Header Ads Widget

▶️ আধার রাতের বন্দিনী। পর্ব-৪ 🌹

 


(ঐতিহাসিক বীরাঙ্গনা সায়েমার এই উপন্যাস টি যারা পরছেন- তাদের উদ্যেশ্যে বলি। এটা আধার রাতের বন্দিনী পর্ব-৪। যারা ৩ নম্বর পর্ব পড়েননি তারা নিচে ক্লিক হেয়ারে চাপ দিয়ে পর্ব-৩ পড়ে আসুন।) 

আধার রাতের বন্দিনী-৩

[নয়]

ছায়েমা ও জাফর ভাইকে রাতের প্রথম ভাগের পাহারার দায়িত্ব দেয়া হল। বাকি দু'জন নৌকায় শুয়ে পড়ল। গভীর রাত। কারো চোখে ঘুম নেই। আমি ছটফট করে এপাশ-ওপাশ করছি। জেনারেল সাহেব আমাকে বললেন, "কি খোবায়েব! ঘুমাচ্ছ না যে?" আমি বললাম, স্যার! খুব অস্থিরতা অনুভব করছি। বড় ধরনের আক্রমণের আশংকা করছি। তিনি বললেন, "হ্যাঁ, আমার অবস্থাও তাই। যাও ওদেরকে ডেকে আন।" আমি ছায়েমা ও জাফর ভাইকে ডেকে আনলাম। তারপর ইয়ার মোহাম্মদ গোভী সকলের মনের অবস্থা জিজ্ঞেস করলেন। সকলের জবান থেকে একই কথা বের হয়ে আসে।

ছায়েমা বলল, "দুশমনের গতিবিধি লক্ষ্য রাখা দরকার। অন্যথায় ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে।"এক বাক্যে সকলেই ছায়েমার কথায় সমর্থন জানালাম। এখন কে যাবে, তা নিয়ে পরামর্শ করা হল। আলোচনা-পর্যালোচনার পর আমাকেই সাব্যস্ত করা হল। ছায়েমা আমার সাহায্যে সঙ্গে যেতে চাইছে আমীরে ফয়সাল ইয়ার মোহাম্মদ গোভী নিষেধ করলেন। তাই আছি একাই যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। ছায়েমা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল "ভাইয়া! দশদিক আঁধারে ছেয়ে আছে। একা একা এ গভীর অরণ কিভাবে পাড়ি দেবে? সাপ-বিচ্ছু ছাড়াও হিংস্র প্রাণীর ভয় আছে।" আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, নিশ্চয়ই আল্লাহ আমাকে হেফাজত করবেন। তোমরা দোআ করতে থাক।



ছায়েমা নিজ হাতে কমিউনিস্ট মার্কা পোশাকটি আমার গায়ে পরিয়ে দিল। চোখের পানি সামলিয়ে রাখতে ব্যর্থ হল সে। তার গণ্ডদয় গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা তপ্ত অশ্রু আমার পদযুগলে পতিত হল। আমি মাথা তুলে তার দিকে তাকাতেই সে চেহারা ঘুরিয়ে নিল। আমি তারে সান্ত্বনা ও অভয় দেয়ার চেষ্টা করলাম। ছায়েমা আমার হাত দু'টি চেপে ধরে করুণ সুরে বলল, "খোবায়েব ভাইয়া! তুমি যে আমার একমাত্র দুঃখের সাথী। তুমি যে আমাকে সুনিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছ। তুমি যে একা একা দুশমনের ভেতর থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় আমাকে উদ্ধার করেছ। ভাইয়া, তোমাকে দুশমনের এলাকায় পাঠিয়ে আমি কি করে শান্তিতে থাকতে পারি?"

আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বিদায় নিলাম। ছায়েমা আমার পথপানে অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে। আমি হারিয়ে গেলাম অন্ধকারে। সামান্য পথ অগ্রসর হতেই অনুভব করলাম, পেছন দিক থেকে কে যেন এদিকে ছুটে আসছে। পায়ের শব্দ পেলাম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি ছায়েমা। এ কি! তুমি আবার আসছ যে? সে আমার হাতে একটি পুটুলী গুঁজে দিয়ে বলল, "কয়েকটি রুটি দিলাম, রাস্তায় খেয়ে নিও। আর এখানে কয়েকটি ডলার আছে, প্রয়োজনে খরচ কর।" এই বলে সে চলে গেল। তার বিচক্ষণতা দেখে আমি অবাক হলাম। আমি তাড়াহুড়া করে চলে এসেছি। কিছুই সাথে আনিনি।

আমি বনের ভেতর দিয়ে চলছি। সাথী একমাত্র আল্লাহ। ভীষণ অন্ধকার। কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। লতাগুল্ম বারবারই আমার পা জড়িয়ে ধরছে। সামনে চলতে বাঁধার সৃষ্টি করছে। চলার গতি রোধ করে দিচ্ছে। কন্টকাকীর্ণ পথ। শত্রুতাবশত যেন আমার পা ফুটো করে দিতে চাইছে। কিন্তু জুতো থাকার কারণে তা পারছে না। তবে জামা-কাপড় আঁকড়িয়ে ধরতে একটুও দ্বিধা করছে না। এভাবে সবগুলো বাধা অতিক্রম করে আমি এগিয়ে চলছি। আমার পায়ের শব্দে বন্য প্রাণীরা হুমড়ি খেয়ে পালাচ্ছে। পাখিরা ভয়ে ডানা মেলে পত পত আওয়াজ করে উড়ছে। কেউটেরাও আমার পথ ছেড়ে গর্তে লুকাচ্ছে। এভাবে বন- জঙ্গল পেরিয়ে যখন আমি সমতল ভূমিতে এসে পৌঁছি, তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

আরো কিছু পথ অগ্রসর হওয়ার পর শহরতলীর বাতিগুলো আবছা আবছা নজরে পড়তে শুরু করে। আমি আরো দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। ফজরের সময় আলমাআতা এসে পৌঁছলাম। নামাযের জন্য একটি মসজিদে গিয়ে অযু করে সুন্নত পড়ে বসে রইলাম। হায়! আযান হল না। মুসল্লীরও কোন খোঁজ নেই। হঠাৎ মনে পড়ল সেদিনের কথা, শহরের মসজিদগুলোর কথা। আযান দিলে তো আর রক্ষা নেই। তাই একা একা নামায আদায় করে নিলাম। কোথায যাব, কি করব ভাবছি। অবশেষে চাচার বাসায় যাওয়ার চিন্তা করলাম। হয়ত সেখানে গেলে কোন সংবাদ পেতে পারি। তাই বিলম্ব না করে সোজা চাচার বাসায় চলে গেলাম। চাচা সবেমাত্র নামায পড়ে তছবিহ পাঠ করছেন। তিনি হঠাৎ আমাকে দেখে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "বাবা! তুমি ফিরে এসেছ? তোমার চিন্তায় তো আমরা অস্থির। প্রতিদিন তোমার পথপানে চেয়ে চেয়ে প্রহর গুনছি।" চাচা নাস্তার জন্য হুকুম দিলেন। আমি বললাম, না চাচা, নাস্তার প্রয়োজন নেই, আমার নিকট নাস্তা আছে। এই বলে পুটুলি খুলে রুটি বের করে চাচাকে নিয়ে খেলাম। তারপর শহরের অবস্থা জানতে চাইলাম।

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹


চাচা বললেন, "জামিউল উলুম মাদ্রাসায় সেনাবাহিনীরা ক্যাম্প তৈরি করেছে। ওরা দশ-বারজন সৈন্যকে মুজাহিদদেরকে ধরে আনতে অরণ্যে পাঠিয়েছিল। সেখানে মুজাহিদরা আস্তানা গড়ে তুলেছে। হাজার হাজার মুজাহিদ জঙ্গলে রয়েছে। মুজাহিদদের পাকড়াও করতে দশ- বারজন শত্রুসৈন্য কিনা খোয়া গেছে। তাই আলমাআতার সবগুলো সেনা ছাউনীতে হৈ চৈ পড়ে গেছে। দাবানলের মত সমস্ত আলমাআতায় ছড়িয়ে পড়েছে এ সংবাদ। তাই বড় বড় জেনারেলগণ জরুরী পরামর্শ
মিটিং তলব করেছেন। আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুজাহিদদেরকে গ্রেফতার করতে। জেনারেল মার্শাল বোদায়েভের নেতৃত্বে এ অভিযান চালান হবে। তিনি একজন নাস্তিক, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। তার নাম জানে না এমন লোক কাজাকিস্তানে নেই। তার নেতৃত্বেই শত শত আলেমের শাহাদাতবরণ করতে হয়েছে। মা-বোনদের ইজ্জত হারাতে হয়েছে। মুসলমানদের ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। লুণ্ঠন করেছে অগণিত দোকানপাট। বন্ধ করে দিয়েছে শত শত মসজিদ-মাদ্রাসা।

কথিত আছে, সরকারী পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা দাড়ি রাখত এবং ঢিলা পোষাক পরত, তাদেরকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে কেরসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে হত্যা করেছে। একজন বন্দী বলেছিলেন, 'দাড়ি রাখার অপরাধে আমাকে যদি হত্যা করা হয়, তবে আমি বলব প্রথমে জাতির কলংক বিশ্ব বেঈমান রাশিয়ার ফেরাউন অবাঞ্ছিত লেনিনকে হত্যা করা হোক। তার মুখেও দাড়ি রয়েছে।' এ কথার উত্তরে জেনারেল মার্শাল বোদায়েভ বলেছিলেন, 'তোমার দাড়ি আরবের মোহাম্মদের দাড়ির মত। তাই তুমি অপরাধী। আর লেনিনের দাড়ি তেমন নয়। লেনিনের মুখে অসংখ্য ব্রণ রয়েছে, দেখতে খুবই বেমানান ও কুৎসিত, তাই ব্রণ ঢাকার জন্য সে দাড়ি রেখেছে। এ দাড়ি মৌলবাদী দাড়ি নয়।'

জেনারেল মার্শাল বোদায়েভ কয়েক প্লাটুন সৈন্য তলব করে আলমাআতায় নিয়ে এসেছে। এদের মধ্য থেকে দু'হাজার পঁচিশজনকে বাছাই করে অরণ্য অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাছাইকৃত রণকৌশলীদেরকে আরো মজবুত করার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিচ্ছে। জেনারেল নিজেই প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে। এ অভিযানে কি কি অস্ত্র ব্যবহার করা হবে, তা অন্যান্য জেনারেলদের সাথে পরামর্শ করে সাব্যস্ত করেছে। উক্ত অভিযানের নকশা প্রণয়নের জন্য তিনজন কমান্ডো নিযুক্ত করা হয়েছে। এরা অরণ্য ভূমি প্রদক্ষিণ করে নকশা তৈরি করবে। একদিনের মধ্যে খসড়া জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। তিনজনকে তিনটি তাজি ঘোড়া দেয়া হয়েছে অরণ্যে যাওয়ার জন্য। এসব পরামর্শ হচ্ছিল আলমাআতা জামেউল উলুম মাদ্রাসায় বসে। এলাকায় সন্ত্রাসী আর মস্তানরা সবসময় সেনা ছাউনীতে যাতায়াত করে,
পথঘাট দেখায়, বাজার-সওদা করে দেয়, মুসলমাদের নাম লিস্ট করে ওদের হাতে দেয়। এলাকার গুপ্তচরবৃত্তির কাজ ঐসব বখাটে ছেলেরাই করে। চাচাজান এসব গোপন তথ্য বাড়িওয়ালার ছোট ভাই থেকে সংগ্রহ করেছেন। আগামীকাল সকাল সাতটায় তিনজনের গোয়েন্দা টিম তথ্য সংগ্রহের জন্য জঙ্গলে যাবে।"

চাচার কথাগুলো শুনে আমার শরীর শিউরে উঠল। বুক দুরু দুরু কাঁপছে। আমরা মাত্র চারজন আর দুশমনের সংখ্যা দু'হাজার পঁচিশ। তাদের সাথে মোকাবেলা করা কিভাবে সম্ভব?

আমি নতশীরে এসব চিন্তা করছি। হঠাৎ মনে এক নতুন সাহস, নতুন বল ও নতুন আশার সঞ্চার হল। আল্লাহ আছেন। আল্লাহ সবসময় দুর্বলদের সাহায্য করেন। আবরাহার হস্তিবাহিনীকে তিনি পরাভূত করেছেন আবাবীল পাখি দ্বারা। ফেরাউনকে ধ্বংস করেছেন পানি দ্বারা। নমরূদকে খতম করেছেন ল্যাংড়া ও কানা মশা দ্বারা। আবু জাহেলকে হত্যা করেছেন অপ্রাপ্তবয়স্ক দু'বালক দ্বারা। আল্লাহ বড় বড় শক্তিগুলোকে ছোট ছোট শক্তি দ্বারা খতম করিয়ে তাঁর কুদরত জাহির করেছেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদেরকেও সাহায্য করবেন। এসব কথা বারবার আমার মনের মধ্যে উদয় হচ্ছিল। মনে হল আল্লাহর পক্ষ থেকেই কুদরতী এসব যুক্তি ও চিন্তা আমার দিলে আসল। তাই মুহূর্তের মধ্যে আমার মনের সমস্ত ভয় ও সংশয় উধাও হয়ে গেল।

আমি চাচাকে বললাম, আমাকে এখনই ফিরে যেতে হবে। হয়ত সাথীরা খুব চিন্তা করছেন। চাচা জিজ্ঞেস করলেন, "বাবা! তুমি না একা, সাথী পেলে কোথায়?" আমি চাচাকে সব ঘটনা খুলে বললে তিনি খুশীতে আত্মহারা হয়ে গেলেন। সংবাদ নিয়ে সাথীদের নিকট যাওয়ার জন্য দ্রুতগামী একটি ঘোড়া নিয়ে এলেন। ঘোড়াটা দেখতে খুবই সুন্দর। আমি কোনদিন ঘোড়ায় চড়িনি। কিভাবে চড়তে হয়, তাও জানি না। চাচাকে আমার সমস্যাগুলো খুলে বললাম। চাচা উত্তর দিলেন, "বাবা! তোমাকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও ভদ্র ঘোড়া দিয়েছি, যেন কোন অসুবিধা না হয়।"

তিনি একটি লাল তাজী ঘোড়ার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকলেন। আমি নিকটে গিয়ে দাঁড়ালে চাচা ঘোড়াকে লক্ষ্য করে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, "ইনি দ্বীনের মুজাহিদ, আল্লাহর সৈনিক। এখন থেকে ইনি তোমার সহিস, তোমার মালিক, তার কথা মতো চলবে।"

ঘোড়া কথাগুলো কান পেতে শুনছিল। চেয়ে দেখি, ঘোড়ার চোখ দিয়ে টপ টপ করে অশ্রু ঝরছে। ঘোড়া যে মানুষের কথা বুঝে, এত যে প্রভুভক্ত তা শুধু পুস্তকে পড়েছি, চোখে দেখিনি। ঘোড়া আমার পায়ে দু'তিনবার মাথা ঠুকাল। কারণ কিছুই বুঝিনি। চাচা বললেন, "বাবা! ঘোড়া তোমাকে প্রভু হিসেবে বরণ করে নিয়েছে।"

এখন আর দেরি করা ঠিক হবে না। আমি চাচাকে সালাম দিয়ে বিদায় নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসলাম। ঘোড়া আমাকে নিয়ে ঠক্ ঠক্ করে দৌড়াচ্ছে। আহ! কি আনন্দ! আমি শুধু লাগাম টেনে ধরলাম। লাগামের সাহায্যেই ডানে-বাঁয়ে পরিচালনা করছি। শহরকে বাঁয়ে ফেলে গ্রামের মেঠোপথ বেয়ে এগিয়ে চলছি। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেলাম।

আমার সাথীরা ঘোড়ার পদধ্বনিতে ভয় পেয়ে গেল। ওরা ভাবছে আর রক্ষা নেই, নিশ্চয়ই লাল বাহিনী ছুটে আসছে তাদের ধরতে। সকলেই পজিশন নিয়ে অপেক্ষা করছে। বীরাঙ্গনা ছায়েমাও ক্লাশিনকভ নিয়ে বড় একটি বৃক্ষের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুটা নিকটে আসলেই তার কাঙ্খিত মানুষটিকে আল্লাহর দেয়া দূরবীনের রেঞ্জে নিয়ে আসে। আমি প্রথমে ওকে চিনতে পারিনি। আরো একটু নিকটে এলে ছায়েমা তার মেয়েসুলভ অভিনব ভঙ্গিতে আমার সামনে দাঁড়াল। আমি সালাম দেয়ার আগেই সে সালাম দিয়ে মুচকি হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, "মুজাহিদ ভাইয়া! ফিরে এসেছ। এত তাড়াতাড়ি আসবে তা তো ভাবিনি।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, এত দূরে এসে একা একা দাঁড়িয়ে আছ কেন? সে উত্তর দিল, "তোমাকে হারিয়ে কি আমি নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারি?"

আমি জিজ্ঞেস করলাম, নৌকা এখান থেকে কতদূর? অন্য সাথীরা কেমন আছেন? ছায়েমা উত্তর দিল, "তারা সবাই ভাল আছেন।" আমি ছায়েমাকে ঘোড়ায় উঠার জন্য বললাম। সে আমার পেছনে উঠে বসল। ঘোড়া তার মেজাজ মত সামনে চলল। অল্পক্ষণেই নৌকায় এসে পৌঁছলাম। আমি ঘোড়া থেকে নেমে ঘোড়াটিকে কাঁচা ঘাসে বেঁধে দিয়ে নৌকায় গিয়ে বসলাম। জাফর ভাই ও ইয়ার মোহাম্মদ এগিয়ে এলেন। সালাম-মুসাফাহা সেরে কুশল বিনিময় করলাম। ছায়েমা তাড়াতাড়ি খানা নিয়ে এসে বলল, "ভাইজান! ক্ষুধায় তো চোখ দু'টি বেরিয়ে গেছে। আগে খেয়ে নিন, তারপর কথা হবে।"

আমি খানা খেতে বসলাম। বাকি সবাই আমার পাশে এসে বসল। ছায়েমা খানা পরিবেশন করছে। খানা শেষ করে আমরা জরুরী পরামর্শে বসলাম। সকলেই সংবাদের অপেক্ষায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমার সংক্ষিপ্ত সফরের বর্ণনা দিয়ে বললাম, অরণ্যভূমিতে জেনারেল মার্শাল বোদায়েভ দু'হাজার পঁচিশজন জানবাজ সৈন্য নিয়ে ক্র্যাকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে নিজেই সৈন্যদের উচ্চতর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনজন কমান্ডো কিছুক্ষণের মধ্যেই জঙ্গলে আসবে। ওরা সবাই ঘোড়সওয়ার। রিপোর্ট নিয়ে সেনাপতির হাতে পৌছানোর জন্য একদিন সময় দিয়েছে। এতে মনে হয়, আজ বিকেল বা আগামীকালের মধ্যে ক্র্যাকডাউন দেবে।

ছায়েমা তার ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে বলল, "এখন আটটা বাজছে। তাদের ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার এখনো এক ঘন্টা বাকি। আর এ পর্যন্ত পৌঁছতে আরো প্রায় এক ঘন্টা লেগে যাবে। আমাদের হাতে দু'ঘন্টা সময় আছে। এর মধ্যে যদি প্রস্তুতি নিতে পারি, তবে তিনজনকেই রেখে দিতে পারব। আমার খেয়াল, যেভাবেই হোক ওদেরকে রেখে দিতে হবে।"

আমীরে ফয়সাল ইয়ার মোহাম্মদ গোভী ছায়েমার পরামর্শ গ্রহণ করলেন। মোহতারাম আমীর সাহেব তেজোদীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলেন, "ভাইয়েরা আমার! মার্শাল বোদায়েভ একজন নাস্তিক, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। সে ইসলাম ও মুসলমানের অনেক ক্ষতিসাধন করেছে। তার অত্যাচার আজ শুধু আলমাআতায় নয়, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, আজারবাইজান, তাসখন্দ, সমরকন্দ, বোখারা, বাকু, কালছায়ী, আরালন, মাকাট, জাইলওয়ারদা, মইন্টি ও কারাজালসহ আরো অনেক মুসলিম জনপদে। মুসলমান আজ নির্যাতিত, অসহায়, মজলুম। তাদের পাশে দাঁড়ান সকল মুসলমানদের উপর ফরয ও ঈমানী দায়িত্ব। মুসলমাদেরকে উদ্ধার করার মত কেউ নেই। মুসলিম দেশগুলো বিশেষ করে রাষ্ট্রপ্রধানরা কাফিরদের গোলামে পরিণত হয়েছেন। দুনিয়া আজ হারিয়েছে খালিদ বিন ওলিদকে, তারেক বিন জিয়াদকে, ওমর বিন খাত্তাবকে, মোহাম্মদ বিন কাসিমকে। তাছাড়া আরো অগণিত বীর পুরুষদেরকে, যাদের হুংকারে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত কাফির দুনিয়া থর থর করে কাঁপত। আমাদেরকেই আজ তাদের ভূমিকা পালন করতে হবে।"



আমীর সাহেবের ভাষণে সকলের মাঝে নতুন জযবা ফিরে এল। মৃতপ্রাণে বইতে লাগল শোণীত ধারা। ছায়েমা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, "দুশমন হয়ত অনেক পথ এগিয়ে এসেছে। আমাদের অতি তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়া দরকার।" আমীরে ফয়সাল ইয়ার মোহাম্মদ সাহেব সায়েমার কথায় সায় দিয়ে বললেন, "আমাদের পাশের সরু খালটি আঁকাবাঁকা হয়ে গভীর অরণ্যের বুক চিরে অনেক দূর চলে গেছে। আমাদের একজন নৌকা নিয়ে ভেতরে ঢুকে যাবে তাতে নৌকা ও ছামানার হেফাজত হবে। আর বাকি তিনজন অস্ত্রসজ্জিত হয়ে দুশমনের আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে। আমাদের অস্ত্র থাকবে এসআর, এলএমজি ও ক্লাশিনকভ। গ্রেনেড আর মাইনও সাথে নিতে হবে। তাছাড়া যোগাযোগের জন্য ওয়ারলেস অবশ্যই রাখতে হবে।"

আমি আমীর সাহবেকে প্রশ্ন করলাম, নৌকা পাহারা দেবে কে? আমীর সাহেব বললেন, "আমাদের মাঝে বয়সে যে সবারই ছোট, তাকেই এ দায়িত্ব দেয়া হল।"

আমীর সাহেবের নির্দেশক্রমে ছায়েমাকে নৌকার হেফাজতে পাঠিয়ে দিলাম। আর আমরা ছামানাপত্র নিয়ে অরণ্যাভিমুখে রওনা হলাম।

আমরা জঙ্গলের শেষপ্রান্তে চলে এসেছি।। আর মাত্র চার-পাঁচশ' গজ দূরেই সমতল ভূমি আরম্ভ হয়ে আলমাআতা পর্যন্ত বিস্তৃত। আমীর সাহেব দুশমনের আগমনের সম্ভাব্য রাস্তায় আমাকে ও জাফর ভাইকে এমবুশ লাগানোর নির্দেশ দিয়ে বলে দিলেন, আমার বাঁশির আওয়াজ শোনামাত্র ব্রাশফায়ার শুরু করবে। আমি ঘোড়া নিয়ে পেছনের দিক চেক দেব, যেন ওরা পালাতে না পারে। ওরা জরিপ শেষ করে ক্যাম্পে ফেরার পথে আক্রমণ করতে হবে। তাহলে জরিপ রিপোর্টটিও আমাদের হস্তগত হবে। হয়ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে যাব।”
আমি জাফর ভাইকে নিয়ে কাঁটা ও লতাপাতাপূর্ণ এক অন্ধকার ঝোঁপের অভ্যন্তরে গিয়ে ফায়ার পজিশনে জমিনে শুয়ে পড়লাম। আমীর সাহেব ঘোড়া নিয়ে চলে গেলেন পেছনের দিকে।

সকাল ৯টা পেরিয়ে যাবার উপক্রম, দুশমন এখনো আসেনি। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ জাফর ভাই হাতের ইশারায় কি যেন বললেন, এমন সময় ইথারের ঢেউয়ে ভেসে আসল অশ্বের পদধ্বনি ও ঘন্টির আওয়াজ। অল্পক্ষণ পরেই চেয়ে দেখি অস্ত্র সজ্জিত তিন অশ্বারোহী কমান্ডো। ভয়ে বুক থর থর করে কাঁপতে শুরু করে। এরই মধ্যদিয়ে আমাদেরকে পেছনে ফেলে ওরা চলে গেল। আমরা বেঁচে গেলাম। এভাবে প্রায় তিন ঘন্টা অতিক্রম হয়ে গেল। ভাবছিলাম, ওরা হয়ত অন্য পথে চলে গেছে। এমন সময় ফিরে আসা সৈন্যের অশ্বধ্বনি শুনতে পেলাম।

আমরা অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত। রেঞ্জের আওতায় আসার সাথে সাথে ফায়ার। ব্রাশফায়ার। চোখের পলকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে লুটিয়ে পড়ল দু'জন সৈন্য। বাকী একজন আহত অবস্থায় পালাচ্ছে। আমীর সাহেব তার রাস্তা আগলিয়ে দাঁড়ালেন। নিরুপায় হয়ে সে অস্ত্র জমিনে ফেলে হাত উঁচিয়ে তাছলিম তাছলিম আওয়াজে বনবাদার কাঁপিয়ে তুলল। কমান্ডো সাহেব আত্মসমর্পণ করল।

আমীর সাহেব ও জাফর ভাই তিনজনকেই চিনতে পেরেছেন। তারা একই সাথে সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেছে। ধৃত কমান্ডোও তাদেরকে চিনতে পেরেছে। আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করার নিমিত্বে সেজদায় জমিনে লুটিয়ে পড়লাম। গনীমত পেয়ে গেলাম অস্ত্রশস্ত্র ও তিনটি ঘোড়া। তাছাড়া জরিপ রিপোর্টসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্বলিত কাগজপত্র। আমরা রসদপত্র, ঘোড়াগুলো ও বন্দীকে নিয়ে অনেক দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এলাম। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধায় জীবন যায় যায়। আমীর সাহেব নাস্তা খাওয়ার জন্য হুকুম দিলেন। আমরা বন্দীকে নিয়ে ছায়েমার দেয়া রুটি ও পানীয় খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করলাম।

আমীর সাহেব বন্দী থেকে অনেক গোপন তথ্য সংগ্রহ করলেন। জামিউল উলুমের হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে কমান্ডো সত্য সত্য বর্ণনা দিল। সে-ই নাকি আব্বুকে ও অন্যান্য আলেমদেরক শহীদ করেছে। লম্পটের সে কি ভয়ংকর চেহারা। সেই তো আমার পিতার ঘাতক। সেই তো ছায়েমার পিতা-মাতার হত্যাকারী। অনেক মসলমানের প্রাণ হরনকারী। আমি আমীর সাহেবকে করজোর আবেদন করে বললাম, হুজুর! এ ঘাতক নরপিচাশকে আমার হাতে তুলে দিন, আমি আমার সাথীকে নিয়ে ওকে সাইজ করে অন্তরের জ্বালা মেটাব। আমীর সাহেব হেসে বললেন, "তা অবশ্যই! একে তোমাদের ভাগেই রাখব।"

আমীর সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, "বাবা! আমরা আরো অনেক সময় এখানে অপেক্ষা করব। তুমি একটি ঘোড়া নিয়ে নৌকার খোঁজ নাও। ওকে বিজয়ের সংবাদ দাও। গুলীর শব্দে ছেলেটি ভয়ে পেতে পারে বা হতাহতের সংবাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। কাজেই তুমি ঘোড়া ছুটিয়ে তোমার বন্ধুটিকে সান্ত্বনার বাণী শোনাও।" আমীর সাহেবের কথায় বুঝতে পারলাম, ছায়েমাকে এখনো তারা চিনতে পারেননি সে ছেলে না মেয়ে।

সকলের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে আমি ছায়েমার সন্ধানে বের হলাম। বাহন হিসেবে বেছে নিলাম সেই ঘোড়াটিকে, আলমাআতার চাচা যেটি দিয়েছেন। আরোহন করার সাথে সাথেই ঘোড়া আমাকে নিয়ে ছুটে চলল। ভেবেছিলাম, দিক-নির্দেশনা করতে হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য! সে চেনা পথেই আমাকে অল্পসময়ে নদীর কূলে নিয়ে আসল। কল কল রবে নদী বইছে। স্রোতের তোড়ে ভেসে যাবে ঐরাবত। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি আর মনে মনে দোয়া করছি। অশ্বটি মনে হয় প্রভূর অভিব্যক্তি সহজেই বুঝতে পেরেছে। তাই আমাকে পিঠে করে সাঁতার কেটে ওপারে চলে গেল। সোজা যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেছে বটে, কিন্তু স্রোতের তোড়ে অনেকটা ভাটির দিকে নিয়ে গেছে। তারপর নদীর কূল ঘেঁষে খালের মোহনায় এসে পৌছে। আমি ছায়েমার সন্ধানে খালের কূলে কূলে চলছি। আহ! দু'ধারে কি ঘন জঙ্গল। বাঘ-ভালুকের আস্তানা! ছায়েমা কিভাবে একা একা সময় কাটাচ্ছে তা ভাবছি আর পথ চলছি। বেশ রাস্তা অতিক্রম করেছি। তবু নৌকার কোন সন্ধান মেলেনি। ভয় ও ছায়েমার চিন্তায় অশ্রু গড়িয়ে বুক ভিজে যেতে লাগল। চলার পথে হঠাৎ ঘোটক থেমে গেল। আমার শরীর শিউরে উঠল।

কেন তার গতি থেমে গেল, তা ঠাহর করতে পারিনি। আমি এদিকে-ওদিক তাকাতে লাগলাম। সামনে একটু দূরে চোখ যাওয়ার সাথে সাথে এক ভয়ংকর দৃশ্য নজরে পড়ল। এক পাল বাঘ খাল থেকে পানি পান করে হয়ত শিকারের নেশায় এদিক-ওদিক যাচ্ছে। দেখে আমার জ্ঞান হারানোর উপক্রম। আমি আল্লাহ আল্লাহ জপছি। একটু পরে অশ্বটি খুব ধীরগতিতে সামনে এগিয়ে চলল। এখন বুঝতে পারলাম, হায়েনারা হয়ত রাস্তা ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে, তাই অশ্বটি এগুচ্ছে।

আনুমানিক আর দু'কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করার পর নৌকার মাস্তুল নজরে পড়ল। সাথে সাথে এক বিস্ময়কর ঘটনা আমার আঁখি দর্পনে ভেসে উঠল। হায়! দু'টি ইয়া বড় বাঘ নৌকার অগ্রভাগে ওঁৎ পেতে বসা, যেন শিকার ধরবে। আর ছায়েমা মালাকানী ছৈয়ের অভ্যন্তরে নামাযে মশগুল! বাঘের টকটকে জিহ্বা দিয়ে লালা ঝরছে। ছায়েমা দীর্ঘ ক্বেরাতে নামায পড়ছে। কে জানে, কোন্ মুহূর্তে মেয়েটাকে খপ করে ধরে নিয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে আমি ঠিক থাকতে পারলাম না। আমি ক্লাশিনকভ বুকে ঠেকিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হচ্ছি। একটু সামনে গিয়ে ব্রাশফায়ারে বাঘ দু'টিকে উড়িয়ে দেব, চিরতরে মানুষ খাওয়ার সাধ মিটিয়ে দেব।

ছায়েমা সালাম ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি ফায়ার করার অভিলাষে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখলাম। এমন সময় ছায়েমা চিৎকার দিয়ে বলল, “খোবায়েব ভাইয়া! তুমি একি করছ! সাবধান সাবধান ট্রিগার টেনো না।” এই বলে সে ছৈয়ের ভেতর থেকে বাঘের সামনে এসে দাঁড়াল। বাঘ দু'টি বিড়ালের মত লেজ নেড়ে নেড়ে ছায়েমার চারপাশে ঘুরতে লাগল। ছায়েমা ডাকল, "ভাইজান! নৌকায় এসো, আমি তোমার অপেক্ষায় প্রহর গুণছি। ভয় পেয়ো না, জলদি এসো, ওখানকার সংবাদ শোনাও।"

আমি ছায়েমার কথামত ভয়ে ভয়ে নৌকায় চলে আসলাম। ছায়েমা তাড়াহুড়ো করে রুটি ও সালুন এনে আমাকে খেতে দিল। বেশ কয়েকটা রুটি বাঘের সম্মুখে নিক্ষেপ করল। বাঘও মনের আনন্দে রুটি খেতে লাগল। ছায়েমা বাঘ দু'টোর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। বাঘ রুটিগুলো খেয়ে সোজা বনের ভেতর চলে গেল।

 চলার পথে বারবার ঘাড় ফিরিয়ে ছায়েমাকে দেখছে। আমি এসব দৃশ্য দেখে মনে মনে ভাবছি, এটা কি স্বপ্ন, না বাস্তব? না কি চোখের ধাঁধাঁ। ছায়েমা বলল, "ভাইজান! এ যে আল্লাহর এক নুছরত! নৌকা এখানে নোঙর ফেলার পরই বাঘ দু'টি অরণ্যের ভেতর থেকে বেরিয়ে এখানে চলে আসে। আমি ভয়ে কাঁপছি, আর বুঝি রক্ষা নেই। বাঘের উদরেই মনে হয় চলে যেতে হবে। আমি সবকিছুই ভুলে গিয়েছিলাম। শুধু বারবার জবানে কালেমা উচ্চারণ করছি। এভাবে কিছু সময় পার হওয়ার পরও যখন দেখলাম, বাঘ আমাকে আক্রমণ করছে না, তখন বুঝতে পারলাম, এটা মহান রব্বুল আলামীনের নুছরত।" আমি বললাম, দেখার সাথে সাথে গুলী ছোঁড়নি কেন? সে বলল, "দেখার সাথে সাথে গুলী করার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। হয়ত আল্লাহ নিজেই ভুলিয়ে দিয়েছেন।"

আমি ছায়েমাকে সব ঘটনা শোনালাম। ছায়েমা আল্লাহর শোকর আদায় করল। আমরা ঘোড়া ও নৌকা নিয়ে আগের স্থানে রওনা হলাম।



[দশ]

বেলা দু'টো বেজে ত্রিশ মিনিট। নৌকা ঘাটে ভিড়ল। আমীর সাহেব ও জাফর ভাই বন্দীকে নিয়ে বসা। আমরা উভয়ে নৌকা থেকে নেমে তাদের সাথে মিলিত হলাম। সালাম-মুসাফাহা ও কুশলাদি বিনিময় করে বন্দীকে গাছের সাথে বেঁধে নামায আদায় করলাম। তারপর আহারাদী সেরে পরামর্শে বসলাম। প্রথমে বন্দীর ব্যাপারে পরামর্শ হল, তাকে কি করা যায়? ছায়েমা বলল, "জানতে পারলাম, এ পাষণ্ড আমার পিতা-মাতার ঘাতক। তাই এ পাপিষ্ঠকে সাইজ করার দায়িত্ব অনুগ্রহ করে আমার হাতে ছেড়ে দেয়া হোক।"

আমীর সাহেব প্রশ্ন করলেন, "তুমি অল্পবয়সী হয়ে শক্তিশালী এই বিশালদেহী কমান্ডো প্রধানকে কিভাবে সাইজ করবে?" ছায়েমা উত্তরে বলল, "হুজুর! আল্লাহ পবিত্র কুরআনে হুকুম দিয়েছেন, যখন তোমাদের পরওয়ারদেগার ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দান করেন যে, আমি তোমাদের সাথে রয়েছি, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে স্থির করে রাখ, আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। কাজেই, তোমরা কাফেরদের গর্দানের উপর আঘাত হান এবং তাদেরকে জোড়ায় জোড়ায় কাট।” (সূরা তওবা: আয়াত ১২)

ছায়েমার কথা শুনে আমীর সাহেব ফয়সালা দিলেন, "এই বন্দীকে তোমাদের দু'জনকে দেয়া হল। তোমরা তোমাদের ইচ্ছেমত ব্যবস্থা নাও।" ছায়েমা বলে উঠল, "হুজুর! এ বন্দীর মাধ্যমে আরো কিছু কাজ নেয়া যায়। ইনি হলেন কমান্ডো গ্রুপের প্রধান। তার নির্দেশনায় তথ্য সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন তার দ্বারা একটি পত্র লিখিয়ে যদি আরো সৈন্য তলব করা হয়, তাহলে প্রধান সেনাপতি অবশ্যই আরো সৈন্য পাঠাবেন। তারপর আমরা ওদেরকেও খতম করতে পারব।"

ছায়েমার বুদ্ধিদীপ্ত পরামর্শ শুনে সবাই অবাক। আমীর সাহেব বললেন, "আচ্ছা বাবা, তাই হবে। তুমি চিঠির খসড়া তৈরি কর। তারপর তা বন্দীর দ্বারা লিখিয়ে দস্তখত করিয়ে নেব।" ছায়েমা কাগজ- কলম বের করে পত্র লিখছে-

মাননীয় প্রধান সেনাপতি,

আমরা আপনার নির্দেশে জনহীন গভীর অরণ্যে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমান্ডো গ্রুপ নিয়ে জরিপ কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটির সন্ধান পেয়েছি। অনেক গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছি। অনেক অরণ্য পথ আবিষ্কার করেছি। আপনার নির্ধারিত সময়ে জরিপ করা তিনজনের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। কারণ, এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। কাজেই আমার সাহায্যার্থে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গকে পাঠাতে পারলে খুব উপকার হত।

(আমির সাহেব থেকে জেনারেলদের নাম জেনে ছায়েমা তালিকা তৈরি করছে)

॥ জেনালে রুস্তম ডার ॥ জেনারেল কাফায়েভ। লভস্কী ॥ কাজ্জাবী। দুর্দাভী । অলস্কাইড । খলিল জাভী ॥ কার্দাভী ॥ আইজেক ॥ কিংডর্গ ॥ এলকে ব্রেক ॥ ইউসিয়ার
উক্ত ব্যক্তিবর্গকে পাঠিয়ে আমার হাতকে মজবুত করতে যেন মহামান্যের মর্জি হয়।

ইতি
আপনার অধীন
এম, কিউ, ব্রাড।
(বিঃ দ্রঃ পত্রবাহক আমাদের একজন হিতাকাঙ্খী কমরেড খোবায়েব)।

আমীর সাহেবের নিকট পত্রের খসড়াটি পেশ করলে উচ্চস্বরে পাঠ করলেন। এক বাক্যে সবাই ছায়েমার প্রশংসা করতে লাগলেন। অতপর পত্রে দস্তখত নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বললেন "বাবা। সকলের চেয়ে রাস্তাঘাট তুমিই বেশী চেন, তাই তোমাকেই যেতে হবে। যাওয়ার আগে বন্দীকে যা করার করে যাও।” আমি আর বিলম্ব না করে বন্দীকে একটু দূরে নিয়ে হাত-পায় বেঁধে মনের আনছে খঞ্জরের আঘাতে আঘাতে জাহান্নামে প্রেরণ করলাম।

আমি সওয়ারীর জন্য কমান্ডো প্রধান এমকিউ ব্রাডের অশ্বটি নিয়ে ছুটলাম। ছায়েমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে অশ্রু ফেলছে। ছায়েমা আমার গায়ে কমিউনিস্ট মার্কা পোশাক, বুকে কাস্তে হাতুড়ি মার্কা স্টিকার, মাথায় কমিউনিস্ট ক্যাপ পেরিয়ে দেয়। আমি দ্রুত ঘোড়া হাঁকিয়ে রওনা হলাম।

আমি বিকেল পাঁচটায় আলমাআতা জামেউল উলুম মাদ্রাসার প্রধান ফটকে এসে পৌঁছলাম। ঘোড়া থেকে নেমে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে দ্বাররক্ষী আমাকে বাধা দেয়। আমি বললাম, অরণ্যের তথ্য সংগ্রহের প্রধান কমান্ডার জেনারেল এমকিউ ব্রাডের পক্ষ থেকে সেনাপতি জেনারেল মার্শাল বোদায়েভের নিকট বার্তা নিয়ে এসেছি।


আমার কথা শুনে আরপি স্বসম্মানে আমাকে বোদায়েভের নিকট নিয়ে গেলেন। আমি কুর্নিশ করে অফিস কক্ষে প্রবেশ করলাম। তিনি একটি চেয়ারের দিকে ইশারা করে আমাকে বসতে বললেন। আমি চেয়ারে বসে পত্রটি বের করে দিলাম। সেনাপতি পত্রটি পড়তে পড়তে এক সিপাইকে নাস্তার ব্যবস্থা করার হুকুম দিলেন। সাথে সাথে নিয়ে এল ফল ও চা-বিস্কুট। আমি আমার রুচিমত খেয়ে নিলাম।

সেনাপতি আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেন। আমি গা বাঁচিয়ে সবগুলোর উত্তর দিলাম। সাথে সাথে এও বললাম, স্যার, আমি কলেজ পড়ুয়া ছাত্র। লেনিনের আদর্শে বিশ্বাসী। অনেক আগ থেকে কমিউনিস্ট বিপ্লব করি। আমাদের এলাকায় লাল ফৌজ আসলে তাদেরকে পথঘাট দেখিয়ে দেই। সবাই আমাকে আদর করেন।

সেনাপতি আমার কথা শুনে প্রশ্ন করলেন, "বাবা! চলাফেরায় অসুবিধা হচ্ছে না তো?" আমি বললাম, স্যার! শত্রু-মিত্র তো চেনা মুশকিল। রুহানীরা আমাদের শত্রু। অনেক সময় পার্টির লোকেরাও না চেনার কারণে অসুবিধা করে। সেনাপতি আমার কথা শুনে তার অফিসিয়াল প্যাডে আমার জন্য একটি সত্যায়নপত্র লিখে দস্তখত করে সীলমোহর দিয়ে বললেন, "কোন পুলিশ বা সেনাবাহিনীর যুবকরা ধরলে এটি দেখাবে।"

এদিকে আমি উপস্থিত থাকতে থাকতেই বেশ ক'জন জেনারেলকে ডেকে পত্রের সারমর্ম সম্পর্কে অবগত করলেন। তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন আগামীকাল এগারটা থেকে দুপুর বারটার মধ্যে বারজন জেনারেল অরণ্যে পাঠাবেন। অতপর ছোট্ট একটি পত্র লিখে আমার হাতে দিয়ে বললেন, "এ পত্রটি এমকিউ ব্রাডের হাতে দিও।" আর দু'শ' ডলার বকশিশ দিয়ে খরচ করতে বললেন। আমি গুড আফটারনুন বলে বিদায় নিলাম।

আমি মহান রাব্বুল আলামীনের শোকর আদায় করতে করতে বিজয়ী বেশে অরণ্যাভিমুখে যাত্রা করলাম। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আমি আস্তানায় এসে হাজির হলাম। অশ্বের পদধ্বনি শুনে ছায়েমা কিছু পথ এগিয়ে এল। আমি অশ্ব থেকে অবতরণ করে সালাম দিয়ে নৌকায় উঠলাম। জাফর ভাই এগিয়ে এসে হাত ধরে আমাকে নৌকার ভেতর নিয়ে গেলেন। ছায়েমা চোখের পলকে খানা নিয়ে হাজির। আমি সকলকে সাথে নিয়ে খানা খেলাম। তারপর সফরের কারগুজারী এক এক করে খুলে বলতেই সকলের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এল আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!

রাত ন'টা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাঝে-মধ্যে জোনাকিরা ছুটোছুটি করছে। আমরা জামাতে নামায আদায় করলাম। আমীর সাহেব পাহারাদারীর দায়িত্ব বণ্টন করলেন। দশটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত দায়িত্ব আমার আর ছায়েমার। একটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত আমীর সাহেব ও জাফর ভাইয়ের।

আমরা অস্ত্রগুলো সুন্দর করে মুছে গানঅয়েল মেখে নিলাম। ছায়েমা তার নরম হাতে বারটি ম্যাগজিনে গুলী ভর্তি করে নিয়েছে। আমি আর্মি সেট পরিধান করে বুট পায়ে দিলাম। ছায়েমা সবসময় আর্মির পোশাক পরে থাকে। কোন সময় পাল্টাতে দেখি না। সে কখন কোথায় গোসল করে, তাও কেউ দেখি না। যার কারণে সে নারী না পুরুষ এখনো অন্যেরা ধরতে পারেনি। সবাই ছোট ভাই বলে সম্বোধন করে।

দু'জনকে নৌকায় রেখে আমরা বেরিয়ে এসে চার-পাঁচশ' হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছি। নিঝুম রাত। কালো আঁধারে ছেয়ে আছে দশদিক। গাছের ফাঁক দিয়ে দূর আকাশে দু'একটি নক্ষত্র মিটমিট করে জ্বলছে দেখা যায়। তাছাড়া আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এখন হয়ত বন্য হায়েনারা রিজিকের সন্ধানের বেরিয়ে আসবে শিকার ধরতে। বাঘ, সিংহ ছাড়াও কত নাম না-জানা হিংস্র প্রাণীর আবাস এই অরণ্যে। কখন জানি তাদের আক্রমণের শিকার হতে হয় কে জানে! উঁচু বৃক্ষ শাখের শুকনো পাতাগুলো যখন জমিনে ঝরে পড়ে, তখন গা শিউরে উঠে। শুকনো ডালপালাগুলো যখন ভেঙ্গে জমিনে পতিত হয়, তখন আরো বেশী ভয় লাগে। মনে হয় দুশমন আমাদের ধরে ফেলেছে। ছায়েমা ভীত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এভাবে পাহারা দিচ্ছি। ঘুমের আক্রমণে বারবার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

ছায়েমা বলল, "খোবায়েব ভাইয়া! মহানবী (সাঃ) বলেছেন, জাহান্নামের আগুন দু'টি চোখকে স্পর্শ করবে না, একটি হল যে চোখ আল্লাহ জন্য কাঁদে, অপরটি যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় রাত জেগে পাহারা দেয়। (তিরমিযী)

ছায়েমার জবান থেকে মহানবী (সাঃ) হাদীসটি শুনে আমি ভয়- ভীতি, ক্লান্তি ও ঘুমের আক্রমণ থেকে অনেক সতর্ক হয়ে গেলাম। এমনকি আমার মনে সারারাত জেগে পাহারাদারীর করার প্রবল আগ্রহ জন্মে যায়। ছায়েমা আরো একটি হাদীস শোনাল- হযরত ফুযালা বিন উবাইদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) এরশাদ করেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির আমল তার মৃত্যুর সাথে সাথে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত প্রহরীর আমল তার মৃত্যুর পরেও জারী থাকে।

 তার আমল কিয়ামত পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং কবরের আযাব থেকে সে মুক্তি পেয়ে যায়। সুবহানাল্লাহ! পাহারাদারীর এত সওয়াব, এত ফজিলত! রাত আনুমানিক বারটা। গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে প্রকৃতি। জেগে আছি আমরা দু'জন। রাতের পাহারা দিতে হয় কান দিয়ে। কারণ, চোখ তো সামনে দেখছে না কিছুই। তাই রাতের পাহারায় কানই প্রধান সাথী। হঠাৎ অনুভব করলাম, পেছন দিক থেকে কি একটা যেন হুমড়ি খেয়ে পালাচ্ছে। বিকট শব্দ কানে আসল। ভয়ে শরীর শিউরে উঠল। ছায়েমা ভয়ে মূর্তির মত নিশ্চল নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। আমি বুঝতে পারলাম, হয়ত ক্ষুধার্ত বাঘ দুর্বল কোন জানোয়ারকে ধাওয়া করছে জঠর জ্বালা নিবারণের জন্য।

আমাদের পাহারার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে এল। ছায়েমা চুপিসারে বিড়ালের মত আমীর সাহেবকে জাগানোর জন্য নৌকায় চলে গেল। একটু পরই আমীর সাহেব ও জাফর ভাই অস্ত্র হাতে চলে আসলেন। আমীর সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, "খোবায়েব! কোন অসুবিধা হয়নি তো?" আমি বললাম, জ্বী না হুজুর, কোন অসুবিধা হয়নি। তারপর আমি ও ছায়েমা নৌকায় ঘুমিয়ে পড়ি।

বন্য মোরগের কুকুর-কুক্ ডাকে ঘুমন্ত প্রকৃতি আঁখি মেলছে। পূর্ব আকাশ ক্রমশই রাঙ্গা হয়ে উঠছে। ভোরের পাখিরা মনের আনন্দে গান গাইছে। নানা ধরনের কলকাকলীতে আনন্দের দোলা লাগছে। আর একটু পরেই ঈষৎ কম্পনে পূর্ব আকাশে রাঙ্গা রবির আগমন ঘটবে। ঠিক এই মুহূর্তে ছায়েমা ঘুম থেকে উঠে আমাকে জাগিয়ে দিল। আমি তাড়াতাড়ি অযু করে নামায পড়ে নিলাম। তারপর দু'জনে তিলাওয়াত করতে বসলাম। ছায়েমা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী আমার সাথে তিলাওয়াত যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। দু'পারায় আমার তিনটা, ছায়েমার একটা লোকমা পড়েছে।

ইতিমধ্যে আমীর সাহেব নৌকায় এসে উপস্থিত হয়ে সবাইকে বললেন, "আমার জানবাজ মুজাহিদ সাথীরা! আজকের আক্রমণ জান নেয়া-দেয়ার আক্রমণ। আজকের আক্রমণ এক ভয়ংকর আক্রমণ, অস্তিত্ব রক্ষার আক্রমণ। এখন থেকে হামলার প্রস্তুতি নিতে হবে।" আক্রমণের প্রকৃতি কি হবে, তা তিনি এক এক করে বুঝিয়ে বললেন। আমরা কান পেতে শুনলাম। আমীর সাহেব ছায়েমাকে বললেন, "ছোট ভাই! তুমি অল্প সময়ে সুস্বাদু খানা পাকাতে পার, তাই তোমাকেই খানা পাকানোর দায়িত্ব দেয়া হল।"

ছায়েমা খানা তৈরির কাজে চলে গেল। আমরা বেশক'টি মাইন নিয়ে আমীর সাহেবের পিছু পিছু অগ্রসর হলাম। বনের ওপারে চলার পথে আমীর সাহেব কয়েকটি মাইন মাটির নীচে পুঁতলেন। এর আগে কিভাবে মাইন পুঁততে হয়, কিভাবে তার সংযোগ দিতে হয়, সুইচ অন করতে হয় দেখিনি। তাই আমীর সাহেবের নিকট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখলাম। আরো ক'টি মাইন বনের ভেতর এলোপাতাড়িভাবে পোতা হল। তারপর নৌকায় ফিরে এলাম। আমীর সাহেব অস্ত্রগুলো মোছার নির্দেশ দিলেন। জাফর ভাইকে নিয়ে সব অস্ত্র মুছে, গানঅয়েল মেখে, ম্যাগজিন ভর্তি করে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখলাম। আমীর সাহেব সব ছামানাপত্র একত্রিত করে নৌকায় রাখলেন।

ছায়েমা খানা তৈরি করে সবাইকে খেতে অনুরোধ জানাল। আমরা তৃপ্তি সহকারে খানা খেলাম। আমীর সাহেব সবাইকে ডেকে পরামর্শ করে কাজ বন্টন করলেন। তিনি বললেন, "ক্যামোফ্ল্যাক্সের মাধ্যমে এ্যাম্বুশ লাগাতে হবে।" আমি বললাম, এ আবার কি জিনিস? আমির সাহেব বুঝিয়ে বললেন, "ক্যামোফ্ল্যাক্স অর্থ নিজেকে পরিবর্তন করা বা চেহারা পাল্টানো। অর্থাৎ লতা-পাতা দিয়ে নিজেকে এমনভাবে সাজাবে, নিকটে কোন প্রাণী আসলেও যেন টের না পায় যে, এখানে মানুষ আছে। আর এ্যাম্বুশ হল, দুশমনের রাস্তায় ওঁৎ পেতে বসে থাকা এবং দুশমন নিকটে আসার সাথে সাথে আক্রমণ করে বসা। এ্যাম্বুশ খুবই ভয়ানক। মুজাহিদ এ্যাম্বুশ লাগালে দুশমন রক্ষা পায় না আর দুশমন এ্যাম্বুশ লাগালে মুজাহিদ রক্ষা পায় না।"

আমরা একে অপরকে লতা-গুল্ম ও পত্রপল্লবে আবৃত করে দিলাম। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলে চেনার সাধ্য কারো নেই যদি নড়াচড়া না করে। এভাবে মাইন পোঁতার কিছু দূরে ঘন ঝোঁপ-ঝাড়ের ভেতর লুকিয়ে রইলাম। সকাল ন'টা বাজে। দুশমন এখনো আসেনি। একটানা এত সময় দাঁড়িয়ে থাকা খুবই কষ্টকর। আল্লাহ আল্লাহ জপ করছি। একটু পরেই চেয়ে দেখি, ন'জন অশ্বারোহী খুব সন্তর্পনে এদিকে অগ্রসর হচ্ছে। এবার আনন্দের আর সীমা রইল না। বারজন ফৌজের মধ্যে মাত্র ন'জনকে দেখা যাচ্ছে। বাকি তিনজন কি পেছনে রয়েছে? না ওখান থেকে পাঠায়- ইনি? এ নিয়ে খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। 

চেয়ে দেখি, প্রথম মাইনটি পেরিয়ে তিন-চারজন সৈন্য সামনে চলে গিয়েছে। মাইনে ঘোড়ার পা পড়েনি। কিন্তু পরক্ষণেই হঠাৎ বিকট আওয়াজে তিন-চারটি মাইন বিস্ফোরিত হল। সাথে সাথে অশ্বারোহী ন'জন কমান্ডো ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে এদিক-ওদিক ছিটকে পড়ল। এখানে ঘোড়াসহ নয়জনের জাহান্নাম নছিব হয়। এরা নিহত হওয়ার সাথে সাথে পেছনের দিক থেকে বৃষ্টির মত গুলী আসতে শুরু করে। অতর্কিত আক্রমণে টিকতে না পেরে আমরা জমিনে শুয়ে পড়লাম। তিনজন সৈন্য ব্রাশফায়ার করতে করতে সামনে চলছে। আমীর সাহেব এখনো গুলীর হুকুম দিচ্ছেন না। একতরফা ওরাই গুলী করছে। গুলীর হুকুম না দেয়ায় রাগ সামলান খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমীরের হুকুম মানা যে ফরয। তাই খুব কষ্টে রাগ দমন করতে হল। আমাদের পক্ষ থেকে গুলী না করায় দুমশন মনে করছে যে, মুজাহিদরা এ এলাকায় নেই, মাইন পুঁতে রেখে অন্যত্র চলে গেছে। এই ভেবে ওরা ফায়ার বন্ধ করল।

ওরা যখন আমাদেরকে পেছনে ফেলে সামনে চলে গেল, তখন আমীর সাহেব উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, দাঁড়াও! ওরা সবাই দাঁড়িয়ে গেল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আমীর সাহেব আবার হুকুম করলেন, আত্মসমর্পণ কর। সবাই অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিয়ে হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমরা অস্ত্র তাক করে ওদের সামনে এগিয়ে গেলাম। আমীর সাহেব অস্ত্রগুলো কব্জা করে নিলেন। আমরা তিনজনকে জুতোর ফিতা দিয়ে হাতগুলো পেছনে নিয়ে বেঁধে ফেললাম। তারপর গনীমতসহ আস্তানায় ফিরে এলাম।


[এগার]

দুপুর বারটা। আমরা সকলেই ক্লান্ত। গোসল, খানাপিনা ও বিশ্রামের প্রয়োজন। আমীর সাহেব সবাইকে গোসলের নির্দেশ দিলেন। আমরা সবাই মনের আনন্দে গোসল করে নিলাম। ছায়েমা আনমনে হেঁটে চলে গেল খালের বাঁকে। একমাত্র আমিই বুঝতে পারলাম, সে গোসল করতে যাচ্ছে। আমরা গোসল সেরে নৌকায় ফিরে এলাম। তারপর আমীর সাহেব গোসল করলেন। ছায়েমা ফিরে এসে পূর্বের পাকানো খানা দস্তরখানে হাজির করল। খানা পর্যাপ্ত। পাঁচ-সাতজনে খেয়েও শেষ করা যাবে না।

আমীর সাহেব গোসল সেরে আসলে সবাই বন্দীদেরকে নিয়ে একসাথে আহার করলাম। ছায়েমা নিজে খাবার পরিবেশন করল। আমরা খানা খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছি। আমীর সাহেব বললেন, তোমরা দু'এক ঘন্টা ঘুমিয়ে নাও, আমি পাহারা দিচ্ছি। ছায়েমাও খানা খেয়ে শুয়ে পড়ল। বিকেল তিনটার সময় আমীর সাহেব সবাইকে জাগিয়ে দিলেন। আমরা অযু করে নামায আদায় করলাম। আমীর সাহেব বন্দীদেরকে ভালভাবেই চেনেন। এক সাথেই সেনাবাহিনীতে চাকুরী করেছেন। এরা একসময় মুসলমান ছিল।

কমিউনিস্ট বিপ্লবের স্রোতে ভেসে গেল তাদের অমূল্য সম্পদ ঈমান। এরাই ছিল লেনিনের স্পেশাল ফোর্স। লেনিন এদের দ্বারা মুসলমানদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করিয়েছে। গণধর্ষণ এরাই বেশী করেছে। এরা মুরতাদ, এরা জিন্দিক। এদের কতল করতে ইসলামী শরীয়ত নির্দেশ দিয়েছে। আমীর সাহেব এদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করলেন, যা পরবর্তী সময়ে আমাদের জন্য মাইলফলক হিসেবে কাজে আসবে। এসব তথ্য সংগ্রহ করার পর আমীর সাহেব তাদেরকে জবাই করার নির্দেশ দিলেন। ছায়েমা মুচকি হেসে বড় পালোয়ানকে ইশারা করে বলল, "খোবায়েব ভাইয়া! এ যেন আমার ভাগে থাকে।” আমরা ছায়েমার আবদার রক্ষা করলাম। তারপর নদীর কূলে শুইয়ে তিনজন তিনজনকে জবাই করে মনের জ্বালা মিটালাম। জবাই কাজ শেষ করে ছায়েমা রক্তে ভেজা খঞ্জর হাতে চলে গেল নৌকায়। কেন গেল, তা বুঝতে পারিনি। আমি সবগুলো লাশ থেকে পোশাক খুলে নিলাম। তারপর জোড়া থেকে প্রত্যেকটা অঙ্গ আলাদা করতে লাগলাম।

ছায়েমা দূর থেকে ডেকে বলল, "ভাইয়া! রাখ, রাখ, আমি আসছি একটু সবুর কর।" এর মধ্যে দু'জনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে স্তূপ করে রাখলাম। এখনো একজন অক্ষত, হাত-পা আলাদা করা হয়নি। ছায়েমা এসে মেয়েলি ভঙ্গীতে মুখ বাঁকা করে চোখ দু'টো কপালে তুলে অভিমানের সুরে বলল, "কেন খোবায়েব ভাই! তুমি কি তোমার বোনটিকে ভুলে গেলে? আমি কি তোমার সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ও আপদ-বিপদের সাথী নই? এ মুবারক কাজে আমাকে শরীক করলে না যে।" আমি ক্ষমা চেয়ে বললাম, তোমার ভাগে তো একজন রেখে দিলাম। এতে কি তোমার মন ভরবে না? এতে কি তোমার আশা পূরণ হবে না? ছায়েমা ওষ্ঠযুগলে হাসির রেখা টেনে বলল, "ডাক না দিলে তো এও পেতাম না।" এই বলে ইচ্ছামত প্রতিটি জোড়া থেকে অঙ্গগুলো আলাদা করল। তারপর দু'জনে মিলে পোশাকগুলো নদীতে নিয়ে ভালভাবে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিলাম।

আমীর সাহেব সবাইকে ডেকে জরুরী পরামর্শে বসলেন। এ মুহূর্তে আমাদের করণীয় কি হবে, তা তিনি জানতে চাইলেন। ছায়েমা বলল, "পরপর কয়েকটি অভিযানে আল্লাহ আমাদেরকে বিজয়দান করেছেন। শত্রুপক্ষের বেশক'জন শক্তিশালী সৈন্য ও রসদপত্র খোয়া গেছে। এ খবর ছড়িয়ে যাবে সারাদেশে। এর প্রতিশোধ নেয়ার জন্য জেনারেল মার্শাল বোদায়েভ একপায়ে খাড়া। সে যেকোন মুহূর্তে অরণ্য ভূমিতে সাড়াশি আক্রমণ বা ক্র্যাকডাউন লাগতে পারে। কাজেই আমাদের এ এলাকা পরবির্তন করা একান্ত দরকার বলে আমি মনে করি। বাকী আমীরে মোহতারামের ফয়সালা।"

ছায়েমার কথা শুনে সকলেই এক বাক্যে হাঁ হাঁ বলে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। জাফর ভাই বললেন, "মনে হয় ওরা এবার তথ্য ছাড়াই আক্রমণ করে বসবে। ক্র্যাকডাউন লাগিয়ে চিরুনী অভিযান চালাবে।" আমীর সাহেব বললেন, "তোমাদের ধারণাই ঠিক। আমাদের খুব সতর্কতার সাথে সরে যেতে হবে।"

ছায়েমা পরামর্শ দিল, "আমরা যদি সমস্ত মালামাল নৌকায় তুলে অনেক দূরে চলে যাই, তাহলে নিরাপদে থাকা যাবে। আর ঘোড়াগুলো যদিও যুদ্ধের জন্য খুবই উপকারী, কিন্তু পোষা খুবই কষ্টকর। তাছাড়া সেনাবাহিনীর ঘোড়া অনেকে দেখলেই চিনবে। তাই ঘোড়া ব্যবহার করা ঠিক হবে না। বন্ধনমুক্ত করে দিলে ঘোড়াগুলো যেথায় ইচ্ছে চলে যেতে পারবে। বাজারে বিক্রয় করলে বেশ টাকা মিলবে বটে, কিন্তু গুপ্তচর
  চারদিক ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের মনে সন্দেহ জাগবে, এসব ঘোড়া কোথায় পেলাম। এতে অসুবিধা হতে পারে।" আমি তার যুক্তিপূর্ণ পরামর্শ শুনে অলক্ষ্যে বলে উঠলাম, ছায়েমা। তুমি যেন একজন সুদক্ষ সৈনিক। তোমার বুদ্ধিমত্তায় বড় বড় জেনারেলও হার মানবে। সাথে সাথে আমীর সাহেব ও জাফর ভাই আমার দিকে বিস্ফারিত নয়নে তাকালেন। তারপর দু'জনের মধ্যে আরম্ভ হল মুখ চাওয়া-চাওয়ী। আমীর সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, "ছায়েমা? তুমি ছায়েমা! এ যে মহিলার নাম!" ছায়েমা লজ্জায় মাথানত করে বসে রইল। আমার মুখের ভাষাও মুহূর্তের মধ্যে হারিয়ে গেল। তারপর আমি তার জীবন বৃত্তান্ত আমীর সাহেবকে শুনালাম। আমীর সাহেব ও জাফর ভাই এই মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক ঘটনা শুনে কেঁদে ফেললেন।

আমীর সাহেব অশ্রুসিক্ত নয়নে ছায়েমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোমার আম্মু ও আব্বু শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করে জান্নাতে চলে গেছেন। শাহাদাতের নেয়ামত ক'জনের ভাগ্যে জোটে? হুজুর (সাঃ) বলেছেন, শহীদের রক্ত মাটিতে পতিত হবার আগেই শহীদ জান্নাতে চলে যায়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সাঃ) ইরশাদ করেন, আল্লাহর রাহে নিহত হওয়া ঋণ ব্যতীত সমস্ত গুনাহের কাফফারা। (বুখারী, মুসলিম) উক্ত হাদীস শুনে ছায়েমাও শাহাদাতের দোআ করল। আমরা 'আমীন আমীন' বললাম।

বেশ সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। আমীর সাহেব হুকুম দিলেন সমস্ত মালামাল নৌকায় উঠাতে। আমরা নৌকার নীচে তক্তা ও বাঁশের মাচায় চট-ছালা বিছিয়ে এর উপর অস্ত্র ও গোলা-বারূদ রেখে তার উপর মাছ ধরার জাল বিছিয়ে দিলাম। কেউ দেখলে সহজে বুঝবে না ভেতরে কিছু আছে।

আমরা আল্লাহর উপর ভরসা করে নৌকা ছাড়লাম। পাড়ি জমালাম দূরপানে। সকলের গায়ে সাধারণ পোশাক। দেখতে অনেকটা জেলেদের মত। দু'জনে দাড় টানছি। আমীর সাহেব হাল ধরলেন। ছায়েমা ছাপ্পরে বসে তিলাওয়াত করছে ও এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছে।

নদীর বাঁকে বাঁকে কাশবন ও ঝাউ গাছ। ঝাউ শাখে শালিক, মাছরাঙা ও বকেরা এসে বসে। গাংচিলগুলো ডানা মেলে শিকারের আশায় উড়ে বেড়াচ্ছে। পানকৌড়িরা মাছ ধরার জন্য ডুব দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আবার অনেক দূর গিয়ে ভেসে উঠছে। আরো কত নাম না-জানা পাখীরা উড়ে বেড়াচ্ছে। এসব দৃশ্য নদীর পাড়ের মানুষ ছাড়া ক'জনের দেখার ভাগ্যে জোটে।

বিকাল তিনটার দিকে অরণ্যপথ পাড়ি দিয়ে আমরা লোকালয়ে এসে পৌঁছলাম। এখনো নামায পড়িনি। একটানা দাড় টানার কারণে সকলেই ক্ষুধায় অস্থির। আমীর সাহেব তটে নৌকা নোঙর ফেলার নির্দেশ দিলেন। আমরা নৌকা ভিড়িয়ে অজু করে নামায আদায় করলাম। তারপর সকলে মিলে গমের ছাতু খেয়ে ক্ষুধার জ্বালা নিবারণ করলাম। আরো একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার পাড়ি ধরলাম।

আমরা আলমাআতার অদূরে ছোট একটি বাজারে এসে উপনীত হলাম। নৌকা ঘাটে বেঁধে নামায আদায় করলাম। আমীর সাহেব এখানেই রাত যাপনের সিদ্ধান্ত নিলেন। খানা তৈরি করতে হবে। ছায়েমা খানা পাকানোর কাজে লেগে গেল। জাফর ভাই ছায়েমার সাহায্যে এগিয়ে আসলেন। আমি আমীর সাহেবকে বললাম, হুজুর এ এলাকার হাল-হকিকত জানা দরকার। আমাকে গোয়েন্দা হিসাবে প্রেরণ করুন। আমি ঘুরে ঘুরে এলাকার খবরাখবর নিয়ে আসি। আমীর সাহেব আমাকে অনুমতি দিলেন। আমি আমার কমিউনিস্ট মার্কা পোশাক পরিধান করলাম। সঙ্গে জেনারেল বোদায়েভের পরিচয়পত্রটি নিতে ভুল করলাম না।

আমি আল্লাহর উপর ভরসা করে রওনা হলাম। ছায়েমা তার হাতের কাজ রেখে দিয়ে আমার কাছে ছুটে আসল। সামনে দাঁড়িয়ে অপলক নেত্রে ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কিছু বলতে চাও ছায়েমা? সে কাতর স্বরে বলল, "ভাইজান! এ এলাকা তো বিপদমুক্ত নয়। নিকটেই আলমাআতা শহর। সেনাবাহিনীরা ক্ষুধার্ত বাঘের ন্যায় ওঁৎ পেতে আছে। কখন কি ঘটে বলা যায় না। তুমি একা একা গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছ?" আমি তাকে বুঝিয়ে ও অভয় দিয়ে রওনা দিলাম। পথ চলতে চলতে পেছনে তাকিয়ে দেখি, ছায়েমা নির্জীব মূর্তির মত এখনও দাঁড়িয়ে আছে। আমি ষাড় ফেরাবার সাথে সাথে প্রতিমারূপী ছায়েমা হাত নেড়ে বিদায় জানাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি তার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলাম।

পথে সাদা দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি আমাকে আনমনে চলতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, "বাবা! তুমি কোথেকে এলে? এ রাতে যাবে কোথায়?" বললাম, আমি আলমাআতা যাব। আমার কথা শুনে বুড়ো স্বস্নেহে বললেন, "বাবা! আলমাআতার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সেনাবাহিনীর মধ্যে এত ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে যে, অরণ্য জরিপে কয়েকটি শক্তিশালী টিম গিয়ে ফেরত আসেনি। ধারণা করা হচ্ছে, মুজাহিদরা ওদেরকে হত্যা অথবা বন্দী করেছে। তাই জেনারেল বোদায়েভ বিভিন্ন জেলা ও প্রদেশ থেকে কয়েক ডিভিশন সৈন্য তলব করেছে। লাল ফৌজের পদভারে আলমাআতার জনপদ ভারি হয়ে উঠেছে, শহর থেকে জনসাধারণকে সরে যেতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। শহরবাসীরা গ্রামগঞ্জে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। একটু পরপর বিপদ সাইরেন বাজান হচ্ছে। তাই আমি তোমাকে শহরে যেতে মানা করছি।"

যুদ্ধের কথা শুনে শহরে যাওয়ার আগ্রহ আমার অনেক বেড়ে গেল। আমি বৃদ্ধকে বললাম, বাবা! আমার খুবই প্রয়োজন, শহরে যেতেই হবে। দোয়া করুন, আল্লাহ যেন আমাকে হেফাজত করেন। আমি আলমাআতার দিকে ছুটে চললাম। কিছুক্ষণ পর আমি শহরের দুলাইলী নামক মোড়ে আসলাম। বুড়োর কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্য প্রমাণিত হল। শহরজুড়ে সেনাবাহিনীর গাড়ীবহর টহল দিচ্ছে। মাঝে-মধ্যে দ্রুতগামী সৈন্যযান সাইরেন বাজিয়ে ছুটে চলছে। মনে হল, যেন ওরা কোন পরাশক্তির সাথে লড়াইয়ের আয়োজন করছে। নামায পড়ার জন্য আমি দুলাইলী জামে মসজিদে প্রবেশ করলাম। মসজিদের করুণ অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলাম না। মসজিদের ভেতরে কিছু চানাচুর ও বিস্কুট ছড়িয়ে আছে। দু'একটি মদের বোতল বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মনে হল মসজিদটি মুসল্লীর অভাবে দীর্ঘদিন বিলাপ করছে। এ অবস্থা দেখে মনে পড়ল আল্লাহর বাণী-

"আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে খৃস্টানদের গির্জা-এবাদতখানা, ইহুদীদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ বিধ্বস্ত হয়ে যেত, যেগুলোতে আল্লাহর নাম অধিক স্বরণ করা হয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী শক্তিধর।" (সূরা হজ্ব: আয়াত ৩৯)

উক্ত আয়াত দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, শত্রুদেরকে যদি মাঝে- মধ্যে সাইজ করা না হয়, তবে তাদের রোষানলে পতিত হবে এবাদতখানাগুলো।

এ মসজিদটিই আয়াতে কারীমার বাস্তবতা ও সত্যতার সাক্ষ্য বহন করে। উক্ত মসজিদের খতীব আব্বুর সহকারী শিক্ষক শামায়েল বুখারী। তিনি ছিলেন হাদীসের শাইখ। মিম্বরে দাঁড়িয়ে তাকে কোন সময় জিহাদের বয়ান করতে শুনিনি। শুনিনি তাকে নির্যাতিত মুসলমানের পক্ষে কথা বলতে। মসজিদ-মাদ্রাসার খেদমত করাকেই তিনি জীবনের একমাত্র কাজ বানিয়ে নিয়েছিলেন। আহ! মসজিদ রক্ষা ও সংরক্ষণের ওয়াজ তাঁর জবান থেকে শুনিনি। তিনি তো শহীদ হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু তার মসজিদ আজ মদ্যশালায় পরিণত হয়েছে।

রাত আটটা। শহরে বেশি সময় অবস্থান করা উচিৎ নয়। চাচার সাথে সাক্ষাত করা দরকার। তাই আস্তে আস্তে সেদিকে পা বাড়ালাম। চাচা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, "বাবা! গতকাল আমার ঘোড়া বাড়ী ফিরে এসেছে। ঘোড়ার পিঠে কাউকে না দেখে আমি খুব চিন্তায় পড়ে যাই। তোমাদের কি অবস্থা, তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে অস্থির।" আমি চাচাকে মোটামুটি সব খবর শোনালাম। চাচা খুব খুশি হলেন। চাচার নিকট বর্তমান হালত জানতে চাইলে তিনি বললেন, আজ রাতে জঙ্গলে ক্র্যাকডাউন লাগানো হবে। হাজার হাজার লাল বাহিনী আলমাআতায় আনা হয়েছে। এ অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন জেনারেল মার্শাল বোদায়েভ।

চাচার নিকট থেকে সব খবর নিয়ে আমি বিদায় নিলাম। মনে মনে ভাবলাম, জামেউল উলুমের নিকট দিয়ে যাব। মাদ্রাসার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করব। তাই মাদ্রাসার রাস্তা ধরে অগ্রসর হলাম। দোকানপাট প্রায় সবই বন্ধ। সেনাবাহিনীর গাড়ী ছাড়া অন্য কোন যানবাহন তেমন একটা দেখা যায় না। গোটা শহরে অশান্তি বিরাজ করছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মাদ্রাসার নিকট এসে পৌঁছলাম। ঘাড় ফিরিয়ে দেখি শুধু আর্মি আর আর্মি। মাদ্রাসা পেছনে ফেলে আমি সামনে এগিয়ে যাই। হঠাৎ একজন আর্মি জোয়ান আমাকে ডাকল। আমি ভয়ে ভয়ে নিকটে গেলাম। সে আমাকে অনেক প্রশ্ন করল। আমি গা বাঁচিয়ে উত্তর দিলাম। সে আমাকে সেনাপতির নিকট নিয়ে যেতে চাইলে আমি আমার পরিচয়পত্র বের করে দেখালাম। সৈন্যটি পরিচয়পত্র দেখে আমাকে ছেড়ে দিল। আমি দ্রুতবেগে সাথীদের উদ্দেশ্যে ছুটে চললাম।

রাত দশটা। দূর থেকে দেখতে পেলাম নৌকার প্রদীপ মিট মিট করে জ্বলছে। নৌকার অদূরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক মানবমূর্তি, যা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। আমার গা শিউরে উঠল। এ কোন্ অভিসারিণী নিঝুম রাতে পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে? আমি সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলাম, এত রাতে কে তুমি? চোর না ডাকাত? আমার কণ্ঠ ছায়েমার অতি পরিচিত। পরিচিত কণ্ঠ শুনে বলে উঠল, আমি চোর। আমি মানুষ চুরি করি। উত্তর শুনে আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম।

আরও একটু হাঁটার পর আমরা নৌকায় এসে হাজির হলাম। সালামান্তে একে অপরের কুশল বিনিময়ে করলাম। ছায়েমা তার চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী খানা হাজির করল। আমি সবাইকে দাওয়াত দিলে উত্তর আসল, আমরা খেয়েছি, তোমরাও খাও। আমীর সাহেব ও জাফর ভাই খানা খেয়েছেন একটু আগে। শুধু ছায়েমা আমার অপেক্ষায়। দু'জন পৃথক পৃথক খানা খেলাম।

আমীর সাহেব কারগুজারী জানতে চাইলে আমি তাকে এলাকার থমথমে পরিস্থিতি ও হামলার বিবরণ জানালাম। ছায়েমা হঠাৎ প্রদীপ নিভিয়ে দিল। আমি ধমক দিয়ে বললাম, কি ব্যাপার, প্রদীপ নিভিয়ে দিলে যে ছায়েমা? সে উত্তর দিল, "আরে মিয়া! অন্ধকার দেখে ভয় পাও? অনেক দূর থেকে আলো দেখা যায়। এটা দুশমনের এলাকা। দূর থেকে আলো লক্ষ্য করে দুশমন গুলী ছুঁড়তে পারে কিংবা ধাওয়া করতে পারে।" ছায়েমার বিচক্ষণতা দেখে আমীর সাহেব বলে উঠলেন, "বাহ! তুমি তো একজন হুঁশিয়ার সৈনিক। এত সমরবিদ্যা কোথা থেকে শিখলে? তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।"

আমীর সাহেব জরুরী বৈঠক তলব করলেন। আমরা সবাই একসাথে বসে গেলাম। জাফর ভাই বললেন, ছায়েমা! সর্বাগ্রে তুমি তোমার মতামত পেশ কর। ছায়েমা বলল, "হুজুর! আমার ধারণা, সৈন্য যদি ক্র্যাকডাউন লাগায়, তবে রাত দু'টার দিকেই রণসাজে সুসজ্জিত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তারা আলমাআতা ত্যাগ করবে। ওরা ক্যাম্প খালি রেখে যাবে না। কিন্তু রসদপত্রসহ সৈন্য অবশ্যই রেখে যাবে। আমরা ইচ্ছা করলে রাত তিনটার দিকে আক্রমণ করে তাদের বিপুল ক্ষতিসাধন করতে পারব।"

আমরা সকলেই তার পরামর্শকে স্বাগত জানালাম। আমীর সাহেব ছায়েমাকে নৌকার হেফাজতে থাকতে নির্দেশ দিলেন। কারণ, একদিকে সে ষোল-সতের বছরের যুবতী, অপরদিকে কঠিন কাজ তার জন্য কষ্টকর হতে পারে।

এবার সায়েমা অনুরোধ ও সাহসিকতার সাথে বলে উঠল, "মাননীয় আমীর সাহেব! আপনাকে লাখো-কোটি মোবারকবাদ। আমি লড়াইয়ের ময়দানে উম্মে জিয়াদ ও বিবি খানছা (রাঃ)-এর মতো অবদান রাখতে চাই। যুদ্ধ থেকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করার মতো মেয়ে আমি নই। আমার একান্ত আশা, আজকের যুদ্ধে আমাকে অগ্রগামীদের মধ্যে রাখা হোক। রাখা হোক আমাকে তারুজী দলে। নেয়া হোক এ্যাকশন গ্রুপে। আমি মহামান্য আমীর সাহেবের নিকট আমার বিষয়টি পুনর্বিবেচনার আবেদন করছি। আশা করি, মোহতারাম আমীর সাহেব আমার দরখাস্ত মঞ্জুর করবেন।"

আমীর সাহেব কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন, "বেটি! তোমার জিহাদী জযবা দেখে আমি সত্যি আনন্দিত হলাম। আজ মুসলমানরা অকাতরে জীবন হারাচ্ছে। মা-বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হচ্ছে। গরু- ছাগল ও জীব-জানোয়ারের সমান মূল্যও আজ মুসলমানদের নেই। মুসলমানরা হারাচ্ছে তাদের রাষ্ট্র। ভুলে গেছে তাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। জিহাদ ছেড়ে দিয়ে তারা গোলামের জাতিতে পরিণত হয়েছে। দুনিয়ার মহব্বত আর মৃত্যুর ভয়ে তারা জিহাদ তরক করে চলেছে। যারা আমাদের রাহবার, তারাও আজ জিহাদ থেকে বিমুখ। তোমার মতো দ্বীনের দরদ যদি আলেমদের মনে থাকত, তাহলে ইসলাম আজ বিপন্ন হত না।" ছায়েমার কাকুতি-মিনতি শুনে আমীর সাহেব অনুমতি দিলেন।

আমাকে দিলেন নৌকা পাহারার দায়িত্ব। ছায়েমা খুশিতে বাগ বাগ। এখন সে রণসাজে সজ্জিত হচ্ছে। বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে। ভাবছে, বিজয়মালা ছিনিয়ে এনে আমার গলায় পরাবে। আবার ভাবছে, হয়ত শাহাদাত মিলে যাবে। চলে যাবে পরম শান্তির নিকেতন জান্নাতে। সবাই আক্রমণের উদ্দেশ্যে নৌকা ত্যাগ করল। আমি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাফেলা বিদায় দিয়ে নৌকায় ফিরে এলাম।

রাত দু'টার বেশী বাজছে। এখনো গোলাগুলীর আওয়াজ শুনতে পাইনি। আমি সেজদায় পড়ে কামিয়াবির দোআ করছি। হঠাৎ প্রচণ্ড গোলাগুলীর আওয়াজ কানে আসল। হামলা হয়েছে প্রচণ্ড। আসমান- জমিনের নীরবতা ভঙ্গ করে এক প্রলয়ংকরী অবস্থার সৃষ্টি হল। এক পোস্টের আওয়াজে অন্য পোস্টের সেনারাও গুলী ছুঁড়ছে বলে মনে হল। মনে হল পুরো আলমাআতা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। অরণ্য থেকে কোন গুলীর আওয়াজ শোনা যায়নি। হঠাৎ আমার মনে পড়ল, ওরা তো রাতে ক্র্যাকডাউন করে দিনের বেলা তল্লাশি চালাবে। গুলীর কোন প্রশ্নই আসে না। রাত প্রায় শেষ। এমন সময় জাফর ভাই গনীমতসহ নৌকায় ফিরে আসলেন। আমীর সাহেব ও ছায়েমা এখনো ফিরে আসেননি। জাফর ভাই বললেন, আমরা তিনটি পোস্টে আক্রমণ করেছি। বিশেষ বিশেষ স্থাপনায় রকেটলাঞ্চার নিক্ষেপ করে ওসব ধ্বংস করেছি। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও বেতার সেন্টার সম্পূর্ণ ধ্বংস না হলেও বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং পুরো এলাকা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।

আমরা আমীর সাহেব ও ছায়েমার জন্য পেরেশান। তাদের জন্য দোআ করছি। সামান্য একটু পরে আমীর সাহেব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নৌকায় ফিরলেন। গুলীর আয়াতে তিনি যখমী হয়েছেন। জাফর ভাই নিজেই প্রাথমিক চিকিৎসা করলেন। ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। কিন্তু ছায়েমা তো আসছে না! হায়! হতভাগিনী কি শহীদ হয়ে গেল, নাকি আহত অবস্থায় পড়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে? নাকি দুশমনের হাতে বন্দী হল? আমীর সাহেব নিজেও অস্থির। তিনি বললেন, "সে তো ময়দানে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে, যা দশজন সৈন্যের পক্ষেও সম্ভব ছিল না। সে তো আমাদের পাশে পাশেই ছিল। এলোপাতাড়ি গোলাগুলীতে যখন ছুটাছুটি করছিল, তখন সে আমাদের চোখের আড়াল হয়ে যায়।" অধীর আগ্রহে আমরা ছায়েমার পথপানে তাকিয়ে রইলাম।

রাত শেষ। কাক ডাকছে। পাখিরা উড়ছে। ভোরের পাখির কণ্ঠ থেকে রাঙ্গা রবির আগমন বার্তা শোনা যাচ্ছে। আমরা তাড়াতাড়ি নামায পড়ে নিলাম।

আমীর সাহেব নামাযান্তে সবাইকে নিয়ে বসলেন এবং বললেন, "সমস্যা আমাদের তিনটি ১. এ স্থান জলদি ত্যাগ করতে হবে ২. ছায়েমার সন্ধান করা ৩. হাটবাজার করা ও নিজের চিকিৎসা করা।"

সমস্যার কথা বলে তিনি ফয়সালা দিলেন যে, "খোবায়েব জামবুলী পোশাক পাল্টিয়ে পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে ছায়েমার সন্ধানে যাবে। জাফর সাহেব এক মাসের বাজার-সওদা ও ওষুধপত্র খরিদ করবে। আমি নিজেই স্থানীয় ক্লিনিকে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা নেব।" জাফর ভাই বাজারে চলে গেছেন। আমি খানাপিনার ব্যবস্থা করলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি একটি ভ্যানে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সওদা নিয়ে এলেন। আমরা একসাথে খানাপিনা শেষ করলাম।

আমীর সাহেব জাফর ভাইকে নৌকায় থাকতে বললেন। আমি আমীর সাহেবকে নিয়ে ক্লিনিকের দিকে রওনা হলাম। ক্লিনিকে গিয়ে একজন দ্বীনদার ডাক্তার পেলাম। ডাক্তার আমীর সাহেবের ক্ষতস্থান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝতে পারলেন এটা গুলীর আঘাত। ছররা গুলীর অংশ এখনও রয়ে গেছে। এগুলো বের করে তিনি সেলাই করলেন। ওষুধপত্র দিলেন। আমরা যে মুজাহিদ, তা তিনি বুঝতে ভুল করেননি। ডাক্তার সাহেব চিকিৎসার বিনিময় এক পয়সাও নেননি বরং বেশকিছু টাকা দিয়ে বললেন, "জিহাদের কাজে এগুলো খরচ করবেন।"

আমরা ডাক্তার সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে নৌকায় ফিরে এলাম। সকাল ১০টার অধিক হয়ে গেছে। স্থান ত্যাগ করা ও ছায়েমার সন্ধানে যাওয়া এক্ষুণি দরকার। আমীর সাহেব বলেন, "আমরা নৌকা নিয়ে দক্ষিণের খাল বেয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে চলে যাব। জঙ্গলের দিকে যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি খুব সতর্কতার সাথে অবশ্যই ছায়েমাকে খুঁজে বের করবে। আল্লাহ তোমার হেফাজত করবেন। ছায়েমার খোঁজ নিয়ে দেরি করো না, জলদি নৌকায় ফিরে এসো।"

আমীর সাহেবের কথামতো আমি পোশাক পাল্টিয়ে পরিচয়পত্র সঙ্গে নিয়ে আলমাআতা অভিমুখে যাত্রা করলাম। আমীর সাহেব ও জাফর ভাই নৌকা নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে রওনা হলেন।





Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp