কুরআনের আলোয় তালাক ও হিল্লা

 



কুরআনের আলোয় তালাক ও হিল্লা
লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ

বন্ধুগণ,
মানুষ যখন তালাক নিয়ে কথা বলে, তখন তার কণ্ঠে রাগ, ক্ষোভ ও বিচারচিন্তা থাকে।
কুরআন যখন তালাক নিয়ে কথা বলে, তখন তার ভাষা শান্ত, ঠান্ডা, ধৈর্য ও ন্যায়ের।
এ দু’টি পথ দুই পৃথিবী।
এক পথে তাড়াহুড়া।
অন্য পথে চিন্তা।
এক পথে মানুষের তৈরি আইন।
অন্য পথে আল্লাহর সীমা।
আজ আমরা সেই আল্লাহর সীমায় ফিরে আসব।
আমরা দেখব— কুরআন কীভাবে তালাককে নিয়ন্ত্রণ করে, কোমল করে, ধীর করে।
আর হিল্লা নামের প্রচলিত অপমানজনক রীতিকে কীভাবে নিষিদ্ধ ও ভঙ্গ করে।

বন্ধুগণ,
তালাক মানে রাগ নয়।
তালাক মানে ছুরি নয়।
কুরআন তালাককে তিন ধাপের দীর্ঘ সিঁড়ির মতো সাজিয়েছে।
যেখানে প্রতিটি ধাপে মানুষকে ভাবতে হয়, ঠান্ডা হতে হয়।
“فأمسكوهن بمعروف أو سرحوهن بمعروف”
(বাকারাহ 2:229)
সুন্দরভাবে রাখো অথবা সুন্দরভাবে ছাড়ো।
দেখুন, দুটো শব্দ— “মা‘রূফ”— সুন্দর।
এ যেন কুরআন বলছে:
তালাক দেবে?
ঠিক আছে।
কিন্তু সৌন্দর্য হারাবেনা।
অন্য মানুষকে কষ্ট দেবে না।
অপমানের পথ নেবে না।

বন্ধুগণ,
প্রথম তালাকের পর ইদ্দত আসে।
ইদ্দত মানে—
সময়ের দেয়ালে মাথা ঠেকে যাওয়া।
সময়ের ঠাণ্ডা বাতাস।
রাগের আগুন নিভে যাওয়ার সুযোগ।
কুরআন বলে—
“لَا تَدْرِي لَعَلَّ اللَّهَ يُحْدِثُ بَعْدَ ذَٰلِكَ أَمْرًا”

(তালাক 65:1)
তুমি জানো না— হয়তো আল্লাহ নতুন কিছু ঘটাবেন।
এটাই ইদ্দতের রহস্য।
এটা তালাকের বিরোধিতা নয়—
বরং ভাঙা সম্পর্ককে সময় দেওয়া।
হয়তো আজ রাগ হয়েছে,
কিন্তু কাল তুমি তাকে ছাড়াই থাকতে পারবে না।
এ কারণে ইদ্দত কুরআনের সবচেয়ে মানবিক আইনের মধ্যে একটি।

বন্ধুগণ,
এই ইদ্দতের সময় স্বামীর অধিকার থাকে—
স্ত্রীকে আবার ফিরিয়ে নেওয়ার।
কুরআন বলে—
“وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ

(বাকারাহ 2:228)
অর্থাৎ স্বামী আয়েশে-নায়েশে নয়, বরং ভালো অভিপ্রায়ে ফিরিয়ে নিতে পারে।
এটাকে কুরআন অনুমোদন দিয়েছে—
কারণ পরিবার ভাঙতে সে চায় না।
এ যেন আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা:
"ভুল হলে ঠিক করো।
একটি শব্দের কারণে জীবনকে ভেঙো না।"

বন্ধুগণ,
যদি প্রথম তালাকের পরে মিলন না হয়,
সম্পর্ক ঠান্ডা হয়ে থাকে—
তবে সে তালাক দাঁড়িয়ে যায়।
এটা কোনো নাটক নয়।
এটা সময় ও বিবেচনার ফলাফল।
তখন নারী চাইলে নিজের মতো জীবন চলাতে পারে।
তার সম্মান অটুট।
তার ভবিষ্যৎ অটুট।
তার পথ খোলা।
এবং সে চাইলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে—
শান্তিপূর্ণ, স্বাভাবিক, প্রকৃত বিবাহ।

বন্ধুগণ,
দ্বিতীয় তালাকও একইভাবে।
একই নিয়ম, একই ইদ্দত, একই ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ।
কুরআনের সিস্টেম একদম পরিষ্কার—
প্রথম তালাক → ইদ্দত → ফিরিয়ে নেওয়া যায়।
দ্বিতীয় তালাক → ইদ্দত → ফিরিয়ে নেওয়া যায়।
তৃতীয় তালাক → চূড়ান্ত।
এটাই “تِلكَ حُدُودُ اللَّهِ”— আল্লাহর সীমা। (বাকারাহ 2:229)
এই সীমা ভাঙা মানে সুস্পষ্ট অন্যায়।

বন্ধুগণ,
এখন মানুষ আসে আর যুক্তি দিয়ে বলে— তিন তালাক একবারে হয়ে যায়।
এক নিঃশ্বাসে তিন শব্দ।
কিন্তু কুরআন কি কখনো বলেছে—
এটা বৈধ?
কুরআনে তো বারবার ধাপ ধাপ করে বলা হয়েছে।
সময়ের বিরতি রাখা হয়েছে।
সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে।
ইদ্দতের কথা বলা হয়েছে।
আর মানুষ বলছে—
এক বসায় তিন তালাক।
এটা কি আয়াতের সাথে খেলা নয়?

কুরআন সতর্ক করে—
“وَلَا تَتَّخِذُوا آيَاتِ اللَّهِ هُزُوًا”

(বাকারাহ 2:231)
আল্লাহর আয়াত নিয়ে উপহাস করো না।
এক বসায় তিন তালাক—
এটাই সেই উপহাস।

বন্ধুগণ,
এখন আসি সবচেয়ে অপমানজনক বিষয়— হিল্লার বিষয়ে।
এই সমাজে কিছু লোক এমনভাবে হিল্লাকে তুলে ধরে,
যেন এটিই ধর্ম।
যেন আল্লাহ এটাই চেয়েছেন।
কিন্তু কুরআন হিল্লাকে যে ভাষায় বাতিল করেছে,
মানুষ তা ভুলেই গেছে।

কুরআন বলে—
“فَإِن طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِن بَعْدُ حَتَّىٰ تَنكِحَ زَوْجًا غَيْرَهُ”

(বাকারাহ 2:230)
এই আয়াতের মানে কী?
মানুষ বলে—
অন্য স্বামী দিয়ে এক রাতের অভিনয়!
কুরআন কি কখনো বলেছে—
“এক রাতের জন্য বিয়ে করাও”?
“শয্যায় নেওয়া বাধ্যতামূলক”?
“পরের দিন তালাক দিয়ে দাও”?
না!
এটা কুরআন নয়।
এটা সমাজের জাহেলিয়াত ।
এটা মানুষের কল্পিত শোষণ। এটা একটা জুলুম।

বন্ধুগণ,
এ আয়াতের প্রকৃত অর্থ হলো—
যদি স্ত্রী সত্যিকারভাবে আবার দাম্পত্য জীবন শুরু করে অন্য স্বামীর সাথে,
স্বাভাবিকভাবে,
ভালোবাসা ও দায়িত্বের বন্ধনে—
তাহলে আগের স্বামীর সাথে পুনরায় বিবাহ সম্ভব।
এটা “স্বাভাবিক জীবন” শর্ত—
দেহগত নাটক নয়।
এক রাতের ‘নাট্য-বিয়ে’ কখনো নিকাহ নয়।

নিকাহ মানে দায়িত্ব।
নিকাহ মানে পরিবার।
নিকাহ মানে প্রতিশ্রুতি।
আর হিল্লা মানে হলো অপমান।

বন্ধুগণ,
কুরআন নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য কঠোর ভাষা ব্যবহার করেছে।
একটি আয়াত দেখুন—
“ولا تمسكوهن ضرارًا لتعتدوا”

(বাকারাহ 2:231)
তোমরা নারীদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আটকে রাখো না।
হিল্লা ঠিক সেই ক্ষতি।
এতে নারী তার সম্মান হারায়।
সে হয় এক পুরুষের শয্যার থেকে অন্য পুরুষের শয্যার ‘সেতু’।
এটা কি মানবিক?
এটা কি ধর্ম?

বন্ধুগণ,
যে ধর্ম নারীর মুখে সম্মান ঢালে,
যে কুরআন নারীর প্রতি সুন্দর আচরণকে বাধ্যতামূলক করে,
সে ধর্ম কি কখনো বলবে—
"তাকে অন্য পুরুষের সাথে রাত কাটিয়ে তারপর ফিরিয়ে আনো”?

কুরআন বারবার বলে—
معروف
সুন্দর ব্যবহার।
এমনকি তালাকেও।
আর হিল্লা কি সুন্দর ব্যাবহার? নাকি জঘন্য রিতি-
হিল্লা হলো সুন্দর ব্যবহারের বিপরীততম রূপ।

বন্ধুগণ,
এখন আমরা সেই জায়গায় আসি যেখানে কুরআন তালাকের পরও নারীর অধিকার নিশ্চিত করেছে।
কুরআন বলে—
“وَلِلْمُطَلَّقَاتِ مَتَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ

(বাকারাহ 2:241)
তালাকপ্রাপ্ত নারীদের সম্মানজনক বিদায় সুবিধা দাও।
এটা আল্লাহর হুকুম।
এটা নারীর মর্যাদা।
এটা তালাকের পরও এক ধরনের করুণা।

আর হিল্লা?
যেখানে নারীকে অপমান করা হয়।
এটা কুরআনের বিপরীত দিক।

বন্ধুগণ,
কুরআন এমনকি তালাকের পরও নতুন জীবনের আশ্বাস দেয়।
“وَيُغْنِ اللَّهُ كُلًّا مِّن سَعَتِهِ”

(নিসা 4:130)
আল্লাহ উভয়কে তাঁর প্রাচুর্য দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন।
এটাই তালাকের প্রকৃত দর্শন—
বিদায় নয়, নতুন শুরু।

বন্ধুগণ,
যে কুরআন নতুন শুরু শেখায়,
সে কুরআন হিল্লার মতো কৃত্রিম, অপমানজনক, বলপূর্বক পুনর্মিলনের পথ কখনোই গ্রহণ করেনি।
হিল্লা হলো মানুষের তৈরি জুলুম,
যেখানে নারী হয় জুলুমের শিকার।
তার ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই।
তার ভবিষ্যৎকে সমাজের নিয়মের কাছে বলি দেওয়া হয়।
কুরআন এমন শোষণ চায় না।

বন্ধুগণ,
হিল্লার নামে কত নারী কান্না করেছে।
কত পরিবার ভেঙে গেছে।
কত মানুষ ধর্মের নামে ভ্রান্ত পথে গেছে।
তাদের চোখে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের তৈরি নিয়ম।
কিন্তু কুরআন?
সে ছিল নির্মল।
সে ছিল সহজ।
সে ছিল করুণাময়।

কুরআন শুধু বলেছিল—
তালাক তিনবার হলে সম্পর্ক শেষ।
তারপর নারী তার পথ বেছে নেবে।
তারপর সে চাইলে নতুনভাবে জীবন শুরু করবে।
এই পর্যন্তই।

বন্ধুগণ,
এই আয়াত— 2:230—
যা মানুষ হিল্লার সমর্থনে ব্যবহার করে,
সেই আয়াতই প্রমাণ করে হিল্লা বৈধ নয়।
কারণ আয়াতে কোথাও শর্ত নেই যে
নতুন স্বামী তাকে অবশ্যই তালাক দেবে।
কোথাও নেই যে সে অবশ্যই প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে আসবে।
বরং কুরআন বলছে—
"নতুন জীবন গড়ো,
যদি সেই জীবন কোনো কারণে ব্যর্থ হয়,
তবে নতুন সিদ্ধান্ত নাও।”
এটাই স্বাধীনতা।
এটাই মর্যাদা।

বন্ধুগণ,
হিল্লা বিয়ে মূলত নারীর প্রতি শাস্তি।
কুরআন শাস্তি দেয় না—
কুরআন ন্যায় দেয়।
কুরআন সম্মান দেয়।
কুরআন স্বাধীনতা দেয়।

কুরআন কখনোই বলবে না—
“প্রথম স্বামীর কাছে ফিরে যেতে হলে রাতে অন্য পুরুষের সাথে শুতে হবে।”
এটা মানুষের কল্পিত নোংরা ব্যাখ্যা।

বন্ধুগণ,
কুরআন মানুষকে সতর্ক করে দিয়েছে—
“تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا

(বাকারাহ 2:187)
এগুলো আল্লাহর সীমা—
এই সীমা তোমরা অতিক্রম করো না।

হিল্লা সেই সীমা অতিক্রমের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
কারণ এতে নারীকে ব্যবহার করা হয়,
তার দেহকে খেলনা বানানো হয়,
ধর্মের নামে।

বন্ধুগণ,
এবার সত্যটা বলি—
তালাকের পর যদি নারী অন্য কাউকে বিয়ে করে,
স্বাভাবিকভাবে করে,
তার সাথে জীবন গড়ে,
তারপর যদি সে বিবাহ ভেঙে যায়—
তাহলে প্রথম স্বামীর সাথে পুনর্মিলন বৈধ।
এটা স্বাভাবিক জীবনচক্র।
কুরআনের ন্যায্যতা।

কিন্তু হিল্লা—
এটা জোর করে তৈরি “বিয়ে-তালাক যন্ত্র”。
এটা আল্লাহর আইন নয়।
এটা মানুষের বাণিজ্য।

বন্ধুগণ,
কুরআনের তালাকব্যবস্থা মানবিক।
প্রগতিশীল।
পরিকল্পিত।
ধাপে ধাপে সাজানো।
এতে কোনো জুলুম নেই।
কোনো অপমান নেই।
কোনো জোরজবরদস্তি নেই।
তাই তালাকের সাথে হিল্লার কোনো সম্পর্ক নেই।
একটি আল্লাহর দান—
অন্যটি মানুষের বানানো কারাগার।

বন্ধুগণ,
শেষে একটি কথাই বলব—
কুরআন তালাক দিয়েছে,
হিল্লা দেয়নি।
কুরআন পুনর্মিলন দিয়েছে,
জোর করে ‘এক রাতের নাটক’ দেয়নি।
কুরআন সম্মান দিয়েছে,
অপমান নয়।
কুরআন মানুষকে মুক্ত করেছে,
খাঁচায় ভরেনি।

তুমি যদি সত্য জানতে চাও—
তালাক কুরআনিক।
হিল্লা মানব-সৃষ্ট অত্যাচার।

Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

সমাজে সততা ও ইমানের গুরুত্ব  লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ
Chat with us on WhatsApp