আধার রাতের বন্দিনী পর্ব- ৫
[বার]
একদিকে সারারাত ঘুমজাগা, অপরদিকে ছায়েমার চিন্তা। মেয়েটা কোথায় আছে, কোথায় পাব? আমি রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে পথ চলছি। বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই, নেই হৃদয়ের প্রশান্তি। সব মিলিয়ে আমি যেন এক উন্মাদ। তবুও আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রেখে পথ চলছি। চারদিকে হাহাকার আর অশান্তি বিরাজ করছে। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা কারো মুখে হাসি নেই। গোটা এলাকাটাই যেন বিরান।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। আমি শহরের প্রধান ফটক অতিক্রম করে নগরীতে প্রবেশ করলাম। যানবাহন না থাকায় পায়ে হেঁটে আলমাআতা জামেউল উলুম মাদ্রাসায় আসলাম। গেটে গেলে আরপি পথ আগলিয়ে দাঁড়াল। আমার পরিচয় চাইল। আমি আমার পরিচয়পত্রটা হাতে দিয়ে বললাম, সেনাপতি বোদায়েভের সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। তিনি আছেন কি? সিপাহী উত্তর দিল, "তিনি এখানে নেই! গভীর অরণ্যে ক্র্যাকডাউন দেয়ার জন্য তিন হাজার সৈন্য নিয়ে স্পটে আছেন।"
আমি অনুরোধ করে বললাম, স্যার! গত রাতে এদিকে অনেক গোলাগুলীর আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে কি?
সিপাহী বলল, "হ্যাঁ, রক্তক্ষয়ী এক দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা সৈন্যদেরকে বিদায় দিয়ে খুব সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। শেষ রজনীতে অতর্কিতে চারদিক থেকে শত শত মুজাহিদ ক্যাম্প আক্রমণ করে। এতে ষাটজন সৈন্য নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ডজনখানেক। তাছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ও বেতার ভবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বিধ্বস্ত হয়েছে। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।"আমি আবার প্রশ্ন করলাম, স্যার! কোন মুজাহিদ নিহত বা গ্রেফতার হয়নি?
তিনি বললেন, "না, তবে সন্দেহভাজন কিছু লোককে বন্দী কর বাসকাউন্ড এলাকায় এক পরিত্যক্ত তুলার গুদামে রাখা হয়েছে, ওদেরকে সেখানেই খতম করা হবে।" আমি সমবেদনা ও নিন্দা জ্ঞাপন করে বললাম, স্যার! তাহলে তো আমাদের বেশি ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু ওদের যে কিছুই করতে পারেননি, তার কারণ কি? সিপাহী বিরক্ত হয়ে বললেন, "বেটা! ওদের ঘায়েল করা কি এত সহজ? বাংকারের সৈন্য ছাড়া বাকি সব সৈন্যই মারা পড়েছে। সারা দেশের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। যাবতীয় যন্ত্রপাতি ও কলকব্জা ধ্বংস হয়ে গেছে। অন্য সব ক্যাম্পের সাথেও কোন যোগাযোগ হচ্ছে না। মনে হয় ওসব ইউনিটও নিরাপদ নেই। কারণ, প্রচণ্ড গোলাগুলীর আওয়াজ শোনা গেছে।"
আমি করজোরে নিবেদন করলাম, স্যার! এ মুহূর্তে আমি আপনাদের কি সাহায্য করতে পারি? আমরা কমিউনিস্ট যুবক যারা আছি, সবাই আপনাদের খেদমতের জন্য প্রস্তুত আছি। আপনার হুকুমের অপেক্ষায়...।
সৈন্যটি থ্যাংকইউ বলে মোবারকবাদ জানালেন। তারপর বললেন, "বাবা! যদি পার, তবে ঘুরে ঘুরে অন্য সব ক্যাম্পের খবর ও মুজাহিদদের খবর সংগ্রহ কর। পরবর্তীতে দেখি কোন এ্যাকশন নেয়া যায় কিনা।" আমি বললাম, স্যার! বাহন নেই, কিভাবে এসব সংবাদ সংগ্রহ করতে পারি? তিন-চার দিনেও হয়ত সম্ভব হবে না। সিপাহী বলল, "আমাদের অনেক ঘোড়া রয়েছে, তোমার যেটা পছন্দ নিয়ে যাও। দেখ, আবার মুনাফিকী কর না।" আমি তার কথামত একটি তাজি ঘোড়া বেছে নিলাম। অতপর ঘোড়া হাঁকিয়ে দ্বিতীয় সেনা ছাউনীতে গেলাম। সেখানে গিয়ে ক্যাম্প কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করে এখানকার অবস্থা জানতে চাইলাম। অফিসার বললেন, "তুমি কে? তোমার পরিচয় কি?"
আমি বললাম, আলমাআতা আমার নিবাস, কমিউনিস্ট বিপ্লবের কর্মী। আলমাআতার ভ্রাম্যমান ক্যাম্পের সেনানায়ক আপনাদের সংবাদ নেয়ার জন্য আমাকে প্রেরণ করেছেন। এই বলে আমি আমার পরিচয়পত্রটা তার হাতে দেই। তিনি নিরীক্ষা করে যাচাই করলেন। তারপর সব ঘটনার বর্ণনা দিলেন এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য বললেন। আমি দ্রুত হাসপাতাল থেকে বড় ডাক্তার এনে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করলাম।
আমি বললাম, স্যার! আমি আপনাদের সংবাদ নিয়ে সেনানিবাসে যাব। প্রয়োজনীয় রসদপত্রের একটি তালিকা দিলে হয়ত আপনাদের জন্য বরাদ্দ করবেন। তিনি আমার কথামত রসদ ও জরুরী ওষুধপত্রের একটি তালিকা আমার হাতে দিয়ে বললেন, "যাও বাবা! দেখ আমাদের জন্য কিছু করতে পার কিনা।" আমি আবেদন জানালাম, স্যার! আমি যে আপনার এখানে পরিদর্শন করেছি, তার একটা সত্যায়নপত্র দিলে ভাল হয়। তিনি আমাকে সুন্দরভাবে একটি সত্যায়নপত্র লিখে দিলেন।
বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩
▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪
🌹 ধন্যবাদ 🌹
পড়ন্ত বেলা। এখানে বেশিক্ষণ দেরী করা ঠিক হবে না। তাই সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি বাসকাউন্ডের দিকে ঘোড়া হাঁকালাম। বিকেল ছয়টার দিকে বাসকাউন্ডে এসে উপস্থিত হলাম। আলমাআতা থেকে বাসকাউন্ড প্রায় ষাট কিলোমিটার রাস্তা। দু'তিন জায়গায় বিশ্রাম নিতে হল। বেশ ক'বার নিতে হয়েছে রাস্তার সন্ধান। বাসকাউন্ড অন্যসব জনপদের মত নয়। এটি শীতপ্রধান এলাকা। সাইবেরিয়ার বরফাঞ্চলের হীমপ্রবাহ বাসকাউন্ডের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এলাকাটা ঘন জঙ্গল না হলেও গাছগাছালি প্রচুর। কৃষিপ্রধান এলাকা। হাটবাজার দূরে দূরে। এলাকাটা অনেকটা অবহেলিত। লোকসংখ্যাও কম। গ্রাম্য পরিবেশ। অনেক পথ অতিক্রম করেও আমি তুলার গুদামের সন্ধান পেলাম না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। হাড় কাঁপান শীত। পথঘাট অচেনা। লোকজন কম। আমি চিন্তার পাহাড় মাথায় নিয়ে ঘুরছি, যেন আমি মজনু-লায়লার খোঁজে ঘুরছি। হঠাৎ এক যুবকের সাথে সাক্ষাত হল।
তাকে পেয়ে আমার পেরেশান অনেকটা লাঘব হল।তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাইজান। আপনার নাম কি? উত্তর দিল, "আবদুর রশীদ।"
আপনার বাড়ী কোথায়?
সামনের একটি গ্রাম দেখিয়ে বলল, "ঐ গ্রামে।"
এখানে তুলার গোডাউন কোথায় বলতে পারেন কি?
যুবক উত্তর না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করল, "ভাই! আপনার পরিচয় জানতে পারি কি?"
আমি বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই জানতে পারেন। আমার নাম খোবায়েব জামবুলী, আলমাআতার অন্তর্গত জামবুলে আমার নিবাস। আমি কলেজে অধ্যয়ন করছি। বর্তমানে লাল বাহিনীর গুপ্তচর। কমিউনিস্ট বিপ্লবে বিশ্বাসী। লেনিনের আদর্শের অনুসারী।
যুবকটি আমার পরিচয় জেনে ভয় পেয়ে গেল। তার চেহারায় ফুটে উঠেছে আতংকের ছাপ। আমি তার অবস্থা বুঝতে পেরে অভয় দিয়ে বললাম, আমি তোমার উপর কোন জুলুম করব না। ভয় পেও না। আমাকে তুলার গোডাউনে নিয়ে চল।
যুবক বলল, "ভাই! তুলার গুদাম অনেক দূর। সেখানে যেতে রাত অনেক হয়ে যাবে। তাছাড়া ওখানে যাওয়াও নিরাপদ নয়। কারণ, সেখানে অনেক মুসলিম নারী-পুরুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। ওদিকে কোন লোককে যেতে দেয়া হয় না। তিনজন আর্মি দিন-রাত অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে।"
যুবকের কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। কারণ, না জেনে না শুনে হঠাৎ কিছু করা ঠিক হবে না। আমি তাকে বললাম, ভাই, আমি আজ আপনার ঘরে মেহমান হতে চাই।
যুবক বলল, "হ্যাঁ, অবশ্যই। চলুন গরীবালয়ে।" আমি যুবককে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে তার বাড়ীর দিকে ছুটলাম। যখন তার বাড়ী পৌছি, তখন মাগরিবের সময় যায় যায়। আমি তাড়াতাড়ি নামায পড়ে নিলাম। আমাকে নামায পড়তে দেখে বাড়ীর সকলে কানাকানি করতে লাগল- "তাহলে কি লোকটি মুসলমান? কিন্তু তার গায়ে এ পোশাক কেন? শুনলাম, লোকটি লাল বাহিনীর সদস্য। এ কি করে হয়?" বাড়ীর লোকজন এসব নিয়ে বলাবলি করছে। এ সময় আবদুর রশিদের আব্বা কাজী হাসান আমার নিকট এসে বললেন, "বাবা! তুমি কি মুসলমান?"
আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি মুসলমান।
"কিন্তু পোশাক-আশাকে তো তোমাকে কমিউনিস্ট মনে হচ্ছে?"
আমি বললাম, তা ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।
"তুমি তুলার গুদামের খোঁজ করছ কেন?"
বললাম, শুনেছি ওখানে আমার মুসলিম মা-বোনরা বন্দী আছে। বন্দী আছে আলেম-ওলামা ও পরহেজগার মুসলমানরা। আমি তাদেরকে। মুক্ত করতে এসেছি জামবুল থেকে। আমি তাদের চোখের পানি মুছতে এসেছি। মা-বাবার কোলে ওদের ফিরিয়ে দিতে এসেছি। আমার কথা শুনে কাজী হাসান সাহেব চোখের পানিতে বুঝ ভাসালেন। কেঁদে কেঁদে বললেন, "বাবা! আমার বড় ছেলে আবদুস সামাদকে ওরা বন্দী করে ঐ তুলার গোডাউনে নিয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও রাখতে পারিনি।"
আমি বৃদ্ধকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আর বিলাপ করবেন না। আল্লাহ চাহেন তো আপনার বুকের ধন আবার আপনার নিকট ফিরে আসবে। আমার কথাগুলো বাড়ীর সবাই শুনল। আবদুর রশিদ আমাকে অনেকটা আপন করে নিল। বৃদ্ধ খুব যত্ন সহকারে আমাকে নিজের ছেলের মত খানা খাওয়ালেন। আমি আবদুর রশিদকে গোডাউনের রাস্তার কথা জিজ্ঞেস করলে সে রাস্তার সন্ধান দিল। আমি তার কথা অনুযায়ী রাস্তার ম্যাপ করে নিলাম। সে জিজ্ঞেস করল, "ভাই! এই রাতে এত ব্যস্ত হলেন কেন? আগামীকাল রাস্তা দেখিয়ে আমি নিজেই আপনার সঙ্গে যাব।"
আমি বললাম, আবদুর রশীদ! ওরা তুলার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মানবতের জীবন কাটাবে আর আমি তোমাদের গৃহে নরম বিছানায় শুয়ে আরাম করব, তা কখনো হতে পারে না। আজ রাতেই ওদেরকে মুক্ত করতে হবে। আমার কথা শুনে আবদুর রশীদের সাহস অনেকটা বেড়ে গেল। সে বলল, "ঠিক আছে ভাইজান! আমি আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব।"
ওর কথায় আমি খুব খুশি হলাম। এশার সময় হয়ে গেছে কিছু আগেই। আমি আবদুর রশীদকে নিয়ে নামায আদায় করে কামিয়াবীর জন্য দোআ করলাম। তারপর একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করে ঘোড়ায় আরোহন করে বুকে বন্দী মুক্তির আশা নিয়ে দু'জনে ছুটলাম।
আমরা আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে চলছি। আবদুর রশীদ ঘোড়ার পেছন বসে আমাকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে। রাত প্রায় একটার দিকে আমরা তুলার গোডাউনের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হলাম। ঘোড়াটি একটু দূরে গাছ-গাছালির আড়ালে বেঁধে নগ্নপায়ে বিড়ালের মত এগিয়ে চললাম। দেখতে পেলাম, একজন গোডাউন পাহারা দিচ্ছে আর দু'জন নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। আবদুর রশীদকে চুপে চুপে বললাম, পাহারারত ব্যক্তির অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়ার সাথে সাথে ঘুমন্ত দু'জনের অস্ত্র হাতে উঠিয়ে নেবে চোখের পলকে। আমরা দেয়ালের অন্তরালে লুকিয়ে আছি। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আস্তে করে কয়েক কদম অগ্রসর হয়ে অস্ত্রটি কেড়ে নিয়ে ওর বুকে তাক করে বললাম, হারামজাদা, শব্দ করলে ঝাঁঝরা করে দেব।
সৈন্যটি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইল। আবদুর রশিদ বিলম্ব না করে বাকী দু'টি অস্ত্রও হাতে তুলে নিল। তারপর এক এক করে তিনজনকে বেঁধে ফেললাম। ওদের থেকে চাবি নিয়ে লোহার গেট খুলে গোডাউনে প্রবেশ করলাম। আহ! এটা তুলার গোডাউন নয়। আমি কসম করে বলতে পারি, এটা অন্ধকারের গোডাউন।
পাহারাদার থেকে টর্চলাইট নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। মনে হল এটি একটি গ্রাম। আমি বন্দীদেরকে লক্ষ্য করে বললাম, হে আমার বন্দী ভাই-বোনেরা! এখন তোমরা মুক্ত। জলদি বেরিয়ে আস। যার যার বাড়ী ফিরে যাও। আমার কথা শুনে তারা হুমড়ি খেয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। কার আগে কে বের হবে প্রতিযোগিতা চলছে। সবাই বেরিয়ে এল। কিন্তু ছায়েমাকে দেখছি না। আমার হৃদয় কেঁদে উঠল। হায়! এত কষ্ট করে এলাম! অথচ এখানে সে নেই। তাহলে কি হায়েনারা ছায়েমাকে শহীদ করে দিয়েছে! নাকি অন্য কোন বন্দী শিবিরে লুকিয়ে রেখেছে?
এসব চিন্তায় আমার গণ্ডদ্বয় অশ্রুতে ভিজে যাচ্ছে। বুকের জ্বালা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামলানো আর সম্ভব হচ্ছে না। দুনিয়াটা একেবারে অন্ধকার মনে হচ্ছে। কিন্তু তারপরও হৃদয়ে আশার আলো প্রজ্বলিত করলাম।
শেষবারের মতো আবার লাইট টিপে দেখার ইচ্ছা হল। আবদুর রশীদের হাত ধরে অনেক ভেতরে ঢুকলাম। এমন সময় ছায়েমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। ছায়েমা সিজদায় পড়ে প্রার্থনা করছে, "ইয়া আল্লাহ! আমরা আজ কাফেরদের হাতে বন্দী। তুমি ছাড়া মুক্তিদাতা, আর কেউ নেই। তুমিই আমাদের একমাত্র ভরসা। এই জিন্দানখানা থেকে তুমি আমাদের মুক্তি দাও। হে আল্লাহ! আমার খোবায়েবকে তুমি হেফাজত কর। হে আমার মাওলা! কাফেরদের ছোবল থেকে দেশকে মুক্ত কর। ঘুমন্ত মুসলমানদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দাও। জিহাদী নিশান দিকে দিকে উত্তোলন কর।"
আমি পেছনে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলাম, আমীন।
এবার ছায়েমা আমাকে আবিষ্কার করে বলে উঠল, "খোবায়েব ভাইয়া! আবার তুমি বন্দিনীকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে এসেছ? তুমি না নৌকায় ছিলে? এখানে আসলে কি করে?" আমি বললাম, তোমাকে মুক্ত করতে এসেছি। এই বলে আমি ছায়েমাকে হাত ধরে বাইরে নিয়ে এলাম। বন্দী সৈন্যরা মাটিতে পড়ে আছে। এদেরকে হত্যা করতে হবে। লাশও গুম করতে হবে। আমি আবদুর রশীদকে জিজ্ঞেস করলাম, এদের লাশ কোথায় কিভাবে রাখলে গোপন থাকবে? সে বলল, জঙ্গলে একটি গভীর কূপ আছে। সেখানে কোন লোকজন যায় না, ওখানে রাখা যাবে। আমরা গলায় ফাঁস লাগিয়ে তিনজনকে হত্যা করে কূপে সোপর্দ করি। অতপর সৈনিকের পোশাক ও অস্ত্রশস্ত্র গনীমত হিসেবে নিয়ে তিনজন আবদুর রশীদের বাড়ীতে ফিরে আসি।
আবদুর রশীদের বড় ভাই আবদুস সামাদকে ফিরে পেয়ে বাড়ীর সবাই কান্না শুরু করে দেয়। রাত প্রায় শেষ। আমি ও ছায়েমা দু'রাকাত নফল নামায পড়ে আল্লাহর সমীপে শুকরিয়া আদায় করলাম। তারপর ফজরের নামায আদায় করে ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
[তের]
সকাল আটটা। মানুষের কলরবে আমাদের সুখনিদ্রা ভেঙ্গে গেল। বাড়ীর ভেতরে ও বাইরে শোরগোল শোনা যাচ্ছে। কিসের এত আওয়াজ? কিসের এত শোরগোল? কেন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার আগমন আবদুর রশীদের বাড়ীতে। হঠাৎ এক অচেনা কণ্ঠের আওয়াজ কানে আসল, "কে সেই মহাপুরুষ, যিনি তোমাদেরকে উদ্ধার করে এনেছেন? কে সেই মহামানব, যিনি তোমাদের মুক্ত করতে মরু কান্তার পেরিয়ে সুদূর আলমাআতা থেকে ছুটে এসেছেন?" কথাগুলো বলছিলেন এক আগন্তুক। এসব কথা কানে আসলে বুঝতে পারলাম, এলাকার লোকজন উদ্ধারকৃত বন্দীদেরকে দেখতে আসছে।
এমন সময় আবদুর রশীদ এসে বলল, "ভাই খোবায়েব! এলাকার লোকজন আপনাকে দেখতে চায়।" আমি আবদুর রশীদকে বললাম, উপস্থিত লোকজনকে এক জায়গায় সমবেত কর। আবদুর রশীদ তাই করল। আমি বারান্দায় বেরিয়ে এসে আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ বলে সালাম দিলাম। জনতা সমস্বরে ওয়াআলাইকুমস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহু বলে জবাব দেয়। আমি উপস্থিত জনতাকে উদ্দেশ করে বললাম-
আমার প্রিয় দেশবাসী! আজ মুসলিম উম্মাহ বলসেভিকদের কাছে জিম্মি। তারা ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের অধিকার, আমাদের স্বাধীনতা। আমরা আজ নির্যাতিত, নিপীড়িত। প্রতিনিয়ত চলছে উৎপীড়নের স্টীমরোলার। মুসলমানদের উপর বাতিলরা আজ খড়গহস্ত। জাতিকে উদ্ধার করতে হলে, দেশকে বাঁচাতে হলে, আল্লাহর যমীনে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে হলে জান-মাল নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। তাছাড়া নিস্তার পাওয়ার বিকল্প কোন পথ আল্লাহ ও তার রাসূল বলে যাননি।
হে আমার দেশপ্রেমিক ও দ্বীনদরদী বন্ধুরা! বলসেভিকরা অত্র এলাকা থেকে নিরীহ জনগণকে ধরে নিয়ে গেছে। তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে। লুণ্ঠণ করছেন সতি-সাধ্বী মা-বোনদের ইজ্জত। আপনারা শুধু ঘৃণা করছেন, প্রতিবাদ করছেন। দোয়াও করছেন। কিন্তু
কোন বন্দী আপনাদের দোআ-প্রতিবাদ আর ঘৃণা দ্বারা মুক্তি পায়নি। মুক্তি পেয়েছে জিহাদের দ্বারা। তারা মুক্তি পেয়েছে আক্রমণ দ্বারা।
আমার কথায় সকলেই মাথা নেড়ে নেড়ে সমর্থন জানাল। উপস্থিত লোকেরা আমার কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিল। কিন্তু সময় না থাকার কারণে বক্তব্যের যবনিকা টানতে বাধ্য হলাম।
সকাল দশটা। ফিরে যেতে হবে আলমাআতায়। সেদিকে আবার কোন্ অঘটন ঘটে যায় কে জানে। আমি ছায়েমাকে কাছে ডেকে বললাম, তুমি এখানে দু'এক-দিন বিশ্রাম নাও। আমি ওদিকের খবরা- খবর জেনে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। আমার কথায় ছায়েমা হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল। তারপর কাতর সুরে বলল, "তুমি আমাকে একা ফেলে যেওনা। তোমাকে ছাড়া আমি যে এক মুহূর্তও থাকতে পারিনা। তুমি আমাকে সাথে নিয়ে চল।"
আমি বললাম, ওদিকের অবস্থা খুবই গরম, তাতো অবশ্যই জান। এ এলাকা অনেকটা শান্ত। তাই তুমি এখানে অবস্থান করতে থাক। আমি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরে আসব। তোমাকে একা রেখে আমিও নিশ্চিন্তে থাকতে পারব না।
ছায়েমা রাজি হল। আমি আব্দুর রশিদকে ডেকে বুঝিয়ে বললাম, এ লোকটির প্রতি নজর রাখবে। আবদুর রশিদ বলল, "ভাইয়া! এ বলতে হবে না। আমি জীবন দিয়ে তাকে হেফাজতে রাখার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।"
বৃদ্ধ খানা নিয়ে হাজির হলেন। আমি ছায়েমাকে নিয়ে খানা খেলাম। আমি সকলের নিকট থেকে দোআ চেয়ে সালাম দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। ঘোড়া আমাকে নিয়ে দ্রুতগতিতে আলমাআতা অভিমুখে ছুটে চলল। মাঠঘাট-বনবাদার পেরিয়ে পাগলের মত ছুটে চলল। ছায়েমা অপলক নেত্রে তাকিয়ে রইল। মুজাহিদদের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ায় দূরদূরান্ত থেকে নেমে আসল জনতার ঢল, বাঁধভাঙ্গা তরঙ্গ। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে ছায়েমার দিকে তাকায়। মুজাহিদ দেখার সাধ আর তাদের মেটে না। তার সঙ্গে তারা কথা বলতে চায়। ছায়েমা আমার চিন্তায় মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
দুপুর বারটা। প্রচণ্ড তাপে বিদগ্ধ ধরণী। ছায়েমা সবাইকে বলে দিল, "বিকেলে সময় পেলে আসবেন, তখন কিছু কথা বলব। এখন আর পারছি না।" সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। ছায়েমার কথামত চারদিক থেকে লোকজন ছুটে আসছে আবদুর রশীদের বাড়ীতে। দহলিজে লোক আর ধরে না। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। দক্ষিণের আপেল বাগানে চেয়ার-টেবিল পাতা রয়েছে। লোকজন তরুণ মুজাহিদের বক্তব্য শুনবে। তাকে একনজর দেখবে। ছায়েমা কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসল। সবাই অপলক নেত্রে তাকিয়ে আছে! আহ! কি সুন্দর! কি অপরূপ চেহারা। এখনো দাড়ি-গোঁফ গজায়নি। তরুণ মুজাহিদ! গায়ে তার সৈনিকের পোশাক। ছেলে না মেয়ে চেনা যায় না।
ছায়েমা সকলের সাথে হাসিখুশি ব্যবহার করছে। আবদুর রশীদ সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে। ওরা দু'ভাই দু'বোন। দাদা গ্রামের মাতব্বর। গোটা পরিবারই শিক্ষিত। দ্বীনদারীরও অভাব নেই। প্রতিবেশীরা চায় ছায়েমাকে দাওয়াত করে খাওয়াতে। কিন্তু আবদুর রশিদদের মেহমান অন্যরা নেবে, তার সাহস ক'জনেরই বা আছে? ছায়েমা অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির। দিলে তার পর্দার ভয়। নিরিবিলি থাকতে পছন্দ করে। তা সত্যেও লোকজনের সাথে কিছু কথাবার্তা না বললেই নয়।
আবদুর রশীদের দু'বোন বেলিন্তিনা ও নাঈমা। ওরা স্কুলের ছাত্রী, ছায়েমার সমবয়স্কা। ওরাও ছায়েমার পেছনে লেগে আছে। সারাক্ষণ কাছেই থাকতে চায়। আবদুর রশীদ ও তার বড় ভাই আবদুস সামাদ; এরাও চায় ছায়েমাকে নিয়ে এদিক-ওদিক ঘুরাফেরা করতে। কিন্তু ছায়েমা পাশ কেটে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ওদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারছে না ছায়েমা। তাই আপেল বাগানের আড্ডায় অংশগ্রহণ করে।
ছায়েমা লজ্জা একটু আড়াল করে যুবকদেরকে ধর্মের কাহিনী শোনায়। স্মরণ করিয়ে দেয় হারান দিনের ইতিহাস। সকলেই অধীর আগ্রহে তার বক্তব্য শোনে। ছায়েমা হেফজ শেষ করে বেশকিছু কিতাবও অধ্যয়ন করেছে। মাসআলা-মাসায়েলও জানা আছে তার। সে আলোকেই বয়ান-বক্তৃতা ও আলোচনা করতে গিয়ে সে বলল, "আমার যুবক ভাইয়েরা! মুসলমানদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু, তাহজীব- তামাদ্দুন হেফাজতের জন্য আল্লাহ আমাদের উপর জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ফরয করে দিয়েছেন। কিতাল ফী সাবীলিল্লাহর ব্যাপারে পবিত্র কালামে ছয়শ' আশি জায়গায় আলোচনা করা হয়েছে। আর নামাযের আলোচনা করা হয়েছে মাত্র আশি জায়গায়। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের মত জিহাদও একটি ফরজ ইবাদত। জিহাদ দুই প্রকার, প্রথম প্রকার হচ্ছে জিহাদে ইকদামী আক্রমণমূলক জিহাদ। এটা ফরযে কেফায়া। অর্থাৎ মুসলমানদের কোন একটা দল যদি তা আদায় করে, তবে সকলের উপর থেকে ফরযের জিম্মা আদায় হয়ে যায়। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বছরে কমপক্ষে দু'বার কাফের রাষ্ট্রে আক্রমণ করা হল আক্রমণমূলক জিহাদ। যেন কাফেররা সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। ওরা যেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে না পারে। যদি এমন একটি শক্তিশালী জামাত ও বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র থাকে যে, দুমশনের উপর আক্রমণ করে বিজয়ী হতে পারবে, তবে অন্যসব মুসলমান যুদ্ধে না গেলেও গোনাহ হবে না। এক জামাত আদায় করলেই আদায় হয়ে যাবে।
দ্বিতীয় প্রকার জিহাদকে প্রতিরক্ষামূলক জিহাদ বলে। এটা সবসময় ফরযে আইন। জিহাদ ফরযে আইন হওয়ার শর্ত চারটি। চার কারণের যে কোন একটি কারণ পাওয়া গেলে সমস্ত উম্মতের উপর পর্যায়ক্রমে জিহাদ ফরযে আইন তথা অবশ্য কর্তব্য হয়ে যায়। যথা- এক) মুসলমানদের বিজিত এলাকার এক বিঘত পরিমাণ জমি কাফেররা দখল করলে এ জায়গা উদ্ধার করা ঐ এলাকার মুসলমান নারী-পুরুষের উপর ফরযে আইন। যদি এমন হয়, ওরা জিহাদ করতে পারছে না বা জিহাদ করছে না, উভয় অবস্থায় পার্শ্ববর্তী মুসলমানের উপর জিহাদ ফরযে আইন। পার্শ্ববর্তী মুসলমান জিহাদ করছে না, এমতাবস্থায় দূরবর্তী মুসলমানদের জন্য জিহাদ ফরযে আইন। এরাও যদি না করে বা না করতে পারে, তবে গোটা দুনিয়ার মুসলমানের উপর জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায়।
দুই) কোন মুসলিম পুরুষ বা নারী যদি কাফেরদের হাতে বন্দী হয়, তবে সে বন্দী বা বন্দিনীকে উদ্ধারকল্পে (উল্লেখিত) পর্যায়ক্রমে জিহাদ ফরযে আইন।
তিন) কাফেররা যদি মুসলিম ভূখণ্ডের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়, পরিখা (বাংকার) খনন করে, ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে, বেশী বেশী সমরাস্ত্র তৈরি বা ক্রয় করে, সেনাবাহিনীতে মুসলমানদের তুলনায় বেশি লোক ভর্তি করে, তাহলে জিহাদ সকলের উপর ফরযে আইন হয়ে যায়।
চার) মুসলমানদের আমীর জিহাদের আহ্বান করলে, তখনও সকলের উপর জিহাদ ফরযে আইন হয়ে যায় জিহাদ ফরযে আইন হলে তার হুকুম হল, সন্তান মাতা-পিতার অনুমতি ছাড়া, স্ত্রী স্বামীর অনুমতি ছাড়া, গোলাম তার মালিকের অনুমতি ছাড়া, ঋণগ্রস্থ ব্যক্তি পাওনাদারের এজাযত ছাড়াই জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারবে; কারো অনুমতির প্রয়োজন হবে না।"
ছায়েমা আরো বলল, "মহানবী (সঃ) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেনি বা জিহাদের প্রস্তুতি নেয়নি, এমনকি মনে জিহাদের ইচ্ছাও পোষণ করেনি, সে মুনাফিক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে।” (মুসলিম) নাউজুবিল্লাহ।
ছায়েমার মূল্যবান বক্তব্য শ্রবণ করে যুবকদের মাঝে এক নতুন চেতনা জন্ম নিল। নবজাগরণ ফিরে এল। সকলে জিহাদের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল। ছায়েমা আরো একটু এগিয়ে বলল, "হে যুবক বন্ধুরা, তোমরা শোন! যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তারা জীবিত। তারা মৃত্যুবরণ করে না। তাদেরকে এক প্রকার রিযিক দেয়া হয়। শহীদ হওয়ার সাথে সাথে তাদের রূহকে সবুজ পাখির মধ্যে ভরে দিয়ে জান্নাতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেখানে তারা মনের আনন্দে বিচরণ করতে থাকে। তারা জান্নাতের ফলমূল ভক্ষণ করে, পান করে দুধ, মধু, সরবৎ ইত্যাদি বেহেস্তের নির্ঝরিণী থেকে। শহীদদেরকে আল্লাহ জাল্লা শানুহু এমন মর্যাদা দান করবেন যে, একজন শহীদ সত্তরজন থেকে একশ'জন জাহান্নামীক সুপারিশ করে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবেন।" সে আরো বলল, "মুজাহিদ যখন কণ্টকাকীর্ণ ও খুনরাঙা পিচ্ছিল পথে লড়াই করতে থাকে, তখন বেহেস্তের দরজা খুলে হুর-গেলমানরা দলবদ্ধভাবে প্রথম আসমানে এসে হাজির হয়ে শহীদদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যারা শহীদ হবে, তারা বেহেস্তে নাজ নেয়ামত, হুর- গেলমান দেখতে পায়। তখন সমস্ত ভয়-ভীতি দু'পায়ে দলে শত্রুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে যখন শহীদ হয়ে যায়, তখন বেহেশতের হুর-গেলমানরা এস্তেকবাল করে তাকে বেহেশতে নিয়ে যায়।" সোবহানাল্লাহ, কত বড় মর্যাদা।
ছায়েমার ভাষণে শুধু যুবক নয়, বৃদ্ধ এবং মহিলাদের মধ্যেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হল। কখন, কোথায়, কিভাবে জিহাদ করবে, তা জানতে চাইলে ছায়েমা বলল, "বন্ধুরা! তোমরা মানসিক দিক দিয়ে তৈরি থাক আর কষ্টার্জিত উপার্জন থেকে ফান্ড সংগ্রহ কর। তারপর তোমাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। তোমরা শারীরিক, মানসিক, দৈহিক ও আর্থিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখ। সময়ই তোমাদের বলে দেবে কোথায়, কখন, কিভাবে জিহাদ করবে।"
এতক্ষণে দিনমনি তার রীতি অনুযায়ী পশ্চিমের গাছ-গাছালির মাথার উপর দিয়ে রক্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়ে পালানোর পথ খুঁজছে। একটু পরেই গোধুলীতে ছেয়ে যাবে তামাম জাহান। ছায়েমা আজকের মত সবাইকে বিদায় দিয়ে মাগরিবের নামাযের জন্য তৈরী হচ্ছে। আগন্তুক ব্যক্তিবর্গ স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করল।
ছায়েমা সবাইকে বিদায় দিয়ে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে নামায আদায় করল। নামাযান্তে জায়নামাযে বসেই সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগল। পবিত্র কালামের সুমধুর সুর-লহরিতে বাড়ীর লোকজন স্থির থাকতে পারছে না। সাধারণত সন্ধ্যায় সব মানুষের কিছু কাজ থাকে। এ কারণে অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ছায়েমার রুমে আসতে পারেনি। বেলিস্তিনা তার ছাগলপাল খোয়াড়ে উঠাতে লাগল। নাঈমা শামাদান পরিস্কার করে তেল ভরে প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থা করছে। নাঈমা ও বেলিন্তিনা তাড়াহুড়া করে কাজগুলো সেরে নিয়ে প্রদীপ হাতে ছায়েমার ঘরে ঢুকল। দু'জনে দু'টি কেদারা নিয়ে বসে গেল। তারা মনের আনন্দে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত শুনছে। ছায়েমা আধা পারা পড়ে ছাদাকাল্লাহু... বলে শেষ করল।
বেলিন্তিনা ও নাঈমার মনে ছায়েমার প্রতি প্রচণ্ড কৌতূহল। যেমন তার রূপ-সৌন্দর্য, তেমনি না দেখে এত সুন্দর করে কুরআন তেলাওয়াতের সুর-মুর্ছনা। এ মেহমান যদি চিরদিন তাদের ঘরে থাকত! এমন করে যদি প্রতিদিন পবিত্র কালামের সুরলহরী শুনতে পারত!
আরো কত কল্পনার জাল বুনছে ছায়েমাকে নিয়ে। বেলিন্তিনা আর নাঈমার হৃদয়ে এগুলো ছাড়াও আরো অনেক কিছু উঁকিঝুঁকি মারছে। সব কি আর বলা যায়? তিলাওয়াত শেষে ছায়েমা দু'রাকাত নামায আদায় করে এদিকে ঘুরে বসল এবং বলল, "তোমরা একটু দরূদ এস্তেগফার পড়ে নাও।" তারপর দু'হাত উত্তোলন করে মুনাজাত করছে- "আয় আল্লাহ! তুমি সমস্ত প্রশংসার মালিক এবং তুমিই আমাদের একমাত্র রব। তুমিই বান্দার দোয়া কবুল করে থাক। আয় আল্লাহ, তুমি আমাকে তোমার দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য তোমার জমিনে খেলাফত প্রতিষ্ঠার জন্য, নির্যাতিত মুসলমান মা-বোনদের ইজ্জতের হেফাজতের জন্য আমার খুনকে এস্তেমাল করার তাওফীক দান কর। আমাদের হাতের দ্বারা দুশমন খতম করে প্রতিশোধের অনল নিবারণ কর। তোমার পথে লড়াই করতে করতে যেন শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করে তোমার সান্নিধ্যে ফিরে যেতে পারি, তার জন্য সাহায্য কর। আল্লাহুম্মারজুক্সী শাহাদাতান কামিলাতাম ফী সাবীলিক।" বাকিরা আমীন। আমীন! বলে অশ্রু ঝরাচ্ছে। ছায়েমার মুনাজাতে বাড়ীর সকলের চোখেই অশ্রু ঝরছে। মুনাজাতের সময় বাড়ীর সবাই ছায়েমার কক্ষের বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। মুনাজাত শেষে সবাই চলে গেছে নিজ নিজ ঘরে। কক্ষে শুধু বেলিন্তিনা ও নাঈমা।
ছায়েমা তার স্বজাতিদের মাঝে নিজেকে প্রকাশ করবে বলে মনস্থির করল। প্রথমে হেলমেটটা খুলে রেখে দিল সামনের টেবিলে। সাথে সাথে একগুচ্ছ কৃষ্ণকেশ নেমে এল কটিদেশে। বেলিন্তিনা হাস্যোজ্জ্বল বদনে নাঈমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, "নাঈমা! এটা কি স্বপ্ন, নাকি চোখের ধাঁধা? চোখ কি সবসময়ই মিথ্যা দেখে? যেমন নীলিমার দিকে তাকালে মনে হয় ক্রমশই দূরে মাটিতে মিশে গেছে, আসলে তা সত্য নয়। দীর্ঘাকৃতি রেলগাড়ির দিকে তাকালে মনে হয় দূরের বগীগুলো ক্রমশ ছোট হয়ে গেছে। রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে দূরে তাকালে মনে হয় কিছুদূর গিয়ে দু'টো পাত এক হয়ে মিশে গেছে। আসলে তা সত্য নয়।"
মুসাফিরকে দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে। বেলিন্তিনার কথা শুনে ছায়েমা শুভ্র দন্তগুলো প্রকাশ করে হাসছে। ছায়েমার হাসিতে যেন মুক্তা ঝরছে। এবার তিনজন স্বজাতি মন উজাড় করে কথা বলছে। নাঈমা জিজ্ঞেস করল, আপনার নামটা জানা হল না? ছায়েমা উত্তর দিল, আমার নাম ছায়েমা। আহ! কি সুন্দর নাম।
এমন সময় আবদুর রশীদ ডাক দিল, "মুসাফির ভাইয়া! কি করছ?" ছায়েমা তাড়াতাড়ি পূর্বের রূপে ফিরে যেতে যেতে বলল, "আবদুর রশীদ ভাই! এতক্ষণ পর কোথা থেকে এলেন? এতক্ষণ কোথায় ছিলেন?" বলতে বলতে দরজা খুলে দিল।
আবদুর রশীদ গৃহে প্রবেশ করার সাথে সাথে বেলিন্তিনা ও নাঈমা চলে গেল। বাড়ীর বড় ঘরে প্রবেশ করে দু'জন হেসে কুটপাট। গৃহকর্তা ধমক দিয়ে বললেন, 'রাত অনেক হয়েছে। তোমরা একবারও পড়তে বসনি। ছোট খুকির মত হাসছ কেন?" নাঈমা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, "আম্মি! জানো, মুসাফির যুবক নয়, সে একজন যুবতী।"
আম্মি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা জানলে কি করে!" বেলেন্তিনা সব ঘটনা খুলে বলল।এশার নামায এখনো পড়া হয়নি। ছায়েমা ওযু করে নামায পড়তে দাঁড়ায়। নাঈমা বড় ঘরে দস্তরখানা পেতে খাওয়ার আয়োজন করছে। ছায়েমার নামায শেষ হলে বেলেন্তিনা তাকে হাত ধরে বড় ঘরে নিয়ে এল। সবাই খেতে বসেছে। আবদুস সামাদ, আবদুর রশীদ, নাঈমা, বেলেন্তিনা ও ছায়েমা। মনে হচ্ছে সকলেই যেন আপন ভাই-বোন। তাদের মা খানা পরিবেশন করছেন। খানা শেষে ছায়েমা তার কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।
গভীর রাত। ছায়েমার ঘুম আসছে না। কেবলই খোবায়েবের কথা তার হৃদয় সরোবরে শিউলির মত ভেসে বেড়াচ্ছে। কোথায় জানি কোন্ হালতে আছে! আমীর সাহেব ও জাফর ভাই কি নিরাপদ আছেন? না কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন। খোবায়েব ভাইয়া কি নৌকার সন্ধান পেয়েছে, না এখনো পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে? এসব চিন্তা ও প্রশ্ন বারবারই ছায়েমার মনে জাগছে। চোখের পানিতে বালিশ ভিজাচ্ছে। রাত দ্বিপ্রহর। অঘুম নয়নে কত কি ভাবছে ছায়েমা। এসব ভাবনার মাঝে কখন যে ঘুম এসে তাকে অচেতন করে দিয়েছে, ছায়েমা টেরই পায়নি।
[চৌদ্দ]
রাত পোহাল। ভোর হল। ছায়েমা ঘুম থেকে ওঠে ফজরের নামায আদায় করল। তারপর সুমধুর কণ্ঠে তিলাওয়াতে নিমগ্ন হল। এমন সময় বাহির আঙ্গিনায় কে যেন ডাকছে, "আবদুর রশিদ! আবদুর রশিদ! আবদুর রশীদ সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে নামায পড়ছিল। ছালাম ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করে, "এত ভোরে কে ডাকছে?" আগন্তুক উত্তর দিল, "আমি ও-পাড়ার ফারুক।"
"এতো সকালে কেন এসেছ?" জিজ্ঞেস করে আবদুর রশিদ। ফারুক শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় উত্তর দিল, "ভাই, গত রাতে আমাদের পাড়ায় এক বিভীষিকা বয়ে গেছে!" কী বিভীষিকা ফারুক? "বলসেভিকদের অত্যাচার থেকে বাসকাউন্ড অনেক নিরাপদ ছিল। অন্যসব এলাকার মতো এখানে নির্যাতন হত না। কিন্তু এখন সে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। গত রাতে বলসেভিক ফৌজরা আমাদের সতের- আঠারজন যুবককে ধরে নিয়ে গেছে। ওদেরকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা এখনও জানা সম্ভব হয়নি।"
ছায়েমাও ঘরে বসে ফারুকের কথাগুলো শুনতে পায়। সে মনে মনে ভাবছে, বন্দীমুক্তি ও প্রহরী হত্যার জের হিসেবেই সম্ভবত এ আক্রমণ চালান হয়েছে। ছায়েমা ঘর থেকে বের হয়ে ওদের নিকট গিয়ে দাঁড়াল। ফারুক সব ঘটনা খুলে বলল। ছায়েমা কথাগুলো শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে বলল, "বড়ই আফসোস ও পরিতাপের বিষয়, বড়ই দুঃখ ও বেদনার বিষয়! ধিক্কার মুসলিম যুবসমাজের প্রতি, ওরা ক্রিকেট, হকি, ফুটবল, দাবা আর তাস খেলার প্রতিযোগিতা করছে। ঘুম জেগে করছে এগুলোর অনুশীলন। তারা আজ ভুলে গেছে সমরবিদ্যা, ভুলে গেছে তীরান্দাজী, নিশানাবাজী, বর্শা নিক্ষেপ, তলোয়ার ও ঘোড়দৌড়।
সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) সমরবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। জিহাদের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনকে আল্লাহ উম্মতে মুসলিমার উপর ফরয করে দিয়েছেন। জিহাদ ছেড়ে দেয়ার কারণে তাগুত আজ মুসলমাদের উপর
নির্যাতন করতে সাহস পাচ্ছে। আজ কোন নওজোয়ান নেই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে, আক্রমণের জবাব দিতে। যুবকদের অন্তরে প্রতিশোধের আগুন প্রজ্বলিত হচ্ছে না। ওরা যেন স্পন্দনহীন।" ছায়েমা আবদুর রশীদকে বলল, "ভাইজান! আপনি দয়া করে তথ্য নিয়ে আসুন। তারপর দেখব কি করা যায়।"
আবদুর রশীদ এ ব্যাপারে আনাড়ি। বলল, তথ্য সংগ্রহ কিভাবে করব, তা বুঝিয়ে দিলে উপকার হবে। ছায়েমা বলল, "এখান থেকে বাসকাউন্ড সেনা ছাউনী কত দূর, সেখানে যাওয়ার রাস্তা কয়টি, কোন্ রাস্তার দূরত্ব কতটুকু, কয়টি চৌরাস্তা, চলার পথে কয়টি বাজার পড়বে, বাজারে পাহারাদার আছে কিনা, কোন ব্রীজ-কালভার্ট আছে কিনা, নদী বা খাল আছে কিনা, পারাপারের ব্যবস্থা আছে কিনা, ছাউনীতে সৈন্য সংখ্যা কত, পাহারাদারী আছে কতজন, কি কি অস্ত্র আছে তাদের সাথে ইত্যাদি তথ্য গোপনে জেনে আসবেন। তাছাড়া আরো জানা দরকার, লোকবসতি বেশি কোন্দিকে। জানতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, হাসপাতাল ও উপাসনালয়ের অবস্থান। এগুলোর সঠিক নকশা তৈরি করতে হবে। হামলার পূর্বশর্ত হল তথ্য সংগ্রহ।”
আবদুর রশীদ ছায়েমার কথামত ছদ্মবেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য চলে গেল। সন্ধ্যার পূর্বেই আবদুর রশীদ তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসে। জরিপ রিপোর্ট ও নকশা তৈরি করে ছায়েমার হাতে দেয়। ছায়েমা নকশা ও রিপোর্ট নিয়ে কিছুক্ষণ গবেষণা করে।
মাগরিবের সময় হয়ে এসেছে। ছায়েমা নামাযের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ও-পাড়ার ফারুক ও বশীর আবদুর রশীদের বাড়ীতে এসেছে। ছায়েমা নামায সেরে ওদেরকে ডেকে কক্ষে নিয়ে আসে। তারপর যুবকদেরকে লক্ষ্য করে বলল, "আমার যুবক বন্ধুরা! আজ রাতে ক্যাম্পে আক্রমণ করে বন্দীদেরকে ছিনিয়ে আনব ইনশাআল্লাহ। আর বলসেভিকদের সমুচিত শিক্ষা দেয়া হবে।"
ছায়েমার কথা শুনে ফারুকের চোখ দু'টো যেন কপালে উঠে গেল। সে বলল, "মুসাফির ভাই! তুমি এসব কি বলছ! তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে! শতাধিক শত্রুর মোকাবেলায় তিন-চারজন লোক কি করব? তাদের তুলনায় আমরা তো রিক্তহস্ত।"
ফারুকের কাপুরুষোচিত কথা শুনে ছায়েমা তেজোদ্বীপ্ত কণ্ঠে বলল, "মহান আল্লাহ দুর্বল ও অসহায়দের পক্ষে থাকেন। আল্লাহতায়ালার নিয়ম হল, তিনি বড় বড় শক্তিগুলোকে ছোট ছোট শক্তি দ্বারা ধ্বংস করে তার কুদরত ও ক্ষমতার প্রকাশ ঘটান। যেমন, আবরাহার হস্তী বাহিনীকে ছোট ছোট পাখি দ্বারা ধ্বংস করেছেন। আবু জেহেল লানাতুল্লাহ আলাইহি নবীকে কষ্ট দিয়েছে। তাই ছোট দু'নাবালক কিশোর দ্বারা তাকে হত্যা করিয়েছেন। এ সমস্ত ঘটনাবলী দ্বারা আল্লাহ নিজের ক্ষমতা ও কুদরত প্রকাশ করেছেন। আমরা যদিও দুর্বল ও সংখ্যায় কম, তবুও আমরা যদি আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা রেখে শক্তিশালী বাহিনীর উপর আক্রমণ করি, নিশ্চয়ই আল্লাহর মদদ আমাদের পক্ষে থাকবে। দুর্বল-অসহায় মজলুম হিসেবে আমরাই আল্লাহর সাহায্যের হকদার।"
ছায়েমার কথায় সকলের সাহস বৃদ্ধি পেল এবং আক্রমণ করার ইচ্ছে প্রকাশ করল। ছায়েমা চারজনের একটি টিম তৈরি করে কার কি কাজ, কে কোথায় থাকবে, ভালভাবে বুঝিয়ে দিল। ফারুক প্রশ্ন করল, "মুসাফির ভাই! একেবারে খালি হাতে?" ছায়েমা বলল, "আমার নিকট তিনটি মাঝারি ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র আছে, তা ব্যবহার করব। আর একজনের হাতে থাকবে খঞ্জর।"
যুবক বলল, "অস্ত্র চালান তো শিখিনি, কি করে অস্ত্র চালাব?" ছায়েমা বলল, "আমি শিখিয়ে দেব।" তারপর রুদ্ধকক্ষে বসে তিনজনকেই অস্ত্র চালানোর খুঁটিনাটি বিষয়াদি তালিম দিল। অস্ত্র চালনা শিখে যুবকরাও আনন্দ পেল এবং তাদের মধ্যে লড়াইয়ের জযবা বেড়ে গেল। আজ তারা পেয়েছে নতুন জগতের সন্ধান। আজ তারা আঁখি মেলে দেখছে নতুন এক জগত। ডানা মেলে চায় নবদিগন্তে উড়তে। সবাই আনন্দিত, সবাই পুলকিত।
আজ ওরা মুজাহিদ। ওরা আজ আল্লাহর পথের সৈনিক। ওরা আজ লড়াকু। আল্লাহর দুশমনের সাথে লড়বে। বন্দীদেরকে মুক্ত করবে, দুশমনকে পরাভূত করে ইসলামের বিজয় নিশান উড়াবে। শিরায় শিরায় বইছে আনন্দের প্লাবন। পুলকের উর্মিমালায় ভাসছে যুবক দল। ছায়েমা আরো কিছু প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিয়ে এশার নামায আদায় করে নেয়ার জন্য অনুমতি দিল। যুবকরা নামাযের জন্য মসজিদে চলে গেল। ছায়েমা ঘরে নামায আদায় করল।
বেলেন্তিনা ও নাঈমা ছায়েমার রুমে প্রবেশ করে মুচকি হেসে বলল, "আপা! এখনই খানা নিয়ে আসব কি?" ছায়েমা একটু বিরক্ত হয়ে বলল, "আরে, তোমরা দেখছি আমার গোপনীয়তা প্রকাশ করে ফেলবে। এতে তো আমার ক্ষতি হবে। তোমরা কি বুঝ না? তোমরা তো এখনও ছোট নও।" বেলেন্তিনা ও নাঈমা লজ্জায় মাথানত করে ফেলল। ছায়েমা খানার এজাজত দিলে তারা খানা নিয়ে এল। তিনজন এক সাথে বসে খানা খেল যুবকরা মসজিদ থেকে ফিরে এলে ছায়েমা বলল, "ভাইয়েরা! আমি তোমাদেরকে রেখে খানা খেয়ে ফেলেছি। তোমরাও খেয়ে নাও।" যুবকরা হেসে বলল, "সব তো খাননি। আর সব খেয়ে ফেললেও অসুবিধা নেই। আপনাকে দেখলে খানাপিনার চাহিদা মিটে যায়।" ছায়েমার হাসিতে মুক্তা ঝরে। সে মুক্তাঝরা হাসি হেসে বলল, "ওসব কথা রেখে আগে খেয়ে নাও।"
আবদুর রশীদ যুবকদেরকে নিয়ে খানা খাচ্ছে। ছায়েমা বলল, "তোমরা খানা খেয়ে অস্ত্রশস্ত্র গুছিয়ে বিশ্রাম করে নাও। কারণ, আক্রমণের সময় তন্দ্রাভাব হলে অসুবিধার সৃষ্টি করবে।" যুবকরা খানা খেয়ে অস্ত্রগুলো ভাল করে মুছে অয়েলগান মেখে গুলীভর্তি করে শিয়রে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল। ছায়েমাও তার কক্ষের প্রদীপ নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
রাত আনুমানিক বারটা। ছায়েমা ঘুম থেকে জেগে অযু-এস্তেঞ্জা সেরে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করে কামিয়াবীর জন্য দোয়া করল। তারপর আবদুর রশীদ ও যুবকদের জাগিয়ে তুলল। যুবকদেরকে বলল, "তোমরা জলদি অযু করে দু'রাকাত নামায পড়ে নাও। আমাদের এখনই বের হতে হবে।" যুবকরা তাই করল।
ছায়েমা আজ সেনাপতি। রণসাজে সুসজ্জিত হয়ে আগুনঝরা বক্তৃতার মাধ্যমে যুবকদের অন্তরে প্রতিশোধের আগুন জ্বেলে দিল, সাহস জোগাল, শাহাদাতের লোভ দেখাল। দৃঢ়তা, এখলাছ ও সহিষ্ণুতার উপর আলোচনা করল। তারপর দুই যুবকের হাতে তুলে দিল দু'টি ক্লাশিনকভ, আরেকজনকে দিল খঞ্জর। নিজে নিল এসএলআর।
সিপাহসালার ছায়েমা তার ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে এগিয়ে চলল বন্দী মুক্তির উদ্দেশ্যে। আবদুর রশীদ রাহবার হিসেবে আগে আগে চলছে। বাকিরা তার অনুসরণ করছে। তারা বিড়ালের মতো নগ্নপায়ে চলছে। কারো কোন পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে না। সবাই যেন রণকৌশলী। কয়েকটি গ্রাম পেরিয়ে তারা শত্রু এলাকায় এসে পৌঁছল।
রাত আনুমানিক ১টা। সারা দুনিয়া নীরব-নিস্তব্ধ। ছায়েমা সবাইকে একটি বৃক্ষের নীচে বসিয়ে নিজেই ক্যাম্পে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে আসল। উত্তর পাশের ঘরে কান্নাকাটির আওয়াজ শুনতে পেল। মনে হয় এ ঘরেই বন্দীদের রাখা হয়েছে। সে ঘরের দরজায় পাহারারত এক সৈন্যকে অস্ত্র হাতে দেখতে পেল। অপর দু'জন সৈন্য অস্ত্র হাতে পাহারা দিচ্ছে পূর্বদিকে। বাকি সৈন্যরা ঘুমাচ্ছে। ছায়েমা আবদুর রশীদের সাথে দু'জন যুবক দিয়ে বলল, তোমরা টহলরত দু'জনের প্রতি খেয়াল রাখ। আমি বন্দীশালার প্রহরীকে বধ করার সাথে সাথে তোমরা দু'জনকে হত্যা করবে। একজনকে সবগুলো দরজার শিকল লাগিয়ে দিতে বলল। ছায়েমা ক্রলিং করে এগুতে লাগল। বন্দীশালার প্রহরী অর্গলের এক পার্শ্বে দাঁড়িয়ে ঝিমুচ্ছে। ছায়েমা আস্তে করে তার গলায় ফাঁস লাগিয়ে দিল। সে বাঁচার জন্য যতই নড়াচড়া করছে, ততই তার শ্বাসরুদ্ধ হতে লাগল। এক পর্যায়ে তার প্রাণবায়ু বের হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ছায়েমা বন্দীশালার তালার মধ্যে কয়েকটি ফায়ার করে তালাটি ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। তারপর ঘরে প্রবেশ করে বন্দীদের বলল, “হে আমার মুসলিম ভাই ও বোনেরা! তোমরা এখন মুক্ত। জলদি এখান থেকে পালাও। যার যার এলাকায় ফিরে যাও।"
এ ঘোষণার সাথে সাথে বন্দীরা সব ছুটে পালাল।ছায়েমার ফায়ারের শব্দ শুনে টহলরত দুই সৈনিক পালানোর জন্য। পথ খুঁজছিল। আবদুর রশীদ হাঁক ছেড়ে বলল, “খামোশ-নরাধম। এক্ষুণি আত্মসমর্পণ কর। নইলে রক্ষা নেই।"
আবদুর রশীদের আওয়াজে দু'জনই অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেল। আবদুর রশীদ অস্ত্র দু'টি তুলে নিল এবং ফারুক ও বশীর জুতোর ফিতা দিয়ে উভয়ের হাত শক্ত করে বেঁধে ফেলল। পুর্বদিকের ঘরে সত্তর-আশিজন সৈন্য ফায়ারের আওয়াজ শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলল। কেউ ঘর থেকে বেরুতে পারছে না। সৈন্য শিবির কাদের দখলে, তাও টের পায়নি। তাদের ক্রন্দনরোলে মনে হচ্ছিল কেয়ামত শুরু হয়েছে। ছায়েমা বন্দী পাহারাদেরকে জিজ্ঞেস করল, "তোমাদের ওয়ারলেস সেট কোথায়?"
সৈন্য উত্তর দেয়, "মেজর সাহেবের নিকট। বেটারী চার্জ না থাকায় বর্তমানে সেটা অকেজো হয়ে আছে। শহর থেকে চার্জ দিয়ে আনতে হবে।" ছায়েমা বন্দীকে বলল, "তোমার পরিচয় দিয়ে দরজা খুলতে বল।” সৈন্য তাই করল। কিন্তু ওরা দরজা খুলল না। ঘরটি ছিল মজুবত দেয়ালবেষ্টিত। এসব অস্ত্র দ্বারা দেয়ালের কিছু করা সম্ভব নয় বিধায় ছায়েমা জানালা দিয়ে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে কয়েকটি ফায়ার করল। হতাহতের কোন খবর এ মুহূর্তে জানা গেল না।
ছায়েমা বন্দীদেরকে হত্যা করার ব্যবস্থা নিলে বন্দীরা করজোড় আবেদন করল যে, "আমরা মুসলমান। আমাদেরকে জোর করে সেনাবাহিনীতে আনা হয়েছে। অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি।”
ছায়েমা তাদের প্রতি সদয় হয়ে, তাদের কথায় বিশ্বাস করে হাতের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল, "তোমরা জলদি পালাও। পারলে মুজাহিদদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।” এই বলে তাদেরকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় দিল। তারা হাসিমুখে সালাম জানিয়ে বিদায় নিল।
রাতের শেষ প্রহর। কিছুক্ষণ পরই লোকজনের চলাচল শুরু হবে। ছায়েমা তাদের দলবল নিয়ে দ্রুতপদে আবদুর রশীদের বাড়ীর দিকে রওনা দেয়। ফজরের সময় তারা বাড়ী এসে পৌঁছে। ছায়েমার শরীর খুবই ক্লান্ত। সে বেলেন্তিনাকে গনীমতের অস্ত্র-শস্ত্র হেফাজত করতে দিয়ে নামায পড়ে শুয়ে পড়ল। আবদুর রশীদ, বশীর ও ফারুক নামায পড়ে যার যার মতো ঘুমিয়ে পড়ল। ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন রাতেই ফায়ারের শব্দ পেয়েছে। তারা মনে করেছে, বন্দীদেরকে হয়ত গুলী করে শহীদ করা হয়েছে। তাই রাতে কেউ খোঁজ নিতে আসেনি। লোকজন সকালবেলা ক্যাম্পে এসে সেখানকার দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায়। দেখতে পায়, উত্তরের ঘরের বারান্দার পাশে গলায় রশি লাগান বিবস্ত্র এক সৈনিকের লাশ। পূর্বপাশের ঘরে পাঁচ-সাতটি লাশ রক্তের বন্যায় ভাসছে, আর বেশ ক'জন সৈন্য আহত অবস্থায় মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। সারা ক্যাম্প জুড়ে আর কোন বলসেভিক সৈন্য নেই। সবাই পলায়ন করেছে।
ছায়েমা গৃহাভ্যন্তরে এপাশ-ওপাশ করছে। তার চোখে ঘুম নেই। কেবল ভাবছে খোবায়েবের কথা। খোবায়েব কোথায় কি অবস্থায় আছে ভেবে অস্থির। আজ দু-তিনদিন অতীত হতে চলেছে এখনও হতভাগা ফিরে আসেনি। সে কি বন্দী হয়ে গেছে নাকি শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করে জান্নাতে চলে গেছে কে জানে। খোবায়েবকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকা কত যে কষ্টকর, তা কে বুঝবে। খোবায়েবকে ঘিরে ছায়েমা কতই না কল্পনার জাল বুনছে। কতই না স্বপ্ন লালন করছে।
খোবায়েবকে নিয়ে জিহাদের মাধ্যমে বলসেভিক ও কমিউনিজমের পতন ঘটাবে, জাতির মুক্তি ছিনিয়ে আনবে, ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করবে, মা-বোনের ইজ্জত রক্ষা করবে, মুসলমানদের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে, মসজিদ-মাদ্রাসার তালাগুলো খুলে দেবে, আবার তালিম-তরবিয়ত চালু করবে, আরো সহস্র স্বপ্নের জাল বিস্তার করে আছে ছায়েমার কিশোরী হৃদয়ে। খোবায়েব যদি বন্দী বা শহীদ হয়ে যায়, তবে কাকে নিয়ে সে তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করবে, সফলতার পথে, কামিয়াবীর পথে এগিয়ে যাবে? ছায়েমার অন্তরে এসব নানা প্রশ্ন উদয় হতে লাগল এবং চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে বালিশ সিক্ত হচ্ছিল। ওদিকে আমীর সাহেব ও ও জাফর ভাইয়ের চিন্তাও ব্যাকুল করে তুলেছে তাকে। অনেক চেষ্টা করেও দেখে ঘুমাতে পারছেনা। আপামণি! ও আপামণি। ডাকতে ডাকতে নাঈমা কক্ষে প্রবেশ করে। ছায়েমা বিরক্ত হয়ে চেহারা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিল। ইতিমধ্যে বেলেন্তিনাও এসে হাজির। ছায়েমার হাবভাব দেখে বেলেন্তিনা বুঝে ফেলে, 'আপা' বলে ডাকার কারণে সেদিনও ছায়েমা আপা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। তাই বলে উঠল, "সরি, ক্ষমা কর মুসাফির। ভুল হয়ে গেছে। তোমার বোনদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর নজরে তাকাও।"
বারবার অনুনয়-বিনয়ে ছায়েমা রুমালে চোখ মুছে এদিক ঘুরল। বেলেন্তিনা পাশে বসে আস্তে আস্তে বলতে লাগল, "মুসাফির ভাই! বুঝতে পেরেছি, থাকা-খাওয়ার কষ্ট হচ্ছে বলে কাঁদছেন। ভাইয়া, আমাদের অপরাধগুলো ক্ষমা করবেন। এটা আপনার বাড়ি আমরা আপনার ছোট বোন, কখন কি ভুল করে বসি। তাছাড়া আপনার যখন যা দরকার হয় আমাদের বলবেন। আমরা তা পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করব।"
ছায়েমা বেলেন্তিনার কথায় উত্তর দিতে গিয়ে বলল, "বোন! তোমরা কি আমাকে সুখ দিতে পারবে? মনের জ্বালা নিবারণ করতে পারবে? আল্লাহ যদি এ অবলা দাসী থেকে ঈমানী পরীক্ষা নিতে চান, তবে কে আছে আমাকে রক্ষা করবে? দুনিয়ার জীবনে সান্ত্বনা পাওয়ার মতো আমার কোন আশ্রয়স্থল নেই। আমি মা-বাবার স্নেহ-মমতা থেকে বঞ্চিত। ভাই-বোন নেই। সবাই আমাকে শোক সাগরে ভাসিয়ে জান্নাতে চলে গেছেন। সবাই শাহাদাতবরণ করেছেন। আমি হতভাগী, অনাথিনী এখনও বেঁচে আছি। দুনিয়ার জীবনে সান্ত্বনা পাওয়ার মত একটি মাত্রই স্থান বাকি আছে। তাও তো আজ দু-তিনদিন আমাকে এখানে ফেলে রেখে পলায়ন করেছে।"
ছায়েমার কথা শুনে বেলেন্তিনা ও নাঈমার স্বপ্ন ভেঙ্গেছে। ওরা বুঝতে পারে কার জন্য এত পেরেশানী, কার জন্য তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে সারাক্ষণ। এ যে সেই বীর পুরুষ, বর্তমান জামানার খালিদ বিন ওলিদ, তারিক বিন যিয়াদ, মোহাম্মদ বিন কাসিম, আবদুল্লাহ বিন রাওহা খোবাযে? জামবুলী।
ছায়েমার কথাগুলো শুনে বেলেন্তিনা ও নাঈমা চোখের পানি সামলিয়ে রাখতে পারেনি। তাদের চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে যায়। একটু পরে উভয়ে উড়নীর সাহায্যে অশ্রু মুছে ছায়েমাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। বেলেন্তিনা বলল, "আপনি শান্ত হোন, আগামীকাল প্রত্যুষে যে করেই হোক আবদুর রশীদ ভাইয়াকে আলমাআতা পাঠাব। সে নিশ্চয়ই খোবায়েবের সন্ধান না নিয়ে ফিরবে না। তার পথঘাট সব জানা। আপনি এত বিচলিত হবেন না। আপনিই তো আমাদের ধৈর্য ধারণের তালিম দিয়েছিলেন, আর এখন দেখি নিজের মধ্যেই আমল নেই।" ছায়েমা খানিকটা সান্ত্বনা পেল।
হঠাৎ বাড়ীর আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ আবদুর রশীদকে ডাকছে। নাঈমা দৌড়ে গিয়ে বৃদ্ধকে বলল, ভাইয়া এখন ঘুমাচ্ছেন, তাকে ডাকা যাবে না। দয়া করে একটু পরে আসুন। কোন সংবাদ থাকলে আমাকে বলতে পারেন। ভাইয়া ঘুম থেকে উঠলে তাকে আপনার খবর জানাব।" বৃদ্ধ নাঈমাকে লক্ষ্য করে বললেন, গত রাতে সেনা ছাউনীতে এক
প্রলয় সংঘটিত হয়েছে। অনেক সৈন্য নিহত হয়েছে। পনের-বিশজন আহতও হয়েছে তিনজন প্রহরীর মধ্যে একজন নিহত আর দু'জন পলায়ন করেছে। এর দায়দায়িত্ব কেউ স্বীকার করেনি। সেনা অফিসারগণ দু'জন প্রহরীকে দোষী সাব্যস্ত করেছে। ওদেরকে বের করতে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়িত্ব দিয়েছে। ঐ এলাকা খুবই উত্তপ্ত, কখন কি ঘটে যায় তা আল্লাহ জানেন। সেনা অফিসারগণ ধারণা করছে, দু'জন প্রহরী যেহেতু মুসলমান ছিল, ঐ প্রহরীর সাথে কোন মুসলিম জঙ্গী গ্রুপের সাথে গোপন আঁতাত আছে। আর এদের দ্বারাই চরম ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হয়েছে।
বৃদ্ধ আরো বললেন, সকাল আটটার মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়লে কয়েকশ' বলসেভিক ফৌজ উক্ত ক্যাম্পের দিকে ছুটে আসে। সাথে নিয়ে আসে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, রসদ সামগ্রী, ডাক্তার টিম, এম্বুলেন্স, সাজোয়া যান। ওরা গ্রামগুলো ক্র্যাকডাউন লাগিয়ে তল্লাশি দিতে পারে। পরপর দু'টি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিধায় তারা খুবই উদ্বিগ্ন। বৃদ্ধ লোকটি কথাগুলো বলে চলে গেল। ছায়েমাও কক্ষে বসে কথাগুলো শুনছিল। এদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে ভাবছে সে। হামলার পথ খুঁজছে ছায়েমা।
পর্ব-৬ এখানে........
0 Comments