তিষ্ক থেকে হিন্দুস্তানের মানচিত্র মুছে গেছে। আমার এই মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছে একটি ঘটনার সূত্র ধরে। ঘটনাটি হলো, টুরিস্ট সেন্টারের কাছে এক ফৌজি জওয়ান এক মুসলিম স্কুল ছাত্রীর ইজ্জতের উপর হামলা করে। পার্শ্বে দণ্ডায়মান এক ট্যাক্সিচালক এগিয়ে এসে মেয়েটাকে শুধু উদ্ধারই করেনি, লোকটার উর্দি ছিড়ে ফেলে এবং চড়-থাপ্পর দিয়ে বিদায় করে দেয়। শেষ পর্যন্ত লোকটা পালিয়ে প্রাণরক্ষা করে।

সন্ধ্যার সময় সৈন্যটি তার ইউনিটের অন্য সদস্যদের নিয়ে আসে। এসেই তারা এলাকায় তাণ্ডব শুরু করে দেয়। টুরিস্ট সেন্টার থেকে নিয়ে লালচক পর্যন্ত যত গাড়ি পেল সব ভেঙ্গে ফেলে এবং চালকদের মারধর শুরু করে দেয়। লালচক পৌঁছে সেখানকার ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে আগুন ধরিয়ে দেয়। আইনের লোকদের এই ধ্বংসযজ্ঞ, তাণ্ডব ও বে-আইনী কর্মকাণ্ড দেখে এলাকাবাসী হতভম্ভ হয়ে যায়। শেখ আবদুল্লাহসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি অবহিত করেও কোনো কাজ হয়নি। শত চেষ্টা করেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা যায়নি।

আমি তখনই উপলব্ধি করেছি, ভারতের মানচিত্র একদিন ছিঁড়ে যাবে। কাশ্মিরি মুসলমানদের বাঁচতে হলে কাশ্মিরকে আযাদ করতেই হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জুলুমের নৌকা যখন ভরে ওঠে, তখনই তা ডুবে যায়। এখন আমার আকাঙ্ক্ষা, ভারতের জুলুমের নৌকা করে ডুববে, সেই দৃশ্য সচক্ষে দেখা।

৫৫৫৫৫৫৫৫৫৫৫৫৫

শাকিল আহমাদ বেগ

আমি সীমান্তের ওপারে কিংবা এপারে না কোনো অস্ত্রপ্রশিক্ষণ নিয়েছি, না সক্রিয়ভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছি। আমি স্বাধিকার আন্দোলনকে সমর্থন করে আসছি শুধু। আমি বিবাহিত। স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে। সংসার নিয়েই আমি সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকি। বাটামালু নামক স্থানে আমি মিস্ত্রির কাজ করতাম। যখন থেকে আমার বুঝ-বুদ্ধি হয়, তখন থেকেই আমি জনসাধারণের ওপর আগ্রাসী সরকারের নির্যাতন দেখে আসছি। কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকায় আমি না কখনও সেই নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছি, না কখনও কোনো প্রতিবাদে অংশ নিয়েছি। আমি মনে-মনেই জ্বলতে থাকি।

মুসলিম মুত্তাহাদা মাহায-এর পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হলো। নির্বাচন হলো। আমি দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া পর্যন্ত নিজের তৎপরতাকে সীমাবদ্ধ রাখি।

এজাজ ডার-এর শাহাদাতের পর যখন কাশ্মিরে সশস্ত্র আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করে, তখন প্রথম-প্রথম আমি সেই আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ আস্থা আনতে পারিনি। আমার ধারণা ছিল, এ আন্দোলন জাতির কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে সক্ষম হবে না। অথচ আমার ছোট ভাই ও বড় বোন এই আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী।

আমার ভাই বেলাল আহমাদ বেগ যখন সীমান্তের ওপারে চলে যায় এবং সেখান থেকে আমার কাছে পত্র পাঠায়, তখন আমি টের পাই, 'ডাল মে কুচ কালা হ্যায়'। আমি অনুভব করি, কিছু একটা হচ্ছে এবং হবে। সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে আমার বোন ফরীদার বাড়ি তার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়ে যায়। বোন ফরীদার বাড়িতে হানা পড়তে শুরু করে। যেহেতু আমার বোনের বাড়ি, তাই আমি হানা-তল্লাশিতে নির্যাতনের শিকার হই। ছোট ভাই ফিরোজ বেগের গ্রেফতারির পর আমিও নিজঘরে আক্রমণের শিকার হই এবং প্রথম আঘাতেই আমার হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। তখন আমার বুঝে আসে কাশ্মিরের প্রতিটি নাগরিকের জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া কেন আবশ্যক। মুজাহিদদের ঠিকানা এবং ফিরোজের রাইফেল কোথায় আছে বলে দেওয়ার জন্য ইন্টারোগেশন সেন্টারে আমার উপর এত নির্যাতন করা হয় যে, আমি বাঁচার আশাই ত্যাগ করি। আমি মনে করি, ইন্টারোগেশন সেন্টার থেকে যদি কেউ নিরাপদ ফিরে আসে, তাহলে বুঝতে হবে, এ এক মস্তবড় কারামাত।

বেলাল ও ফিরোজের গ্রেফতারির পর ঘরে আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এবং আমার ছোট ছোট সন্তান আছে। সে কারণে পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে মুক্ত করে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

এ ব্যাপারে নজির সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। তিনি আর্মি অফিসারদের ২৫ হাজার টাকা দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে আনেন।

ভারতীয় বাহিনী ও অন্যান্য ফোর্সের কাছে বেগ পরিবার এখন হিটলিস্টে। তাই মুক্তির মাত্র অল্প কদিন পর পুনরায় ক্র্যাকডাউন দিয়ে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমার চোখে পট্টি বেঁধে ইন্টারোগেশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হেলাল বেগ ও বহেনজীর ঠিকানা বলার জন্য আমার উপর নির্মম নির্যাতন শুরু করা হয়। প্রথম জিজ্ঞাসাবাদেই আমার উভয় বাহুর জোড়া আলাদা করে ফেলা হয়।

পরে এই জোড়া যথাস্থানে স্থাপন করতে অনেক সময় ব্যয় হয়। আমি চিৎকার শুরু করলে আমার মুখের মধ্যে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তাতে মুখে ও তালুতে জখম হয়ে যায়। এত কিছু করেও যখন তারা স্বস্তি পাচ্ছিল না, তখন পরনের কাপড় খুলে আমাকে ছাদের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। নিচে মাথার কাছে জ্বলন্ত স্টোভ রাখা হয়। আগুনের তাপে যখন আমার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন সহ্য করতে না পেরে আমি বেলাল ও বহেনজীকে দেখিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করি।

শিকল খুলে যখন আমাকে তাদের ঠিকানা বলার জন্য বলা হয়, তখন আমি অজ্ঞাত প্রকাশ করি। এবার তারা ক্ষিপ্ত হয়ে লাথি দিয়ে-দিয়ে

পর্ব-৮ এখানে........



Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp