Header Ads Widget

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৯

                                       


                           পর্ব-৯ 

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-২

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৩

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৪

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৫

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৬

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৭

▶️ কাশ্মীরি মেয়ে ফরিদা। পর্ব-৮

Click Here

কি বলতে পারেন, আপনার কী-কী খোয়া গেছে এবং কত ক্ষতি হয়েছে?

আপনার ঘর থেকে কী-কী জিনিস তুলে নেওয়া হয়েছে?

আমি বললাম, ঘরে আমার আছে-ই বা কী, বিছানাপত্র আর পরিধানের কাপড় ছাড়া?

অফিসার বলল, নগদ টাকা, সোনা-দানা ও মালামাল ইত্যাদির বিস্তারিত বিবরণ দিতে পারবেন?

আমি বললাম, যতটুকু মনে আছে, বলতে পারব। নগদ টাকা কত ছিল বলতে পারব না। কারণ, তা রেখেছিলেন আমার স্বামী। আমি সোনা- রূপা ও অন্যান্য জিনিসপত্রের কথা বলতে পারব।

অফিসার কোমল কন্ঠে বলল, দেখুন, আপনার প্রতি আমার পূর্ণ সহানুভুতি আছে। কিন্তু আমি আপনার তেমন কোনো উপকার করতে পারব না। কারণ, আমি মুসলমান অফিসার। আপনার পক্ষে কথা বললে অন্যরা মনে করবে, আমি আপনার দলের লোক। আমি শুধু এতটুকু করতে পারি যে, আমি জেনারেল অফিসার কমান্ডারকে আপনার কাছে নিয়ে আসব। আপনি তাকে সবকিছু খুলে বলবেন। আমার ধারণা, বিষয়টি তার নলেজে গেলে কিছু না কিছু ফেরত পেতে পারেন। তারপরও যদি না পান, তাহলে মনে করতে হবে, আপনার ঘরে কিছুই ছিল না।

আমি বললাম, ঠিক আছে, আপনি তা-ই করুন, আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব।

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹

বিএসএফ-এর এই মুসলমান অফিসার যখন আমার সঙ্গে এসব কথা বলছিল, তখন বাইরে অনেক লোক জড়ো হয়ে গেছে। অনেক মহিলা ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাচ্ছে। মসজিদ কমিটির এক কর্মকর্তা ফোর্সকে বলছেন, আপনারা কাল রাত থেকে মা-মেয়েকে আবদ্ধ করে রেখেছেন, এখন আমাদের ভেতরে যেতে দিন। আমরা তাদের খবরাখবর নেই। এমন সময় আমার মায়ের কণ্ঠ ভেসে এল। তিনি কাকে যেন বলছেন, আমাকে আমার মেয়ে ও নাতনীর সঙ্গে দেখা করতে দাও, আমাকে ভেতরে যেতে দাও।

আওয়াজ চিনতে পেরে আমি অন্য এক অফিসারকে বললাম, আমার মাকে ভেতরে আসতে দিন।

অফিসার বলল, আপনার মা কে? বাইরে তো অনেক মহিলা।

আমি বললাম, বাইরে গিয়ে বলুন, ফরীদার মা ভেতরে যেতে পারেন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় কয়েকজন মহিলার সঙ্গে আমার মা ঘরে প্রবেশ করেন। মাকে দেখামাত্র আমি তার গলা জড়িয়ে ধরি। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। আমি তাকে বারণ করে বললাম, না মা! কাঁদবেন না। আমাদের পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে।

মায়ের সঙ্গে আসা মহিলারা আমার অবস্থা জানতে চায়। জিজ্ঞেস করে, আমার সঙ্গে তারা কোনো অসদাচরণ করেছে কিনা।

আমি তাদেরকে বললাম, আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ আমাদের ইজ্জত রক্ষা করেছেন। মারধর আর গালি-গালাজকে পরোয়া করি না।

এক মহিলা বলল, আমরা রাতভর তোমাদের চিন্তায় অস্থির ছিলাম। কিন্তু কী করব। বাইরে বের হওয়া তো দূরের কথা, ঘরের জানালা পর্যন্ত খোলার অনুমতি ছিল না। এখন এলাকার মানুষজন ও তোমার আত্মীয়- স্বজন সবাই বাইরে এসে জড়ো হয়েছে।

আমার মা বললেন, বাইরে কয়েকজন সাংবাদিক এসেছে। ফটো সাংবাদিকও আছে। কিন্তু তাদের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।

মা ও প্রতিবেশী মহিলাদের পেয়ে আমার হালে পানি আসে। তারা সবাই মুজাহিদদের গ্রেফতারি ও অস্ত্রের ডিপো বেহাত হয়ে যাওয়ায় আফসোস করছিলেন এবং আমার নিকট ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনতে চাচ্ছেন। আমি তাদের ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে বললাম, এটি বিরাট এক দুর্ঘটনা অবশ্যই। আমি একে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলব। তবে সাহস হারাবার কোনো কারণ নেই। আজ আমরা তাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছি, আমরা তাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কাল ইনশাআল্লাহ এর বিপরীত ঘটনা ঘটা বিচিত্র নয়। যুদ্ধে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক।

আমি মাকে বিশেষ এক মিশনে পাঠিয়ে দিই, যেন তিনি অন্যান্য মুজাহিদদের এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন এবং তাদের সাবধান থাকতে বলেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে এ দায়িত্ব আমি নিজে পালন করতাম। কিন্তু এখন তো আমি অবরুদ্ধ। আমার তো নড়াচড়া করারও অনুমতি নেই।

সন্ধ্যায় ইফতারের সময় এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি পান। তারা আমাদের জন্য ইফতারি ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু আমরা মা-মেয়ে আগেই পানি পান করে ইফতার করে ফেলি। আমরা নামায আদায় করলাম। সবাই আমাদের কিছু খেয়ে নিতে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। কিন্তু আমার মুখে খাবার উঠছে না। ছয়জন মুজাহিদ ও পরিবারের যে সদস্যদের কাল সন্ধ্যায় নিরাপত্তা হেফাযতে নিয়ে যাওয়া হলো, না জানি তারা কী হালে আছে। আমি তাদের চিন্তায় অস্থির। কী জানি তারা এ পর্যন্ত না খেয়ে আছে কিনা। ঠিক এমন সময় সৈন্যরা আমার পুত্র মাসাররাতকে বাড়িতে এনে রেখে যায়। মাসাররাত ঘরে প্রবেশ করে। আমি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। জিজ্ঞেস করি, তোর বাবা, অন্য সবাই কেমন আছে? মাসাররাত সংক্ষেপে জবাব দেয়, সব ঠিক আছে, সবাই ভালো আছে।

আমি একজন-একজন করে নাম ধরে ধরে কে কেমন আছে জানতে চাইলে ছেলে আমাকে নিশ্চয়তা দেয়, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, তারা সবাই ভালো আছেন। প্রত্যেককে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। আমিও তাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাকে শিশু মনে করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

মাসাররাতের বক্তব্য শুনে আমি ও সায়েমা খেতে শুরু করি। মাসাররাতকেও খেতে বললাম। কিন্তু সে বলল, আমি খাব না, এইমাত্র খেয়ে এসেছি। আমি পীড়িপীড়ি করলে মাসাররাত বলল, আপনি নিশ্চিন্ত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

আসলে মাসাররাত আমাদের মন রক্ষা করার জন্য মিথ্যা বলেছিল। প্রকৃতপক্ষে বিগত দুদিন যাবত সে কোনো খানা-ই খায়নি। সে শুধু সকলের অমানুষিক নির্যাতনই প্রত্যক্ষ করেনি, তার নানাজানের লাশও স্বচক্ষে দেখে এসেছে। পরে সে বলেছিল, বন্দুকের বাঁট দিয়ে নানাজানের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তখন তিনি লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পাঠ করে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নানার লাশ দেখে এসেও আমাদের অবস্থা দেখে সাময়িকের জন্য সে মিথ্যা বলেছিল, যাতে আমরা শান্তমনে ইফতার করতে পারি ও খানা খেতে পারি।

Click Here

আমরা যথারীতি সাহরীর সময় পানি পান করে পরদিনের রোযার নিয়ত করি। পরদিন ভোরে একটি কোম্পানী ডিউটির জন্য আসে। আগের কোম্পানী হেড কোয়ার্টারে ফিরে যায়। এ কোম্পানীতে দুজন শিখ অফিসার ছিল। তারা আমার ঘর ও আশপাশের দায়িত্ব হাতে তুলে নিলে আমি শিখ অফিসারদ্বয়কে বললাম, আপনারা এখানে কেন এসেছেন? আগের কোম্পানী তো সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। এখন আপনাদের নেওয়ার মতো কিছু নেই। একের পর এক কোম্পানী আসার অর্থ কী?

শিখ অফিসার জবাব দেয়, এখন আমরা এই ঘরের ভিটা খুঁড়ে, দেওয়াল ভেঙ্গে গোলা-বারুদ বের করব। এখানে আমরা অনেক কিছু পাব। আমি তাদের সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হলে তারা ওয়াকিটকির মাধ্যমে হেড কোয়ার্টারে সংবাদ জানায়, বহেনজি আমাদের এখানে আসায় আপত্তি তুলছে এবং কঠোর ভাষা ব্যবহার করছে। ওখান থেকে জবাব আসে, ওকে চুল ধরে টেনে-হেঁচড়ে এখানে নিয়ে আস, আমরা তাকে মজা দেখাব।

আমি তাদের নিকট থেকে সরে মায়ের কাছে চলে যাই। মা আমাকে বললেন, থাক, ওদের সাথে কড়া কথা বলিস না। অন্যথায় তারা তোকেও নিয়ে যাবে। নীরবে পরিস্থিতির মোকাবেলা কর, তা-ই ভালো।

বাইরে ধীরে-ধীরে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। তারা বিক্ষোভ শুরু করে দেয়। তারা দাবি তোলে, আমাদের মহিলাদের অবরোধ থেকে মুক্ত করো। অন্যথায় আমাদের ভেতরে ঢুকতে দাও।

আমাদের আন্ডার-গ্রাউন্ড থেকে অস্ত্রের ডিপো উদ্ধার হওয়া এবং কয়েকজন মুজাহিদ গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ স্থানীয় পত্রপত্রিকা ছাড়াও জাতীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংবাদ ছিল সেদিনের প্রধান আলোচ্য বিষয়। আশপাশ ও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আমাদের খবর জানতে ছুটে আসে। সাংবাদিক এবং ফটোগ্রাফাররাও এসে ভিড় জমায়।

দেশের বিভিন্ন স্থান ও বিভিন্ন অবস্থানের মুজাহিদরা পত্রিকার মাধ্যমেই সংবাদ জেনে ফেলেছে। জাবেদ শালাহ, আলতাফ, শাব্বির, মোহাম্মাদ সিদ্দীক, হুসাইন ও ফিরোজের গ্রেফতারির সংবাদ ছড়িয়ে পড়ামাত্র তাদের মুক্তির জন্য স্থানে-স্থানে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় ও মিছিল বের হয়।

এ রাতও অতিক্রান্ত হওয়ার পর সাহরীর সময় আমরা এক গ্লাস করে পানি পান করে রোযার নিয়ত করি।

এখন দুরাত অতিক্রম করে তার পরের দিন শুরু হয়েছে। সকাল নটা। বামনা থেকে আমাদের এক আত্মীয় মহিলা এসে সংবাদ বলে, এ ঘরের মালিক মারা গেছে। আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। কক্ষে উপস্থিত সব মহিলা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।

'এ ঘরের মালিক মারা গেছে' শুনে প্রথমে আমার মন ধাবিত হয় মকবুল জানের প্রতি। কারণ, আমার স্বামী মকবুল জানই তো এ ঘরের মালিক। আব্বাজানের কথা চিন্তাও করিনি

কক্ষে আমার মা, মেয়ে সায়েমা ও আরো কয়েকজন মহিলা বুক চাপড়ে কাঁদছেন। আমি কিছু সময় আত্মভোলার মতো বসে থাকি। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটা দিই। কিন্তু কেউ আমাকে বাধা দিল না। না কোনো সিপাহী বা অফিসার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছ?

আমি সোজা কোম্পানীর কমান্ডারের নিকট গিয়ে বললাম, আমি কন্ট্রোল রুমে গিয়ে ওখান থেকে আমার স্বামীর লাশ আনতে চাই। এক্ষুনি আমার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করুন।

সে সময়ে আমার বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভিড় ছিল। তাদের কেউ আমাকে চিনে, কেউ চিনে না। তারা এসেছে ফরীদা আপাকে দেখার জন্য। আমি বের হওয়ামাত্র তারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

এ মুহূর্তে আমার ঘরে কিছুই নেই। আমার সর্বস্ব লুট হয়ে গেছে। স্বামী মারা গেছেন। ভাই-পুত্র ও দেশের মুক্তি আন্দোলনের মুজাহিদরা ইন্টারোগেশন অতিক্রম করছে। আমি এখন একা ও নিঃস্ব।

এক পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে তার গাড়িতে তুলে কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যায়। আমি কন্ট্রোল রুমে গিয়ে উপনীত হই। একটা ট্রাকে লাশ রাখা আছে। আমি ট্রাকে চড়ে স্বামীর লাশ দেখার জন্য লাশের উপর থেকে চাদরটা সরিয়ে ফেলি। কিন্তু এ কী! এ তো আমার স্বামীর নয় পিতা ইউসুফ বেগ-এর লাশ। আমার সেই রুগ্ন বৃদ্ধ পিতার লাশ, যার ব্যাপারে আমার আশা ছিল, লোকটির স্বাস্থ্য ও বয়সের প্রতি রক্ষ্য রেখে ওরা তাকে ছেড়ে দেবে। কিন্তু...।

পিতার লাশ দেখে আমার মনে প্রচণ্ড একটা ধাক্কা লাগে। আমার চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়। মাথায় কে যেন হাতুড়িপেটা করতে শুরু করে। কলিজাটা চুরমার হয়ে যায়। তবে অল্পক্ষণের মধ্যেই আত্মসংবরণ করে পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, এই লাশ ছাড়া অন্য কোনো লাশ আছে কি? বলল, এ পর্যন্ত কন্ট্রোল রুমে এই একটি লাশই এসেছে।

আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, আত্মীয়-স্বজনদের কেউ আছে কিনা। দেখলাম, মামা আছেন, যিনি আমার আগেই এসে পৌঁছেছেন। আমি আমার পিতার লাশ নিয়ে রওনা হলাম। ড্রাইভারকে বলে দিলাম,

আমাদের আলুচাবাগ পৌছিয়ে দাও। আমাদের সঙ্গে পুলিশ ছিল। শহীদের মৃতদেহ যখন আলুচাবাগ পৌঁছে, তখন বাড়িটা লোকে লোকারণ্য। পুরুষ-মহিলা-বৃদ্ধি-শিশু সবাই

আছে। নেই শুধু শহীদের তিন পুত্র, দুই নাতী ও জামাতা। অর্থাৎ শহীদের পরিবারের পুরুষদের কেউই নেই। কাঁধে করে পরজগতে রেখে আসার জন্য ইউসুফ বেগ-এর আপন বলতে কেউ নেই। আমি পিতার মৃত্যুতে হা-হুতাশ করার পরিবর্তে পুত্র, ভাই ও স্বামীর লাশের অপেক্ষায় উৎকণ্ঠিত হয়ে আছি আর ভাবছি, পিতার লাশের পর না জানি এবার কার লাশ আসে! যে জালিমরা বৃদ্ধ ও রুগ্ন পিতাকে রেহাই দিল না, তারা যুবক ও বালকদের ছাড়বে কেন?

আমি মায়ের মুখোমুখি হতে পারছিলাম না। তাকে আমি সান্ত্বনা দিতে পারছিলাম না। নিহত বাবাকে নিয়ে আমার ভাববার ফোরসত নেই। আমার অপেক্ষা আরও লাশের, উৎকণ্ঠা মুজাহিদদের নিয়ে, তারা যার অবস্থান বদল করে নিরাপদে অবস্থান নিল কিনা! আমি কন্ট্রোল রুমের সংবাদের অপেক্ষা করছি এবং ভাবছি, কে জানে এবার ওখান থেকে কার লাশ নিয়ে আসতে হয়।

কিন্তু পিতার জানাযা ও কাফন-দাফন পর্যন্ত আর কোনো সংবাদ আসেনি। আমি নিজেই পিতার লাশের খাটিয়া কাঁধে তুলে নিই। লোকেরা আমাকে বারণ করল। প্রচণ্ড বরফপাতের মধ্যেও হাজার-হাজার মানুষ উপস্থিত। খাটিয়া কাঁধে নেওয়ার লোকের অভাব নেই। কিন্তু এ মুহূর্তে আমি যেন নারী নই পুরুষ। পুত্র ও জামাতার অভাব পূরণ করার জন্য আমি খাটিয়া কাঁধে নিই। লাশটা কবরস্তান পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়ে আমি ফিরে আসি।

শরীয়তে সিদ্ধ না হলেও আমাদের সমাজে 'চারদিনা' পালনের প্রথা রয়েছে। আমি এসবের কোনো গুরুত্ব দেই না। পিতার 'চারদিনা' পালনেরও আমার ইচ্ছে ছিল না। কারণ, কাজটা একে তো অনর্থক, দ্বিতীয়ত আমার ভাবনা ও উৎকণ্ঠা বন্দীদের নিয়ে। কে বলবে কখন কার লাশ এসে হাজির হয়। তৃতীয়ত এ মুহূর্তে আমি কপর্দকশূন্য। আমি বেজায় অস্থিরতার মধ্যে সময় অতিবাহিত করছি। এমন সময় এলাকার এক ব্যক্তি কিছু টাকা আমার হাতে তুলে দেয়। গুণে দেখি, ত্রিশ হাজার। আমি দশ হাজার টাকা রেখে বাকি টাকা ফিরিয়ে দিলাম। বললাম, আল্লাহ আপনাকে জাবায়ে খায়ের দান করুন। আমার আপাতত দশ হাজার টাকাই যথেষ্ট। আমি হালুয়া-রুটি প্রস্তুতির কাজে আত্মনিয়োগ করলাম।

আগামীকাল পিতার 'চারদিনা' অনুষ্ঠান। সকাল ৯টা ফাতেহাখানির সময় নির্ধারিত। সন্ধ্যায় ইফতারের সময় মসজিদ থেকে ঘোষণা এল, কন্ট্রোল রুমে চারটি লাশ এসে পৌঁছেছে। স্বজনরা শনাক্ত করে নিয়ে আসুন।

আমি কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। আমাদের কে কে হতে পারে? আমি আত্মসংবরণ করে বোরকাটা গায়ে জড়িয়ে কন্ট্রোলরুমে যাওয়ার জন্য উদ্যত হই। কিন্তু আমাকে বাধা দেওয়া হলো। আমি আর গেলাম না। মহল্লার কিছু লোক গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসে বলল, লাশের মধ্যে বেগ পরিবারের কেউ নেই। বামনা থেকে যে মুজাহিদদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদেরও কেউ নয়।

আমি আশ্বস্ত হতে পারলাম না। আমার মস্তিষ্ক বেকার হয়ে আছে। আমি ভাবনার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি।

পরদিন ভোর থেকেই লোকদের আগমন শুরু হয়ে যায়। অনুষ্ঠানটা আগাগোড়া আমাকেই পরিচালনা করতে হবে। শুধু অন্দর মহলেই নয়- পুরুষ মহলেও আমাকে যাওয়া-আসা করতে হচ্ছে। আমার একপা একঘরে তো অপর পা আরেক ঘরে।

অনুষ্ঠানে বেশকিছু মুজাহিদও উপস্থিত হয়েছে। বিভিন্ন মুজাহিদ পরিবারের অনেক সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজনরা এসেছে। বিভিন্ন জিহাদি সংগঠনের অন্তত পঁচিশজন মুজাহিদ দেখে আমি শংকতি হয়ে পড়লাম, পাছে এখানে হানা পড়ে যায় কিনা।

Click Here

এমন সময় আমি নারী মহলে ঢুকে দেখি, আমার মাকে ঘিরে বসে আপন-প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা আমার বিরুদ্ধে নানারকম মন্তব্য করছে- "তোমার এমন স্বচ্ছল পরিবারটার কী হয়ে গেল! কার চোখ পড়ে গেল! তোমার কিসের অভাব ছিল! এ ঘর থেকে কত অভাবী-অসহায় মানুষের অভাব পূরণ হতো!

ঘরে চাল-ডাল খেয়ে কতই-না সুখে ছিলে, আর আজ...!

খামোখা একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লে!

স্বাধীনতাকামী কে নয়? আমরাও তো স্বাধীনতাকামী। কিন্তু আমরা আমাদের গৃহকে মুজাহিদদের আখড়া বানাতে দিইনি। মুজাহিদদের ঘরে জায়গা দিলে এই পরিণতিই হয়!

মুজাহিদদের সাহায্য কর ভালো কথা, কিন্তু নিরাপদ দূর থেকে। তাদেরকে ঘরে স্থান দেওয়া বিপদ ডেকে আনার শামিল। দেখলেনই তো আপনার পরিবারটার কী দশা হলো!

'গৃহকর্তা খুন হলেন। অন্য পুরুষরা বন্দী। আল্লাহ জানেন তাদের কী অবস্থা!'

'হিন্দুস্তানী ফৌজের সঙ্গে লড়াই করা সহজ কথা নয়। ফৌজের সঙ্গে ফৌজই লড়াই করতে পারে!'

'প্রতিদিন কত লোক মারা যাচ্ছে, কত ঘর-বাড়ি আগুনে পুড়ছে! এ পর্যন্ত এই আন্দোলন দিয়ে লাভটা কী হয়েছে?'

এ সমস্ত মন্তব্য শুনে আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কথাগুলো আমার হৃদয়ে বিষাক্ত তীরের মতো বিদ্ধ হচ্ছিল। যেখানে আমাদের সান্ত্বনা দেওয়া দরকার, সেখানে কিনা মাকে ঘিরে বসে মহিলারা কলিজায় শর বিদ্ধ করছে। আমি অত্যন্ত মর্মাহত হলাম। আল্লাহর নিকট ধৈর্য ধারনের তাওফীক কামনা করলাম। কিন্তু সহনশক্তি যখন সীমা ছাড়িয়ে গেল, আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আমি আবেগাপ্লুত হয়ে তাদের উদ্দেশে বললাম-

"আমি উপস্থিত সম্মানিতা মহিলাদের উদ্দেশে কিছু কথা বলতে চাই। বিশেষত সেই মহিলাদের উদ্দেশে, যারা আমার মায়ের চারপাশে উপবিষ্ট আছেন। আমি জানি, আপনারা সবাই আমাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করতে এসেছেন। আমি আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। আল্লাহ আপনাদের নিরাপদ ও সুখে রাখুন। কিন্তু পাশাপাশি আমি একটি দুঃখজনক বিষয়ও প্রত্যক্ষ করছি। আমি আজ তিন দিন যাবত লক্ষ্য করছি, আমাদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশার্থে আগত কিছু লোক বিশেষত কতিপয় মহিলা সমবেদনা প্রকাশের আড়ালে আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছেন। তারা নানাভাবে আমাদের চিন্তা-চেতনায় আঘাত হানার চেষ্টা করছেন। সোজা কথায়, তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে জিহাদ ও মুজাহিদদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, যা সহ্য করা আমার সাধ্যের অতীত। স্বাধীনতা আন্দোলন ও জিহাদ-মুজাহিদদের বিরোধী বক্তব্য নীরবে সহ্য করা আমার পক্ষে মোটেই সম্ভব নয়। কাজেই কারো সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির পরোয়া না করে আমি বলতে চাই, আমাদের এই আযাদি আন্দোলনে যাদের সমর্থন নেই, তারাই কথায়-কথায় এর বিরোধিতা করে থাকেন। যাদের বাপ-ভাই-পুত্র-স্বজন কেউ শহীদ হয়নি, তারাই বেশী প্যাঁচাল পাড়েন। যাদের গৃহ লুণ্ঠিত হয়নি, তারাই নিজের ঘরের দরজা মুজাহিদদের জন্য বন্ধ করে রাখেন। মনে রাখবেন, যেকোনো আন্দোলনে উত্থান-পতন একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের এই আন্দোলনও যে সফলতা লাভ করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর পরিণতি উলটোও হতে পারে। তবে আমি পূর্ণ আশাবাদী যে, ভারতকে একদিন না একদিন কাশ্মির ছাড়তেই হবে। সেই দিনটি কবে আসবে কেউ বলতে পারবে না। সেই দিন কাশ্মিরে কত মানুষ বেঁচে থাকবে, তাও বলতে পারি না। মনে রাখবেন, আযাদি কুরবানি চায়। আযাদির এ লাড়াইয়ে আমরা এমন একটি জাতির মুখোমুখি, যারা ইসলাম ও মুসলমানদের ঘৃণ্যতম দুশমন।

আমি আগেও বলেছি, আজও বলছি, এখনও কিছুই হয়নি। সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন পিতামাতার চোখের সামনে সন্তানকে জবাই করা হবে। পিতার সম্মুখে কন্যার, ভাইয়ের সম্মুখে বোনের সম্ভ্রমহানি করা হবে। আমার বাড়ি-ঘর ও পরিবারের দৃষ্টান্ত তো আপনাদের চোখের সামনেই রয়েছে। আমার পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। স্বামী, তিন ভাই ও দুই পুত্রের কী অবস্থা, তাদের পরিণতিইবা কী হবে, জানি না। আমার সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয়েছে। আমার মাথার ওড়না কেড়ে নেওয়া হয়েছে। লাখ টাকার মালিক আজ পিতার 'চারদিনা' পালনের জন্য ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছি। ক্রন্দন-হাহুতাশ ও আফসোস করার প্রয়োজন তো ছিল আমার। কিন্তু কাঁদছে তারা, যাদের হাতের তালুতে একটা অঙ্গারও রাখা হয়নি।

Click Here

আযাদি আন্দোলনের বিরোধিতা ঐসব সুহৃদ পুরুষ ও মহিলারা করছেন, যারা এই আন্দোলনকে দূর থেকে দেখছেন আর নিজেদের সন্তান-স্বজনদের ফৌজ ও ফোর্সের ছায়া থেকে নিরাপদ রাখার পন্থা অবলম্বন করছেন। আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, এই যে মুজাহিদ, যাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, আমি যদি তাদের সঙ্গ না দিতাম, তাহলে আমার এই পরিণতি ঘটত না, তারা কি এসব তাদের আরাম-আয়েশের জন্য করছে? বলুন, জবাব দিন। তারাও মা, যারা নিজ সন্তানদের নিরাপদ রাখার জন্য আঁচল তলে আগলে রাখেন। আবার এমনও মা আছেন, যারা ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের স্বার্থে কলিজার টুকরো সন্তানদের নিজহাতে সাজিয়ে জিহাদ করার জন্য ময়দানের উদ্দেশ্যে রওনা করিয়ে দেয়।

যেসব মা নিজ সন্তানদের নিরাপদ রাখার পন্থা খুঁজে বেড়ান, তারাই মুজাহিদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দোষ-ত্রুটি নিয়ে মাতামাতি করেন। আমাদের যে সন্তানরা যুদ্ধের ময়দানে অবতরণ করেছে, তারা আমাদের ভবিষ্যৎ ও অনাগত বংশধরদের জন্য নিজের প্রিয় জীবন কুরবান করছে। তারা যেপথ অবলম্বন করেছে, তা শুরু ও শেষ কুরবানির পথ। আর তারা কুরবানি এজন্য দিচ্ছে যে, যাতে এ দেশবাসীর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গোলামি থেকে মুক্তি লাভ করে ইজ্জত ও সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতে পারে। যারা দেশের আযাদি আন্দোলনের বিরুদ্ধাচারণ করে থাকে, তারা আমাদের বন্ধু হতে পারে না। যারা মুজাহিদদের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে বেড়ায়, তারা আমাদের শত্রু। এমন ব্যক্তিদের প্রতি আমার অনুরোধ, আপনারা আমাদের নিয়ে মাথা ঘামানো ত্যাগ করুন, আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দিন।

আমার এই বক্তব্যে যদি কেউ মনে কষ্ট পেয়ে থাকেন, আমি তাদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমার জীবন কাশ্মিরের আযাদির জন্য উৎসর্গিত। আমাকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কেউ চেষ্টা করবেন না। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক পথের দিশা দিন এবং সত্য পথে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।

[সমাপ্ত]



Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp