▶️ আহমদ মুসা। অপারেশন তেল আবিব পর্ব-১

 


ডাইরীর সাদা বুক। 

খস্ খস্ শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে একটি কলমঃ '... সিং কিয়াং-এর ধুসর মরুভূমি। দূরে উত্তর দিগন্তের তিয়েনশান পর্বতমালা কালো রেখার মত দাঁড়িয়ে আছে। অর্থহীনভাবে শুধু চেয়ে থাকি চারিদিকে। কোন কাজ নেই। জীবনের গতি যেন আমাদের স্তব্ধ হয়ে গেছে। আজ ক'দিন হল যুগ-যুগান্তরের ভিটে মাটি ছেড়ে আমরা ৫ হাজার মুসলমান আশ্রয় নিয়েছি আমাদের জাতীয় ভাইদের কাছে এ সুদূর মরুদ্যানে। অত্যাচারীর চকচকে রক্ত পিপাসু বেয়নেট আর রাইফেলের গলিত সীসা ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের বহু ভাই বহু বোনকে। চোখে আর কারো পানি নেই। শুকিয়ে গেছে অশ্রুর ধারা।

মরু-ঘেরা এ দূর্গম মরুদ্যানে এসে আমাদের যারা একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল, ভুল ভেঙ্গে গেল তাদের অচিরেই। একদিন সকালে উঠে শুনলাম এদেশের সে ফেরাউন বাহিনীও এগিয়ে আসছে এদিকে। আব্ব চিৎকার করে বললেন, 'আমরা বাঘের মুখ থেকে খসে কশাই এর হাতে পড়েছি। আমাদের মাতৃভূমি তুর্কিস্তানের একখন্ড ভূমিতেও আজ আমাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিবে না শয়তানরা। বুঝলাম আব্বার সহ্য নিঃশেষ হতে চলেছে।

আব্বার আয়োজন শুরু হ'ল যাত্রার। নারী আর শিশুদের চোখের পানিতে ভারি হয়ে উঠল মরুভূমির শুষ্ক বাতাস। এবার শুধু আমরাই নই, মরুদ্যান ও আশে পাশের আরো ৪৫ হাজার মুসলিম নর নারীর উদ্বাস্তু মিছিল এসে শামিল হল আমাদের সাথে।

আমার চার বছরের ভাই ইউসুফ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'আমরা আবার কোথায় যাব ভাইজান! বাড়ী গেলে সেই মানুষরা যে আবার মারবে আমাদের? আমি অভয় দিয়ে বললাম, 'না ভাই আমরা বাড়ী যাচ্ছি না।'

কিন্তু কোথায় যাচ্ছি বলতে পারলাম না। কোথায় যাব আমরা? তাজিকিস্তান কিংবা উজবেকিস্তান। সেতো আর এক সিংকিয়াং। অবশেষে সবাই বুক ভরা আশা নিয়ে তাকালো দক্ষিণের দিকে। উচ্চারিত হলো ভারতের নাম- মুহাম্মদ বিন কাসিমের এ ভারত, মাহমুদ, বাবর, ঈসা খাঁ, টিপু, তিতুমীরের এ ভারত।

মরুভূমির সাদা বালুর উপর দিয়ে এগিয়ে চলল ছিন্নমূল মানুষের আদিগন্ত মিছিল। পিছনে পড়ে রইল সহস্র শতাব্দির স্মৃতি বিজড়িত মাতৃভূমি সিংকিয়াং। কেন এমন হ'ল? কি করেছি আমরা? শুধু তো স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছি। মানুষের এ চাওয়া তো চিরন্তন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে কি এ অধিকার আমাদের থাকবে না?

কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ধীরে ধীরে তিব্বতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। হঠাৎ একদিন কয়েকটি সামরিক বিমান খুব নীচু দিয়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গোটা কাফেলায়। তাহলে কি ওরা এখনো পিছু ছাড়েনি আমাদের?

মরুভূমির নিঝুম-নিস্তব্ধ রাত। বাতাসের একটানা শোঁ শোঁ নিঃশ্বাস নিস্তব্ধতার মাঝে তরঙ্গ তুলছে শুধু। উপরে লক্ষ কোটি তারার মেলা। কাফেলার পরিশ্রান্ত পথিকরা কেউ জেগে নেই বোধ হয়। হঠাৎ উত্তর দিগন্ত থেকে ভেসে এল কয়েকটি জেট ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর শব্দ। তারপর বুম! বুম! বুম......

চিৎকার ছুটোছুটি আর্তনাদে গভীর রাত্রির নিশুতি প্রহর ভেঙ্গে পড়ল টুকরো টুকরো হয়ে। ঘুম ভেঙে গেল আমার। বিছানায় উঠে বসেছি। বোবা হয়ে

গেছি যেন। আব্বার চিৎকার ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না আমার। কি বিভৎস সে দৃশ্য! আব্বার তাবু জ্বলছে। টলতে টলতে আব্বা ইউসুফকে টেনে নিয়ে আসছেন। ইউসুফের কোমর থেকে পিছন দিকটা নেই, কয়লার মত হয়ে গেছে ওর শরীর। একটি অস্ফুট চিৎকারই শুধু আমার মুখ থেকে বেরুল...।

যখন জ্ঞান ফিরল, বেলা হয়ে গেছে তখন অনেক। আব্বার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি আমায় ডাকছেন। আমি কাছে যেতেই তিনি বললেন 'মুসা, কাফেলা নিয়ে যত সত্ত্বর পার এখান থেকে সামনে এগিয়ে যাও। মনে.....?

আমি বাধা দিয়ে বললাম, এ সব কি বলছেন আব্বা? আপনি ভাল হয়ে যাবেন। আব্বা ম্লান হাসলেন। বললেন, তাঁর ডাক এলে কেউ সে ডাকে সাড়া না দিয়ে কি পারে মুসা?

একটু থেমে তিনি বললেন, মুসা, ইউসুফ নাই; দুঃখ করো না। পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত শিশুর মাঝে তোমার ইউসুফকে খুঁজে পাবে। তোমার মা, বাবা নেই বলে কখনো ভেবনা, পৃথিবীর নির্যাতিত মানষের মধ্যে তোমার মা-বাবাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করো।' অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ল আব্বার কণ্ঠ। আব্বার মুখ থেকে অস্ফুটে তাঁর কথা বেরিয়ে এল, মনে রেখ মুসা; শুধু সিংকিয়াং এর মুসলমানদের একার এ দূর্দশা নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি তোমার ভাই-বোন এমনিভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। আরও মনে রেখ, তোমার এ মজলুম মুসলিম ভাই বোনদের অশ্রু মোছানোর দায়িত্ব, তাদের অবস্থার পারিবর্তন আনার দায়িত্ব তোমাদের মত তরুণদের। তোমরা স্রষ্টার নির্দেশগুলোর আর তোমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে সর্বদা সামনে রেখো। খালেদ, তারিক, মুসা, মুহাম্মদ বিন কাসিমের তলোয়ার যেদিন তোমরা আবার হাতে তুলে নিতে পারবে, দেখবে সেদিন আল্লাহর সাহায্য কত দ্রুত নেমে আসে তোমাদের উপর।

আব্বা তাঁর নিঃসাড় দুর্বল হাত দিয়ে আমার অশ্রু মোছানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, মুসা, অশ্রু তো মুসলমানদের জন্য নয়। তোমরা সেই জাতি যারা হাত কেটে গেলে পা দিয়ে পতাকা ধরে রাখে। পা কেটে গেলে দাঁত দিয়ে পতাকা ধরে রাখে। আমি অশ্রু মুছে বললাম, আব্বা আমি আর কাঁদব না। দোয়া করুন- ঘরের কোণে বসে কাপুরুষের মত যেন না মরি।

চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, গতকাল যারা দুনিয়ার আলো বাতাসে বিচরণ করেছে, তাদেরই হাজার হাজার বিকৃত লাশে মরুভূমির বুক কালো হয়ে উঠেছে। শত শত পোড়া তাঁবুর খন্ড খন্ড অংশ ছিটিয়ে, ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত শত এতিম শিশুর সব হারানোর কান্না চারিদিকে মাতম তুলেছে। আবার যখন আব্বার দিকে চাইলাম, চোখ দু'টি তাঁর বুজে গেছে। চোখ দু'টি আর কোনদিন চাইবে না পৃথিবীর দিকে। একটি অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস যেন ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চাইল আমার সমগ্র হৃদয়কে। চারিদিক থেকে অন্ধকার এসে সংকীর্ণ করে দিতে চাইল আমার পৃথিবীকে। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হতে চেষ্টা করলাম আমি।

কাঁধের উপর একটি কোমল স্পর্শে চমকে উঠলাম। ফিরে দেখলাম 'ফারজানা'। শুভ্র গন্ড দু'টি চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে তার। অশ্রু-ধোয়া কালো চোখ দু'টিতে কি নিঃসীম মায়া। এমন নিবিড়ভাবে ফারজানাকে কোনদিন আমি দেখিনি। ফারজানা সিংকিয়াং এর প্রধান বিচারপতি আমির হাসানের কন্যা। আমি বললাম, ফারজানা কোন দুঃসংবাদ নেই তো? সে বলল, আমরা ভাল আছি। আব্বা আপানাকে আমাদের তাঁবুতে ডেকেছেন।

মরু সূর্য তখন আগুন বৃষ্টি করছে। আমি জানতাম, ফারজানাদের ছোট্ট একটি তাঁবু। আমি বললাম, চারিদিকে চেয়ে দেখো ফারজানা, তাঁবুর ছায়া আমরা কতজনকে দিতে পারব। যা হোক এদিকের একটা ব্যবস্থা করা যাবেই। তুমি যাও ফারজানা। আমি চাচাজানের সাথে পরে দেখা করব।

আমরা আমাদের দশ হাজার ভাই বোনকে মরু বালুর অনন্ত শয্যায় ঘুমিয়ে রেখে এগিয়ে চললাম সামনে। একদিন গোধুলী মুহুর্তে আমরা পৌঁছুলাম তিব্বত সীমান্তে। দেখলাম তিব্বত সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। জানলাম সিংকিয়াং এর মাটি যাদেরকে আশ্রয় দিতে পারেনি তিব্বতের মাটিতেও তাদের পা রাখবার কোন জায়গা নেই। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ছিন্নমূল বনি আদমের কোন আবেদন নিবেদন কোন কাজে এল না। আশা ভঙ্গের চরম হতাশায় মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল কাফেলা ঘিরে।

এবার কোথায় যাব আমরা? উত্তরে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে, দক্ষিণে তিব্বত সীমান্তের দুর্ভেদ্য দেয়াল। আশার একটি ক্ষীণ আলোক বর্তিকা তখন জ্বলছে-কাশ্মীর হয়ে আফগানিস্তান। পথ অত্যন্ত দুর্গম। কিন্তু উপায় নেই তবু।

হিমালয়ের ১৮ হাজার ফিট উঁচু বরফ মোড়া মৃত্যু-শীতল পথ ধরে আফগানিস্তানের দিকে যাত্রা শুরু হল আমাদের। দিন, মাস গড়িয়ে চলল। পার্বত্য পথের কষ্টকর আরোহণ অবরোহণ নিঃশেষ করে দিল মানুষের প্রত্যয়ের শেষ সঞ্চয়টুকু। তার উপর দুঃসহ শীত। প্রতিদিনই শত শত পরিশ্রান্ত মানুষের উপর নেমে আসতে লাগলো মৃত্যুর হিমশীতল পরশ। দুর্বল বৃদ্ধ, কোমল দেহ নারী, অসহায় শিশুরাই প্রধান শিকারে পরিণত হল এর। সবার মত ফারজানার বৃদ্ধ পিতাকেও একদিন হিমালয়ের এক অজ্ঞাত গুহায় সমাহিত করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। ফারজানার অবস্থাও হয়ে উঠেছে মর্মান্তিক। তার আব্বার মৃত্যুর পর সে পাষাণের মত মৌন হয়ে গেছে। বোবা দৃষ্টির শূন্য চাহনির মাঝে কোন ভাবান্তরই খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর একটি হাত ধরে আমি পাশাপাশি চলছিলাম। কয়েকদিন পর হাত ধরে নিয়ে চলাও অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগল। ভীষণ জ্বর উঠল ফারজানার। পা দু'টি আর উঠতে চায় না ওর।

সেদিন গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয় সবাই। জ্বরের তীব্র ব্যাথায় ফারজানা কাতরাচ্ছে; একটু দূরে বসে অসহায়ভাবে সে দৃশ্য দেখছি আমি। হিমালয়ের নিঃসীম মৌনতার মাঝে ফারজানার অস্ফুট কাতরানি তীব্র আর্ত বিলাপের মত আমরা সমগ্র হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওর মাথার পাশে বসলাম। ধীরে ধীরে হাত বুলালাম ওর আগুনের মত ললাটে। ওর দুর্বল দু'টি হাত উঠে এল। তুলে নিল আমার হাত ওর দু'হাতের মুঠোয়। তারপর হাত মুখে চেপে ধরে বাঁধ ভাঙা নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল ফারজানা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, কেঁদোনা ফারজানা, কষ্ট এতে আরও বাড়বে।

ফারজানা বলল, আমাকে ভুলাতে চেষ্টা করো না। আমি জানি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তারপর একটু থেমে ধীরে ধীরে বলল, মুসা ভাই, সজ্ঞানে কখনও কোন পাপ করেছি বলে মনে পড়ে না। তুমি কি আমাকে আশ্বাস দিতে পার-অমর জীবনের সেই জগতে আবার আমি তোমাকে খুঁজে পাব। আব্বার কাছে বলেছিলাম, কাঁদব না। কিন্তু চোখের পাতা দু'টি সহসা ভারি হয়ে উঠল। আমি বললাম, একথা শুধু তিনিই জানেন ফারজানা। তবে বলতে পারি আমি- তিনি তাঁর বান্দার কোন একান্ত কামনাকেই অপূর্ণ রাখেন না।

ফরজানা যেন গভীর পরিতৃপ্তির সাথে চোখ বুজল। অস্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আল্লাহই তো আমাকে সবচেয়ে ভালো জানেন। চোখ দু'টি আর খুললো না ফারজানা। কোনদিনই তা আর খোলার নয়। হিমালয়ের বুক চিরে দীর্ঘ পথ চলার পর আমরা যখন আফগান সীমান্তে পৌঁছলাম, ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে আমরা তখন বেঁচেআছি মাত্র ৮৫০ খস্ খস্ শব্দ বন্ধ হল। হঠাৎ থেমে গেল কলমটি!

টেবিলের একপাশে রাখা একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রে হঠাৎ লালবাতি জ্বলে উঠল। আর সেই সাথে অয়‍্যারলেস গ্রাহকযন্ত্র থেকে 'ব্লিৎস ব্লিৎস' শব্দ ভেসে এল। আহমদ মুসা লেখা থামিয়ে ডাইরীটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। প্রায় সাড়ে ছ'ফুট লম্বা লোকটি। মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী তুর্কি স্বাস্থ্য দেহে। সকল প্রকারের কষ্ট এবং যে কোন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলার যোগ্যতা দিয়ে যেন আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন একে। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখ দু'টি উজ্জ্বল এবং দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। শান্ত দর্শন মুখাবয়বে অনমনীয় ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট ছাপ। এ লোকটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশী আলোচিত এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাথা ব্যথা। সাইমুমের মধ্যমনি। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং উত্তর ককেশিয়া থেকে তানজানিয়া পর্যন্ত সুবিস্তৃত মুসলিম সমাজের প্রতিটি মজলুম মানুষ তার নাম গর্বের সাথে স্মরণ করে এবং স্বাধীন দেশ আর স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখে। আহমদ মুসা উঠে গিয়ে অয়্যারলেসের কাছে বসল। বলল, আহমদ মুসা স্পিকিং। ওপার থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল, 'আমি ফারুক আমিন বলছি।'

-কি খবর বল।

-বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিস একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের দিয়েছে। আমি এক্ষুণি আসতে চাই।

- এস। ৪০১১ অপারেশনের খবর?

পনর মিনিট হল ফিরেছে। জেরুজালেমে ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি তৈরীর সাধ ওদের অনেক দিনের জন্য মিটে গেছে। মাউন্ট গুলিভিয়রের ক্ষেপণাস্ত্র বেদিটি ধূলা হয়ে গেছে প্রচন্ড ডিনামাইটের বিস্ফোরণে। আর ইহুদী ক্ষেপণাস্ত্র বিশারদ মাইকেল শার্পের দেহটিও উড়ে গেছে তার সাথে।

মুহূর্তের জন্য আহমদ মুসার চোখ দু'টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, বিজয়ী ভাইদের আমার সালাম দাও ফারুক। আর শোন-কোন প্রকার আত্মতৃপ্তির অবকাশ আমাদের নেই। লক্ষ্য আমাদের বহুদূর পথ অত্যন্ত দূর্গম। এ পর্যন্ত যা আমরা করেছি তার চেয়ে ভবিষ্যতে যা আমাদের করতে হবে তা হাজারো গুণ বেশী। আচ্ছা, তুমি এস।

এবার অয়‍্যারলেসটির কাঁটা ঘুরিয়ে আর একটি চ্যানেল তৈরী করল। নতুন ঠিকানায় কয়েকবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করল। সফল হলো না। উঠে দাঁড়ালো আহমদ মুসা। ভ্রুদু'টি তার কুঞ্চিত হয়ে উঠল। টেলিফোনটি তুলে নিয়ে একটি পরিচিত নাম্বারে ডায়াল করে বলল, শফিক তুমি একটু উপরে এস।

আহমদ মুসা খস্ খস্ করে একটি কাগজে লিখলঃ

"হাসান তারিকের অয়‍্যারলেস অস্বাভাবিকভাবে নীরব। সে কোথায় খোঁজ নাও। এখন নয়, আগামিকাল ভোর পাঁচটায় আমাকে হেডকোয়ার্টারে পাবে।"

একটু পরেই নীল বাতি জ্বলে উঠল ঘরে। পর্দা ঠেলে প্রবেশ করল শফিক। সামনের চেয়ারটায় বসতে ইংগিত করল আহমদ মুসা। তারপর চিঠিটি ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পররাষ্ট্র দফতরের ঠিক বিপরীতে রাস্তার উত্তর পার্শ্বে ৩২২ নং বাড়ী। বাড়ীটিতে ঢুকে সোজা তিন তলায় উঠে যাবে। তাঁর এ চিঠি। সাবধানে যেয়ো।

আম্মানের অভিজাত এলাকার একটি দ্বিতল বাড়ী। চারপাশে কোন বাড়ী নেই। আট ফুট উঁচু দেয়ালে ঘেরা বাড়ীটি। বাড়ীর বাইরের সব আলো নিভানো হলেও রাস্তার সরকারী আলোতে বাড়ীর উত্তর দিকের সম্মুখ ভাগটা উজ্জ্বল। রূপালী রং করা লোহার গেটে আলো পড়ে চিক চিক করছে।

আহমদ মুসার চিঠি নিয়ে গেট দিয়ে ধীর পদে বেরিয়ে এল শফিক। গাড়ী ষ্টার্ট নিতেই শফিক চকিতে একবার পিছনে ফিরে দেখল, কালো রংএর একটি ল্যান্ড রোভার পাশের অন্ধাকারের বুক থেকে বেরিয়ে এল তাদের পিছনে। সন্দেহ সম্পর্কে নিশ্চত হবার জন্য শফিক ড্রাইভারকে ফুলস্পীডে গাড়ী ছাড়তে বলল, ড্রাইভার আপত্তি জানিয়ে বলল, এ আঁকা বাঁকা রাস্তায় এর চেয়ে বেশী স্পীড দেওয়া সহজ নয় সাহেব।

শফিক ড্রাইভারের চোখের সামনে সাংকেতিক চিহ্ন তুলে ধরে বলল, এর প্রয়োজন আছে ড্রাইভার। ড্রাইভার সাইমুমের সাংকেতিক চিহ্ন দেখে মাথা ঝাঁকিয়ে একটি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে বলল, এ গাড়ীকে এবং আমাকে এখন থেকে নিজের মনে করুন জনাব।' শফিক রিয়ারভিউয়ে চোখ রেখে বলল, তোমার মত কি এমনি করে সবাই ভাবে ড্রাইভার?

-সবাই আরও সুন্দর করে ভাবে। আমার মত হতভাগ্য আর কেউ নেই।

একমাত্র পেট পূজা ছাড়া জাতির এই সংকট মুহূর্তে আমার দ্বারা কিছুই হল না। শফিক ড্রাইভারের পিঠে একটি হাত রেখে বলল, কে বলল কিছু করছ না ভাই? তোমাদের সমর্থন আর ভালোবাসাই তো আমাদের শক্তি ও প্রেরণা যোগাচ্ছে। শফিক রিয়ারভিউ থেকে চোখ সরিয়ে বলল, পিছনের গাড়ীটি আমাদের অনুসরণ করছে ড্রাইভার।

ড্রাইভার একবার চিন্তিত মুখে 'রিয়ারভিউ' এর দিতে তাকিয়ে বলল, শহরের প্রতিটি গলি কুজো পথ আমার নখদপর্ণে, যদি বলেন তো ৫ মিনিটে ওদের এড়িয়ে বেরিয়ে যাব, আমরা। - না তা হয় না ড্রাইভার। শত্রুকে পিঠ দেখানো আমাদের ঐতিহ্যের বিপরীত। সাইমুমের কোন সদস্যই শত্রুকে জীবিত রেখে সামনে এগোয় না। তুমি সামনের গাছটার কাছে মোড় ঘুরবার সময় গাড়ির গতি একটু কমিয়ে দিবে। আমি নেমে গেলে তুমি গাড়ী চালিয়ে যাবে। সুলতান সারাহ উদ্দিন রোডের মুখে আমার জন্য অপেক্ষা করো।

গাছটির কাছে একটু অন্ধকার মত জায়গায় খোলা দরজা দিয়ে চলন্ত গাড়ী থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল শফিক। পিছনে তাকিয়ে আশ্বস্ত হল সে। পিছনের গাড়ীর হেড লাইট এখনো অনেক পিছনে। নিশ্চিন্ত মনে পকেট থেকে একটা হ্যান্ড গ্রেনেড বের করে সেফটিপিন ঠিক করে রাখল। অন্য হাতে রিভলভার।

সামনের গাড়ী লক্ষ্য করে পিছনের গাড়ীটি নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাচ্ছে। গাছের নীচে একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে শফিক। গাড়ী গাছের সমান্তরালে আসতেই সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার থেকে ধীরে সুস্থে প্রথম গুলিটি ছুঁড়লো সে। দুপ করে মৃদু শব্দ উঠল। প্রচন্ড শব্দে পিছনের একটি টায়ার বার্ট করল। কিছুদূর যেয়ে থেমে গেল গাড়ীটি। শফিকের ধারণা সত্য হ'ল। সাধারণ টায়ার বার্ট মনে করে গাড়ীর দু'ধারের দরজা খুলে দু'জন বেরিয়ে এল। একজন বেঁটে ধরণের। নাক চেপ্টা, মুখ গোল, রং হলুদ একবার চাইলেই বোঝা যায় চীনা লোক। আর একজন লম্বা। রং সাদা। দু'জনের পরনে কালো প্যান্ট, কালো কোট। ওরা টায়ার পরীক্ষা করেই চমকে উঠল। মুহুর্তে হাত পকেটে চলে গেল ওদের। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। শফিকের রিভলভার দু'বার মৃদু শব্দ করে উঠল। ঢলে পড়ল দু'টি দেহ।

শফিক দ্রুত চলে গেল ওদের কাছে। পকেটে রিভলভার, সিগারেট কেস, লাইটার, হাত বোমা ছাড়া অন্য কোন কাগজ পত্র পেলনা। গাড়ীতে একটি সাব মেশিনগার, একটি চামড়ার ছোট এটাচি কেস পড়ে ছিল। কোন তথ্য পাওয়া যেতে পারে মনে করে এটাচি কেসটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শফিক। চলে যাবার আগে মোড়ে ডিউটিরত পুলিশকে দু'টি লাশের কথা জানিয়ে তাড়াতড়ি ওগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য বলে গেল।

শফিককে পাঠিয়ে দেবার পর আহমদ মুসা অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। কি যেন সমাধান খুঁজছে সে মনে মনে। কোন কাজে হঠাৎ করে কোথাও চলে যাওয়াও হাসান তারিকের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? এখন রাত ১২টা। তার এখানে পৌঁছবার কথা ছিল ১১ টায়। তাছাড়া সবচেয়ে আশ্চর্য তার অয়‍্যারলেসের নীরবতা। তাহলে........ ভাবতেই চোখ দু'টি জ্বলে উঠল মুসার। প্রতিশোধের আগুন যেন তাতে ঠিকরে পড়ছে। পরে ধীরে ধীরে সে চোখ নেমে এল অদ্ভুত এক তন্ময়তা। জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল তার চোখ। অন্ধকার দিগন্তের কাল পর্দা ছাড়িয়ে তিবেক, হিন্দুকুশ, কারাকোরাম পর্বতমালা পেরিয়ে ছুটে গেল তার মন। পূর্ব্ব তুর্কিস্তানের কানশু এলাকার একটি সুন্দর জনপদে। কি হাসি-আনন্দ আর সমৃদ্ধি ভরা দিনগুলো। মরুভূমির একখন্ড দুরন্ত হাওয়ার মতই তারা ঘুরে বেড়াত চারিদিকে। কাঁটার ঝোঁপে সারাদিন চলত লুকোচুরি খেলা। রাতের বেলা বাবার উষ্ণ কোলে বসে আকাশের তারার দিকে চেয়ে কত গল্প শুনত। শুনতে শুনতে জগৎ পেরিয়ে মন চলে যেত আর এক জগতে। অন্ধকার গোটা পৃথিবী। একজন মহাপুরুষ এলেন আরব দেশে। তাঁর হাতে নেমে একখন্ড আলো। অনেক ঘূর্ণাবর্ত আর ঝড়ের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তার এক খন্ড এসে ছড়িয়ে পড়ল তুর্কিস্তানেও। অনেক সময় গল্প শেষ না করেই বাবাকে উঠকে হত। মসজিদ থেকে ভেসে আসতো বড় চাচাজনের এক পশলা মিষ্টি সুর। বুঝতো না সে এক বর্ণও কিন্তু ভাল লাগতো খুব। এমনি করে দিন চলে এসেছিল, চলতও এভাবেই কিন্তু সাজানো গোছানো এক জীবনে এল ঝড়। পিছনে অবশিষ্ট থাকল রক্ত, হাহাকার জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আহমদ মুসার মুখ কি এক অব্যক্ত বেদনায় আর দৃঢ়তায় শক্ত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে বলল, 'মধ্য এশিয়া সিংকিয়াংএ, ফিলিপাইনে, ফিলিস্তিনে, ইথিওপিয়ায়,

চাদে মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন তোমরা চালাচ্ছ তার হিসাব অবশ্যই দিতে হবে। তোমার 'সিয়াটো' সেন্টো, ন্যাটো' গড়তে পারো, 'ওয়ারস' চুক্তি করতে পারো, কিন্তু আমরা কিছু করতে গেলেই তা হবে 'ফ্যানাটিক' আর 'গোড়ামি'?

জানালার পাল্লা দু'টো টানতে গিয়ে নীচের চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বাইরে প্রাচীরের পাশে বিড়ালের চোখের মত এক টুকরো ক্ষীণ আলো হঠাৎ জ্বলে উঠে নিভে গেল। পেন্সিল টর্চ নয়তো। সচকিত হয়ে উঠল আহমদ মুসা। অন্ধকারের জন্য বিশেষভাবে তৈরী বাইনোকুলার চোখে লাগাল দ্রুত। বাইরের অন্ধকার অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে উঠল। দেখা গেল হুক লাগানো দড়ি বেড়ে একটি ছায়ামূর্তি প্রাচীরে উঠে বসেছে। কালো পোশাকে আবৃত সর্বাঙ্গ। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে নামল নীচে। তারপর দেয়ালের পাশ ঘেঁষে শিকারী বিড়ালের মত এগিয়ে এল ধীরে নিঃশব্দ গতিতে।

প্রস্তুত হয়ে মুসা নেমে এল নীচে। সিঁড়ির মুখে সুইচ বোর্ডের পাশে একটি খামের আড়ালে দাঁড়াল সে। নিঃশব্দ পায়ে ছায়ামূর্তিটি উঠে এল বারান্দায়। তাকে এক খন্ড জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছু বুঝবার উপায় নেই। প্রায় দশ বারো হাতের মধ্যে সে চলে এসেছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি। আহমদ মুসা বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের সুইচে চাপ দিয়ে ডানহাতে রিভলভার ধরে বের হয়ে এল আড়াল থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ছাড়ামূর্তিটি মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ল। রিভলভারের নলটি স্থির লক্ষ্যে তুলে ধরে মুসা বলল, নিশানা আমার প্রায়ই ভুল হয় না, ফেলে দিন রিভলভার। বোম হাতের পেন্সিল হেডেড রিভলভারটিও ফেলে দিন।

ছায়ামূর্তিটি স্থির নিষ্কম্প চোখ দু'টি আহমদ মুসার চোখে কি যেন পাঠ করল। তারপর একটু দ্বিধা করে হাতের দু'টি অস্ত্র ছেড়ে দিল মেঝেয়।

পাশে মানুষের একটি ছায়া নড়ে উঠতে দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। প্রায় ছিটকে এক পাশে শুয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে দুপ্ করে একটি শব্দ হল, তীব্র আর্তনাদ করে পড়ে গেল সামনের লোকটি। আহমদ মুসার রিভলভারও গর্জে উঠল। কিছু বুঝবার আগেই পিছনের লোকটির হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। বাম হাতটি উপরে তুলতে চেষ্টা করল লোকটি। আহমদ মুসা গর্জে উঠল। হাত নামিয়ে নাও, নাহলে দ্বিতীয় গুলিটি এবার হাত নয় হৃদপিন্ড ভেদ করে বেরিয়ে যাবে।

আদেশ পালন করল লোকটি। তার ডান হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছিল এ সময় বাইরের গেটে গাড়ী দাঁড়ানোর শব্দ হল। উৎকর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু রিভলভারের নল তার একটুও নড়ল না। বাইরে থেকে একটি পরিচিত সংকেত এল, আহমদ মুসা তার উত্তর দিতেই কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে সেখানে হাজির হল ফারুক। এসেই বলল, ঠিক, আমার কান ভুল শোনেনি, যা ভেবেছিলাম তাই।

ওসব এ্যানালেসিস পরে করো ফারুক। আগে আমাদের এ মেহমানটির পকেট থেকে দ্বিতীয় রিভলবারটি বের করে নাও। সাবধানে হাত দিও পকেটে হয়তো আরো কিছু থাকতে পারে। রাত তখন একটা। আহমদ মুসা আর ফারুক আমিন মুখোমুখি একটি টেবিলে বসে। আহমদ মুসার সামনে ছোট্ট একটি চিরকুটঃ

"একটি বেশ নতুন উপাদান। WRF সক্রিয় - আম্মান বর্তমানে তাদের লক্ষ্য - একটি "v" হিসাবে ট্রাউজার ব্যান্ডে দুটি আলপিন তাদের পরিচয় তৈরি করে"

ধীরে ধীরে চিরকুট থেকে মুখ তলে আহমদ মুসা বলল, ইহুদীদের 'মোসাদ' আর পশ্চিমা সি, আই, এ, এর সাথে এসে জুটল কে আবার এই WRF? কি চায় ওরা? ফারুকের দিকে চেয়ে মুসা বলল, আমাদের আজকের মেহমান কোন দলের খোঁজ নিলে ফারুক?

ফারুক বলল, হ্যাঁ, WRF। ট্রাউজারের ব্যান্ডে 'ভি' আকারের দু'টো পিন দেখেছি।

ঘড়ির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, সময় বেশী হতে নেই। তাছাড়া ওর ব্যবস্থা এখনই প্রয়োজন কোন ব্যাপারকেই বিশেষ করে এসব বিপদজনক বোঝা বেশীদূর টেনে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু তার আগে চল পরীক্ষা করা যাক লোকটিকে।

ডিপ নীল আলো চারদিকে। বক-সাদা দেয়াল সে আলো প্রতিফলিত হয়ে স্বপনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আধ-শোয়া অবস্থায় ইজি চেয়ারে পড়ে থাকা লোটির ডান বাহু থেকে পেন্টাখল ইনজেকশনের সূচ ধীরে ধীরে টেনে বের করল। তারপর মৃদু হেসে আহমদ মুসা বলল, বেশ কিছু একটু ক্লান্তি, একটু একটু ঘুম ঘুম ভাব বোধ করবেন মিনিট খানেক তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আগের সবগুলো কথা মনে পড়বে। আর বলতেও কোন কষ্ট হবে না।

লোকটির চোখ বুজে গিয়েছিল। আহমদ মুসা একটি চেয়ার টেনে নিয়ে তার সম্মুখে বসল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, চোখ খুলুন, আমার চোখেন দিকে দেখুন। আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেল লোকটির। আহমদ মুসা বলল, আপনার নাম কি?

-মিখাইল ইয়াকুবভ। -আপনি কোন দেশী?

-ইউক্রাইনি।

-কিন্তু দেখে তো তুর্কী মনে হয়?

-আমার পিতা- মাতা নাকি তুর্কী ছিলেন।

-ছিলেন কেমন?

-আমি সাইবেরিয়ার শিশু উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষ।

-আপনার পিতা মাতা কি তাহলে মুসলমান ছিলেন?

-জানি না। তবে সেই উদ্বাস্তু শিবিরে আমর ট্রেনিং গ্রহণ কালে একবার অদ্ভুত এক বৃদ্ধ আমাকে বলেছিলেন যে, ১৯১৭ এর অক্টোবর বিপ্লবের পরে যে সব তুর্কী মুসলমানদের কে সাইবেরিয়ার চালান করা হয়েছিল, আমি তাদেরই কোন এক জনের সন্তান।

-এখন আপনি কি মনে করেন নিজের পরিচয় সম্বন্ধে?

-পূর্ব পরিচয়ে আমার প্রয়োজন নেই।

-আচ্ছা WRF কি?

-World Red Forces বিশ্ব কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অগ্রবাহিনী।

-আপনি কি এর সদস্য?

-হ্যাঁ।

-কেন আপনি এখানে এসেছিলেন আজ?

-বহুদিন ধরে WRF আপনাকে খুঁজছে। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল আপনাকে হত্যা করার অথবা সম্ভব হলে ধরে নিয়ে যাবার।

-সাইমুমের প্রতি আপনাদের এ শুভ দৃষ্টি কেন?

-সাইমুম বিশ্ব কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের নাম্বার ওয়ান এনিমি।

-WRF এর কেন্দ্র কোথায়? কাদের নিয়ে গঠিত?

-এর নির্দিষ্ট কোন কেন্দ্র নেই। কেন্দ্রীয় কাউন্সিল যখন যেখানে থাকে সেখানেই এর কেন্দ্র। WRF কমিউনিষ্ট শক্তিগুলোর সম্মিলনে গঠিত একটি বেসরকারী সংস্থা।

-আবার কোথায় কিভাবে WRF কাজ করছে?

-আমি জানি না। শুধু এটকুই জানি, মুসলিম দেশগুলোকে এজন্য বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে।

-আজকে এখানের খোঁজ কে দিয়েছে আপনাদের?

-আমি জানি না। আদেশ পালন করেছি শুধু।

-আদেশ কোত্থেকে এসেছে?

-আল কবির রোডের ২৩৩ নং বাড়ীর একটি ঘরে রক্ষিত কাঠের বাক্স থেকে নির্দেশ লিখিত চিঠি পেয়েছি?

-হাসান তারিককে চিনেন?

-নাম শুনেছি।

-গত ১০ ঘন্টা থেকে তার খোঁজ নেই। তার সম্বন্ধে কিছু জানেন? -যে টুকুর সাথে আমরা সংশ্লিষ্ট তার বেশী কোন কিছুই আমাদের জানতে দেওয়া হয় না।

যেন অসীম ক্লান্তিতে চোখ দু'টি আবার বুজে আসছিল। ফারুকের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, এবার সরিয়ে নিয়ে যাও। হ্যাঁ এদের পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্যের কথা একে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একবার শেষ সুযোগ দিবে।

কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার চারিদিকে। দুর্গম পার্বত্য পথ। পশ্চিম দিক থেকে জর্দান নদীর স্পর্শ চিহ্নিত ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। নদীর পূর্ব তীরের বিভিন্ন স্থানে অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। ওগুলো জর্দান সীমান্তরক্ষীদের ছাউনি। জর্দান নদীর ওপারে থেকেও ইসরাইলের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ঘাটির ক্ষীণ আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

পার্বত্য পথ ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে চারটি ছায়ামূর্তি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ। মাথায় ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল, ঠোঁট পুরু, মুখ লম্বাটে, বিশাল সুগঠিত দেহ। এর নাম আবু বকর সেনৌসি। দ্বিতীয় জন তীর্গ রোদ পোড়া লাল মুখ, সযত্ব রক্ষিত দাড়ি। এর নাম আবদুর রহমান। এরা হলেন UMLLA (United Muslim Liberation League of Africa) এর প্রতিনিধি।

তৃতীয় জন প্রায় সাড়ে ছ'ফুট উঁচু। রং হলদে, তুর্কী টুপি মাথায়, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে মুখে ক্ষীপ্রতার ভাব সব সময় পরিস্ফুট। ইনি হলেন তুরস্ক থেকে আগত তুর্কিস্থান আযাদ আন্দোলনের নেতা মোস্তফা আমিন চুগতাই। এরা এসেছেন আজকে সাইমুমের পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা কমিটির বিশেষ বৈঠকে তাদের আবেদন নিয়ে। আর চতুর্থ ব্যক্তি সাইমুমের সদস্য আবদুর রশিদ তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন।

আবদুর রশিদকে খুব চিন্তান্বিত মনে হচ্ছিল। সে হঠাৎ চুগতাই-এর দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা জনাব আমিন, হাসান তারিক চিঠি দেওয়ার পর আপনাকে কি মুখে কিছু বলেনি?

আমিন চুগতাই দ্রুত অথচ অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, হাসান তারিককে অত্যন্ত ব্যস্ত মনে হচ্ছিল, চিঠি দিয়ে ৫ মিনিটের বেশী অপেক্ষা করেনি। আমি তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করতেও সংকোচ বোধ করেছি। আজ ভোরে জনাব আলি এফেন্দির কাছে তাঁর নিখোজের খবর শুনে হতবাক হয়েছি। আজ বুঝতে পারছি, তার অস্বাভাবিক অস্থিরতাকে আমাদের অনুসরণ করা উচিৎ ছিল।

কিছুক্ষণ পথ চলার পর নীচে পাহাড়ের ঢালুতে অসংখ্য আলো দেখা গেল। ওগুলো আকাশের ছায়াপথের ন্যায় উত্তর দিকে এগিয়ে এক সরল রেখার মত। আবদুর রশিদ ওদিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল, ইহুদী বর্বরতার সাক্ষ্য দেখুন। নিজের দেশ, নিজের সকল সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে একটুকরো কুঁড়েঘড়ে পশুর মত এরা বাস করছে বছরের পর বছর ধরে। বাস্তুহারা এ লক্ষ লক্ষ মুসলমান জাতিসংঘের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল বিশটি বছর ধরে। অনাহার, অখাদ্য, অপুষ্টি ও অচিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে তারা ক্রমশঃ। কিন্তু এদের আর্তক্রন্দন আর মুমূর্ষ চিৎকার বিশ বছরেও জাতিসংঘের কানে পৌঁছেনি। বলতে বলতে থামল আবদুর রশিদ। তারপর আবার বলল, কিন্তু অপেক্ষার দিন শেষ হয়েছে, ধৈর্য্যের সকল বাদ ভেঙ্গে গেছে। আমরা মানুষের উপর নির্ভর করে খেশারত দিয়েছি বহু। আর নয়। অস্ত্র তুলে নিয়েছি এবার আমরা দু'টো পথ আমাদের সামনে হয় শহীদ না হয় গাজী।

আমিন চুগতাই বলল, জনাব রশিদ, আপনাদের উদ্বাস্তুদের মধ্যে শিক্ষা ও সংগঠনের কোন ব্যবস্থা ছিল না বলেই জানি, কিন্তু এমন বিস্ময়করভাবে সংগঠিত হতে পারলেন কেমন করে আর এমন ট্রেনিংইবা পেলেন কোথা থেকে? আবদুর রশিদ মৃদু হেসে বলল, আমাদের শিক্ষা ও সংগঠন সম্বন্ধে আপনার ধারণা কিছুটা সত্য, কিন্তু সবটুকু সত্য নয়। যে সময় হাজার হাজার আহত ও ছিন্নমূল মানুষের স্রোত জর্দান, সিরিয়া, ইরাক আর সিনাইয়ে প্রবেশ করে, তখন আমাদের বিশ্রামের জন্য মাটির শয্যা, খাওয়ার জন্য কুপের পানি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমাদের এ চরম দুর্দিনে অনেকেই আমাদের সাহায্য করেছিল, কিন্তু সেদিন অদ্ভুত একদল কর্মী ভাইদের আমরা একান্ত করে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম। মা'র কাছে গল্প শুনেছি। শুনতাম মা প্রায়ই বলতেন, মদিনার আনসারদের আল্লাহ আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। এদের আপনারা সকলেই আজ চিনেন-ইখওয়ানুল মুসলিমুন। ইখওয়ান ভাইরা সেদিন শুধু আমাদের জন্য চিকিৎসা, খাদ্য আর তাঁবুরই ব্যবস্থা করেছিলেন না। উদ্বাস্তু পল্লীগুলোকে বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করে প্রত্যেকটিতে একটি করে শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল দীর্ঘমেয়াদী সামরিক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা। শিবিরগুলিতে ইখওয়ান কমীরা শিক্ষক ও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁরা বলতেন বলে শুনেছি, বিশ্ব-রাজনীতিতে অনুন্নত ও অন্তর্দ্বন্দ্বে মুসলিম দেশগুলো যে ভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে, তাতে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য তাদের সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করা যেতে পারে না। ফিলিস্তিনের প্রকৃত মুক্তি অকুতোভয মুসলিম তরুণদের বেসরকারী সংগ্রামেই অর্জিত হবে।' আজকের সাইমুমের জন্ম হয়েছিল সেদিন আমাদের ইখওয়ান ভাইদের হাতইে। হয়ত অনেক আগেই তেলআবিবের প্রাসাদ শীর্ষ থেকে ইহুদী- পতাকা ভূমধ্যসাগরে ডুবে যেত, কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের আশার আলোক বর্তিকা রাগুগ্রস্থ হল। ইখওয়ান নেতা হাসানুল বান্না মিশরের রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। হঠাৎ আমিন চুগতাই এর কনুই এ গুতা খেয়ে সম্মুখে তাকিয়ে রশিদ দেখতে পেল, পাহাড়ের অন্ধকার গুহা থেকে আলোক সংকেত হল নির্দিষ্ট নিয়মে কয়েকবার। সে তার সাথীদের জানাল আমরা প্রথম চেকপোষ্টে এসে গেছি। কয়েক গজ সামনে দেখা গেল উদ্ধত মেশিন গান হাতে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে দু'টি ছায়ামূর্তি।

আবদুর রশিদ বিচিত্র স্বরে একটি শীষ দিয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেহ কালো কাপড়ে আবৃত একজন বিশালকায় প্রহরী একটি প্লেটে করে কতগুলি কাঠের অক্ষর এনে আবু বকর সেনৌসির সামনে তুলে ধরল। সেনৌসি তার থেকে W অক্ষরটি তুলে নিল। অমনি লোকটি রিভলভার নামিয়ে ছালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করল সকলের সাথে। প্রথম চেকপোষ্ট পেরিয়ে এল ওরা। বিস্মিত আমিন চুগতাই প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার?

আবদুর রশিদ হেসে বলল, তিন নম্বরে আপনার পালাও আসছে। ঘাটিতে ঢোকার জন্য এ ধরনের টেষ্টে আপনাকেও উত্তীর্ণ হতে হবে। চিন্তিত আমিন চুগতাই বলল, কিন্তু আমি তো এ সংকেত জানতে পারিনি হাসান তারিক আমাকে

-তা আমি বুছলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি আপনার মতই অজ্ঞ। দেখা যাক, আমি মুসা ভাইকে জানিয়েছি আপনার কথা। আরও কয়েক মাইল কষ্টকর আরোহন-অবতরণের পর তারা দ্বিতীয় চেক পোষ্টে পৌঁছল। সেখাসে আগের মত করেই প্লেটে কতগুলো কাঠের অক্ষর আনা হল আব্দুর রহমানের সামনে। তা থেকে তিনি A অক্ষরটি তুলে নিলেন।

তৃতীয় চেকপোষ্ট গিয়ে আমিন চুগতাই প্রহরীদের হাতে আটকা পড়ে গেল। হেড কোয়ার্টার থেকে নূতন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদেরকে ওখানে অপেক্ষা করতে আদেশ করা হল। প্রায় পনের মিনিট পর আহমদ মুসার বিশেষ নির্দেশে আমিন চুগতাইকে ছাড়া হল।

আম্মান থেকে ১২ মাইল উত্তরে জর্দান নদী থেকে ২০ মাইল পূর্বে একটি সংকীর্ণ পার্বত্য উপত্যকার পাশে পর্বত গাত্রের কয়েকটি গোপন প্রকোষ্ঠ আলোকিত হয়ে উঠেছে। পর্বত গুহার চতুর্দিকে মাইলের পর মাইল ধরে 'সাইমুম' মুক্তি সেনার ঘাঁটি ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে। এখান থেকে পরিচালিত গেরিলাভিযান ইসরাইলের ইলাত থেকে গাজা, হাইফা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত ইহুদী সম্রাজ্যবাদীদের সুখনিদ্রাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে রাইফেল নিয়ে পাহারায় বসতেও তাদের বুক আজ দুরু দুরু করে। যেন তার বুঝতে পারছে, হিসাবের দিন আসন্ন। প্যালেষ্টাইনী মুসলমানদের প্রতিটি ফোটা রক্তের শোধ আজ তাদের দিতে হবে।

উজ্জ্বল প্রকোষ্ঠগুলির একটিতে বিরাট এক গোল টেবিলের চারদিকে চেয়ার পাতা। ঘরের প্রতিটি চিনিস ঝকঝক তকতক করছে। টিবিল ঘিরে ১০ টি চেয়ার। ৮ জন লোক বসে আছে। এক পাশের দু'টি চেয়ার তখন ও খালি একটি হাসান তারিকের অপরটি মেজর জেনারেল আলী এফেন্দির। হাসান তারিক নিখোঁজ। আর আলী এফেন্দী এখনো পৌঁছুতে পারেনি। সাইমুমের তিনজন সদস্য ছাড়াও যারা আজকের বৈঠকে এসছে, তারা হলো আফ্রিকার দু' জন, তুরষ্ক থেকে একজন। UMLLA কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পাঠানো রিপোর্ট পড়ছিলেন আফ্রিকার অন্যতম প্রতিনিধি আবদুর রহমান। এ শীতের রাতেও তার কপালে জমে উছেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আহমদ মুসার মুখ নিচু। তন্ময়তার কোন অতল গভীরে যেন হারিয়ে গেছে সে। আবদুর রহমান তাঁর রিপোর্টে বলছিলেনঃ-

"আফ্রিকার মোট ৩২২০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা হল ১৯৪ মিলিয়ন। আর বহিরাগত ঔপনিবেশিক খৃষ্টানদের নিয়ে মোট খৃষ্টান জনসংখ্যা হল ৪৭ মিলিয়ন। এ খৃষ্টানরা দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এ অঞ্চলের কোন মুসলিম দেশেই এদের সংখ্যা ১৫% এর বেশী নয়। অথচ এ সামান্য সংখ্যক হয়েও তারা স্বগোত্রীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইথিওপিয়া, চাঁদ, মালি, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া, ঘানা, সিয়েরলিওন, ডাহোমী, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আপার ভোল্টা, আইভরি কোস্ট, সেগোল প্রভৃতি মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে শিক্ষার দ্বার মুসলমানদের জন্য প্রায় অবরুদ্ধ। অবশ্য কোন মুসলিম সন্তান যদি একান্তই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও ঢুকবার সুযোগ পায়, তাহলে তাকে মুসলমান নাম বদল করে খৃষ্টান নাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং অবশেষে খৃষ্টানই হয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক কায়কারবার ব্যাবসায় বাণিজ্যের সব সুযোগই খৃষ্টানদের কুক্ষিগত। রাজনীতি ক্ষেত্রে মুসলমানরাতো অস্পৃশ্য। এভাবে সর্বমুখী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে মুসলমানদের অস্তিত্ব আজ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে, এসব কিছুর উপরে রয়েছে আবার রাজনৈতিক নির্যাতন। মাত্র কিছুদিন আগে চাদের লিবারেশন ফ্রন্টের সহস্র সহস্র কর্মীকে অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইথিওপিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হত্যা করে গাছে গাছে লটকিয়ে রাখা হয়েছিল যা দেখে নিরপেক্ষ বিদেশীরাও চোখের পানি রোধ করতে পারেনি। জাঞ্জিবারের মুসলিম জননেতা কাশিম হাঙ্গা, আলি মহসিন, সালাম বাম্ব, ইবনে সালেহ আবদার জুমা, খাতির মুহাম্মদ সামত, জুমা আলই, আমিরাল আল্লারখিয় বছরের পর বছর ধরে কারাগারে যন্ত্রণা ভোগ করেছে। শুধু তাঞ্জানিয়ার কারাগারেই নয়, এমনই সহস্র সহস্র নরনারী আফ্রিকার বিভিন্ন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

আমরা ঠেকে ঠেকে বুঝেছি এবং একথা আমরা নিশ্চিতভাবে আজ বিশ্বাস করি যে, ভিক্ষা করে সুবিচার আদায় করা যাবে না কিংবা আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারের মহড়াও এসব নির্যাতিত মানুষের কোন কাজে আসবে না। মজলুম মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ -সংগ্রাম। এ সংগ্রামকে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের আবেদন ৫ টিঃ

(১) দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সাহায্য।

 (২) মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহ।

 (৩) আহত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা।

 (৪) মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা ও ট্রেনিং এর জন্য উপদেষ্টা প্রেরণ।

(৫) সাইমুম কর্তৃক নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলন গুলোর নেতৃত্ব গ্রহণ।

সুদীর্ঘ দশ পৃষ্ঠাব্যাপী লিখিত রিপোর্ট শেষ করলেন আবদুর রহমান। কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপচাপ। ধীরে ধীরে টেবিলে রাখা আফ্রিকার একটি বিশেষ মানচিত্র থেকে মুখ তুলল আহমদ মুসা। আর লিবিয়া ও চাদের পর্বতমালাকে আপনাদের প্রধান ও স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে মনোনীত করেছেন কোন কারণে? এর চেয়ে সমুদ্র কুলবর্তী কোন স্থানকে নির্বাচন করলে যুক্তিযুক্ত হতো না কি?

আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন আবু বকর সেনৌসি। তিনি বললেন এর কারণ তিনটি। প্রথম কারণ উভয় স্থানই অত্যন্ত দুর্গম এবং যে কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন শত্রু রাজধানী থেকে বহুদূরে। শুধু স্থান দুটি ভৌগলিক দিক দিয়ে দুর্গমই নয়, এর চারিদিকে হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পার্বত্য আর বেদুঈন গোত্র। তারা আমাদের বন্ধু এবং আমাদের সংগ্রামী শক্তির বিশিষ্ট অঙ্গ।

দ্বিতীয় কারণ এখান থেকে অতি সহজেই বিভিন্ন আফ্রিকান মুসলিম দেশের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখা যাবে।

তৃতীয় কারণ অস্ত্র-পাতির সরবরাহও এখানে নিরাপদ হতে পারবে। বন্ধুদেশ সুদানের পথে, লোহিত সাগরের পথে সহজেই আমরা কোন সরবরাহ পেতে পারি। আর উত্তরদিকে ভূমধ্যসাগরের পথে সাইরেনিকা ও লিবিয়া মরুভূমির মধ্য দিয়ে সকল রকমের সরবরাহ নিরাপদে আসতে পারে। সাইরেনিকার নির্জন ও দুর্গম সমুদ্রতীর এবং এর গভীর পার্বত্য বনাঞ্চল এ কাজের খুবই অনুকুল। সাইরেনিকার আরব বেদুঈনদের অমূল্য সাহায্য আমরা এ কাজে পাব। বেদুঈনরা সাম্রাজ্যবাদীদেরকে মজ্জাগত ভাবে ঘৃণা করে। ইতালীয় কোম্পানীদের উপনিবেশী নির্যাতনের কথা বেদুঈনরা আজও ভুলে নাই। আজও সাইরেনিকা আর লিবিয়ার পথেঘাটে প্রান্তরে নির্যাতনের সাক্ষর জীবন্ত হয়ে আছে। বেদুঈনদের পানি কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলার জন্য যে অসংখ্য কূপ সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা আজ ও তেমনি আছে। লিবিয়া ও সাইরেনিকার বহুস্থানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এমন বহু জনপদ পাওয়া যাবে যেগুলো একমাত্র পানির অভাবে বিরাণ হয়ে গেছে। ঘাঁটি হিসাবে 'কুফরা' আর লিবিয়ার মরুভূমির দক্ষিণ সীমান্তের পর্বতমালাকে নির্বাচনের আর একটি বড় কারণ হল, আজও এ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মুসলিম বৃদ্ধ ও তরুণদের মনে সেনৌসী আন্দোলনের আদর্শ ও আবদুল করিম রিনফের জ্বালাময়ী প্রেরণা রূপকথার মত হলেও জীবন্ত হয়ে আছে।

আহমদ মুসার চোখ দু'টি খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সে বলল, আপনাদের দূরদৃষ্টি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি বিশ্বাস করি বিজয় আপনাদের সুনিশ্চিত। আপনাদের পিছনে সেনৌসী আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে, আবদুল করিম রিফের প্রেরণা রয়েছে, আর রয়েছে, হাসানুল বান্নার সংগঠন ও আত্মত্যাগের শিক্ষা। মোস্তফা আমিন চুগতাই বললেন, তিনি রিপোর্ট এখনও শেষ করতে পারেননি, রিপোর্ট তিনি সমাপ্তি অধিবেশনে পেশ করবেন।

রিপোর্ট অধিবেশন তখনকার মত স্থগিত হল। আহমদ মুসা টেবিলের পাশে একটি বোতাম টিপে ধরল। কিছুক্ষণ পর একজন লোক প্রবেশ করে ছালাম জানাল। মুসা বলল আলি এফেন্দির কোন খবর নেই?

-জি না।

-আমরা কন্ট্রোল রুমে যেতে চাই, তুমি জামিলকে বলে সত্তর ব্যবস্থা কর। তারপর সকলের দিকে ফিরে হেসে বলল, ভাই আমিন চুগতাই জানতে চেয়েছেন কিভাবে আমরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছি। তার জন্যই এ ব্যবস্থা। আবু বকর সেনৌসি মৃদু হেসে বলল, আমরা আমিন ভাই এর কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ।

পাহাড়ের কয়েকটি অন্ধকার আকাবাঁকা গলি পেরিয়ে আটটি ছায়ামূর্তি ত্রিকোণ একটি জায়গায় এসে দাঁড়াল। জায়গাটি স্বল্প পরিসর। একটি প্রকান্ড পাথর উত্তর দিক থেকে এসে মাথার উপর ছাদের মত আড়াল সৃষ্টি করেছে, তারা ওখানে পৌঁছাতেই উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে একটি পাথর সরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক সন্ধানী আলো এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে সে উন্মক্ত পথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। আবার পূর্বের মতই সে গলি পথ শুরু হল। দু'ধারে পাহাড়ের দেয়াল। অন্ধকারে কিছুক্ষন চলার পর এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। পাশে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রথমে তিনটি জোরে এবং পরে পাঁচটি আস্তে টোকা দিল। টোকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় বিশ গজ উপরে একটি ম্লান নীল বাল্ব জ্বলে উঠল।

আহমদ মুসা পুনরায় প্রথমে পাঁচটি ও পরে তিনটি টোকা দিল নির্দিষ্ট জায়গায়। এবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আটটি দড়ির মই নেমে এল নিচে। ঢাকনীর বিপ্লব পরিষদের মওলানা ফারুক হেসে বললেন, আবার একি ট্রেনিং এ পাল্লায় ফেল্লেন?

পাহাড় দেশের মানুষ হয়ে আমাদের এ ক্ষুদে পাহাড়কে আর লজ্জা দিবেন না মওলানা। হেসে আহমদ মুসা জবাব দিল। দড়ির মইগুলি নেমে এল। সেগুলোতে উঠতেই মুহূর্তে তাদেরকে উপরে নিয়ে এল। তারা একটি কংক্রিটের ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। ছাদটি বিরাট প্রশস্ত। ছাদে উঠে দাঁড়াতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে হিমেল পরশ বুলিয়ে গেল।

জর্দান নদীর এ সওগাত। রাত্রির অন্ধকার না থাকলে দেখা যেত কিছু দূর দিয়ে রূপালী ফিতার মত জর্দান নদী বয়ে যাচ্ছে। আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে ছাদটি পেরিয়ে একটি সিঁড়ি মুখে প্রবেশ করল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল মওলানা ফারুক, আবু বকর সেনৌসি ও আবদুর রহমানের মুখ। তারা দেখল সিঁড়ির প্রান্তে হাসি মুখে দু'হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের বিশিষ্ট কর্ণধার আশিন আল আজহারী এবং বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের সামরিক বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ অতিথিদেরকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে।

সকলে মিলে আবার তারা চলতে শুরু করল। আবু বকর সেনৌসিদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। আহমদ মুসা তাদের তিকে চেয়ে হেসে বলল- জনাব আমিন আল আজহারী সাইমুমের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান এবং জনাব আবদুলাহ আমর এ বিভাগের প্রধান উপদেষ্টা।

তারা সকলে পার্শ্বস্থ একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষে প্রবেশ করল। দরজা দিয়ে বাহির থেকে এক টুকরো আলো এসে বৃহৎ লম্বা টেবিলটির একাংশ আলোকিত করেছে। তারা লম্বা টেবিলটির দক্ষিন পার্শে গিয়ে তারপর দরজাটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতেই অল্প আলোর রেশটুকুও মিলিয়ে গেল। ঘরটি হয়ে গেল সম্পূর্ণ অন্ধকার।

আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠ শুনা গেল। সে বলল, বিজ্ঞ ইহুদী মুরুব্বিদের পরিকল্পিত বহু বছর ধরে গড়ে তোলা বিশ্বজোড়া ইহুদী চক্রান্তের বিষফল ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিভাবে আমরা অগ্রসর হচ্ছি তা এবার আপানদেরকে বুঝিয়ে দিবেন জনাব আমিন আল আজহারী।

আমিন আল আজহারী টেবিলের উপর দু'টি কনুই রেখে সামনের দিকে এইটু ঝুকে বসলেন তাঁর শান্ত কন্ঠে শোনা গেল সাইমুমের মূল পরিকল্পনার বিষয়ে কিছু বলার আগে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলা দরকার। আরব দেশগুলোর লক্ষ্যগত অনৈক্য, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং সামরিক ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার জন্য আজও ইহুদীদের হাত থেকে আরবভূমি মুক্ত করতে পারা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে ইহুদীদের উৎখাত করা যাবে না। তাদের পিছনে রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় শক্তি জোট। আরব ভূমিকে মুক্ত করতে চাইলে এবং কয়েক যুগ ধরে মুসলমানদের উপর কৃত সকল জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হলে ইসরাইলকে ভিতর থেকে আঘাত হেনে টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সাইমুম। সাইমুমের পরিকল্পনাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। কথাগুলো বলে থামলেন তিনি একটু। আবার বললেন চেয়ে দেখুন সামনে।

সবাই সামনে তাকাল। কোথায় যেন খুট করে একটু শব্দ হল দেয়ালের কাল সীমান্ত রেখায় ইসরাইলের একটি বিরাট মানচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর মানচিত্রের বিভিন্ন স্থানে ফুটে উঠল অসংখ্য নীল বিন্দু।

আমিন আল-আজহরী শুরু করলেন, ইসরাইলের মানচিত্রে যে নীল বিন্দুগুলো দেখছেন ওগুলো ইসরাইলের গ্রাম। গুনে গুনে দেখুন ওদের সংখ্যা ২৩৯৯ টি হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে ৭ সদস্যের একটি করে বিপ্লবী ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। ইউনিটের অধিকাংশ সদস্য প্যালেষ্টাইনের ছদ্মবেশী আরব মুসলমান। সুদীর্ঘ ৬ বৎসর অবিরামভাবে কাজ করেছি আমরা এ ইউনিটগুলো প্রতিষ্ঠা করতে। প্রতিটি গ্রামের মাটির তলায় একটি করে ক্ষুদ্র অস্ত্রাগার তৈরী করেছি। পূর্বে অস্ত্রাগারগুলো প্রায় শূন্য ছিল কিন্তু গত ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধের পর সিনাই মরুভূমি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে তা আমরা পূর্ণ করে ফেলেছি। প্রত্যেকটি অস্ত্রগারে রয়েছে দু'ডজন হাতবোমা, ৫ টি রাইফেল, ৬ টি পিস্তল ও ১টি সাবমেশিনগান। বিপ্লবী ইউনিটগুলো প্রতিষ্ঠার সময় ইসরাইলী গোয়েন্দা ও সৈন্য বিভাগের দৃষ্টি দেশের অভ্যন্তর থেকে সরিয়ে নেবার জন্য আমরা ইসরাইলের সীমান্ত এলাকায় চালিয়েছি হাজার হাজার অভিযান। ইসরাইল পাগল হয়ে উঠেছিল তার সীমান্ত নিয়ে। তাদের উন্মত্ত মানসিকতার পূর্ণ পরিচয় ফুটে উঠে "সাইমুমের" ঘাঁটি সন্দেহে জর্দানের "কারামা" আক্রমণের মধ্যে।

খুট করে আর একটি শব্দ হল। মানচিত্রে সিনাই মালভূমির অভ্যন্তরে এবং গোলান হাইট থেকে প্রায় ৫০ মাইল ভিতরে দু'টি বড় নীল আলো ফুটে উঠল। জনাব আজহারী বললেন ইসরাইলের অভ্যন্তরে এ দু'টি আমাদের মূল সরবরাহ ঘাঁটি। দু'টি পুরান গির্জার নীচে মাটির তলায় এ দু'টি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে।

প্রথম পর্যায়ের কাজ আমাদের সমাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা প্রবেশ করেছি। তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানচিত্রে চারটি লাল বিন্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। জনাব আল আজহারী আবার শুর করলেন, লাল বিন্দু চারটি হল ইসরাইলের ইলাত, লুদ, তেলআবিব আর হাইফা এ চারটি স্থানে ইহুদীরা ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করেছি। এ ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটিগুলির আওতায় রয়েছে হেজাযের দু'টি পবিত্র শহর। তুরস্ক আর আরব রাষ্ট্রগুলির রাজধানী এবং সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ শহর। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ইসরাইলের চরম আঘাত হানার ঠিক পূর্বমুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটিগুলি বিনষ্ট করে দেয়া। অবশ্য আমরা জানি ইসরাইলের কমপক্ষে ১১টি আণবিক বোমা রয়েছে কিন্তু ওগুলো ব্যবহার করতে সমর্থ হবে না ইসরাইল। কারণ তার উপর আঘাত হানা হবে ভিতর থেকে-কোন আরব রাষ্ট্র থেকে নয়। তবুও আমরা এ বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখব এবং আনবিক অস্ত্র ব্যবহারের যে কোন প্ল্যান আমরা বিনষ্ট করে দেব।

জনাব আজাহারির শেষের বাক্যটি শেষ হবার সাথে সাথে আমিন চুগতাই যেন অনেকটা সঙ্কোচ জড়িত কন্ঠে বললো, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি একটি সিগারেট..........

দ্রুত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল আহমদ মুসার মনে। অবশেষে সে পরিস্কার গলায় বলল, না না আমাদের আপত্তি থাকবে কেন?

আমিন চুগতাই একটি সিগারেট মুখে পুরে লাইটার জ্বালল। লাইটারটি জ্বলে উঠতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। এক ঝলক তীক্ষ্ণ আলো আর লাইটার থেকে ভেসে আসা অতি সুক্ষ্ণ একটি পরিচিত শব্দ আহমদ মুসার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারলো না। ইতিমধ্যে জনাব আজহারি আবার বলতে শুরু করেছেন 'দ্বিতীয় পর্যায় সমাপ্ত হবার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হবে আমাদের সর্বাত্মক সংগ্রাম। ভিতর থেকে যে দুর্বার আঘাত আমরা হানব তা রোধ করার সাধ্য ইসরাইলের নেই। তার বিদেশী মুরব্বীরা তার পাশে এসে দাঁড়াবার পূর্বেই সে খতম হয়ে যাবে।

আমিন আল আজহারির কথার শেষ রেসটুকু ইথারে মিলিয়ে যাবার আগেই উজ্জ্বল সাদা আলোয় ঘরটি যেন হেসে উঠল। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল আগেই। সে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল চুগতাই এর দিকে। ভাবলেশহীন মুসা। চুগতাই টেবিলের উপর হাত রেখে বসে ছিল। তার চোখ দু'টি ঘরের চারদিকে ঘুরছিল। অনুসন্ধিৎসা সে চোখে। মনে তার প্রচন্ড ঝড় শামিল এফান "দেশের ইন্টারনাল সিকিউরিটির দায়িত্ব ঐ বুড়োটার উপরই তো ছিল। শুধু গাদা গাদা বেতন মেরেছে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে বুড়ো... আচ্ছা দ্বিতীয় পর্যায়ের কতদূর পৌঁছেছে এরা। পরিকল্পনা এদের নিখুঁত। ভাবতে আতঙ্ক লাগে -প্রতি গ্রামে এরা ছড়িয়ে আছে...।

আহমদ মুসা ধীরে ধীরে একটি হাত রাখল চুগতাই এ কাঁধে। তার হাতে একটি সিগারেট। চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল চুগতাইয়ের। প্রচন্ড এক হোঁচট খেল যেন সে। ভীষণ চমকে উঠল। ফিরে তাকিয়ে আহমদ মুসাকে দেখে ঠোঁটের প্রান্তে হাসি টেনে নিল। সামলে নিয়েছে সে নিজেকে। বলল, খুব চমকে দিয়েছেন তো আমাকে? আপনাদের বিস্ময়কর পরিকল্পনার রঙীন জগতে ঘুরছিলাম আমি এখনও।

- আমি দুঃখিত ভাই। বলল আহমদ মুসা। তারপর সিগারেটের একটি শলা বাম থেকে ডান হাতে নিয়ে সে বলল, আপনার লাইটারটি কি পেতে পারি? কথাটি শোনার সাথে সাথে ঠোঁটের কোনের হাসিটি দপ করে যেন নিভে গেল। এক টুকরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য আহমদ মুসার চোখে এসে স্থির হল। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যই। তারপরই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মোস্তফা আমিন চুগতাই। বলল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। বলে পকেট থেকে লাইটারটি বের করে জ্বালিয়ে আহমদ মুসার মুখের কাছে তুলে ধরল। সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, বাঃ লাইটারটির সিষ্টেম তো খুব সুন্দর। জার্মানির তৈরী না? দেখতে পারি একটু?

মোস্তফা আমিন চুগতাই এই অবস্থার জন্য বোধ হয় প্রস্তুত ছিল না মোটেই। কেমন একটি বিমূঢ় ভাব চোখে মুখে ফুটে উঠল তার। সে দ্বিধাজড়িত হাতে লাইটারটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।

আহমদ মুসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল চুগতাইকে। দেখল একটি হাত তার কোটের পকেটে। এর অর্থ মুসার অজানা নয়। সূক্ষ্ম এক টুকরো হাসি ফুটে উঠতে চাইল তার মুখে। সে লাইটারের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়েই বুঝতে পারল, একটি শক্তিশালী ক্যামেরা সংযোজন করা আছে ওতে।

একগাল ধোয়া ছেড়ে একটু ঝুঁকে পড়ে দু'টি কনুই টেবিলে রেখে মুফতি আল আজহারির দেকে একটু তাকিয়ে মৃদু হেসে আহমদ মুসা বলল, জনাব আমিন এ সামান্য ধরনের নেশাকেও ভালো চোখে দেখেন না। তবু রক্ষে যে আজ আপানাকে একজন সাথী হিসেবে পাওয়া গেল। এ অভ্যেস আপনার কত দিনের?

শুধু আমিন আল আজহারিই নয়, আবু বকর সেনৌসি, আবদুর রহমান এবং মওলানা ফারুকসহ সকলেই আহমদ মুসার জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা আর এ অস্বাভাবিক ব্যবহার বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে। আহমদ মুসা সিগারেট খায় না এটা সকলেই জানে। আহমদ মুসার এটি ছেলেমি না কোন বিশেষ অভিনয়? এ ধরনের ছেলেমি করার মতো লোক তো আহমদ মুসা নয়। তাহলে ... সকলের চোখে একরাশ বিস্ময়ভরা প্রশ্ন।

আহমদ মুসার কথায় চুগতাইকে একটু খুশী মনে হল। যেন এক খন্ড মেঘ তার মুখের উপর থেকে সরে গেল। মুফতি আমিন আল আজহারির দিকে একটু চোরা দৃষ্টিতে চেয়ে সকৌতুকে নিচু গলায় বলল, এ বদ অভ্যেসটি আমার ছোট বেলার। বন্ধুদের সংসর্গ দোষও বলতে পারেন একে।

আহমদ মুসা হেসে বলল, বন্ধুরা অনেক উপকারও করেছে আপনার। তা না হলে দেশের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় কি হতে পারতেন আপনি।

-ভালো দিকগুলো অস্বীকার আমিও করি না। হেসে বলল চুগতাই। আহমদ মুসা আবার শুরু করল, আমার মনে হয় কি জানেন, আপনি চেষ্টা করলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মল্লযোদ্ধা হতে পারতেন। এ প্রচেষ্টা ছেড়ে দিলেন কেন?

হঠাৎ চুগতাই এ চোখ মুখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। কি যেন বুঝতে চেষ্টা করল। মুহূর্তকাল পরে শান্ত কন্ঠে বলল, কিন্তু আপনি এ সব প্রশ্ন করছেন কেন?

আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, মোস্তফা আমিন চুগতাই-এ সাথে আপনাকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম। আমিন চুগতাই এর ডসিয়ার থেকে জানি, উনি জীবনে ফুটবলে পা রাখেননি। আর সত্যিই একজন শ্রেষ্ঠ মল্লযোদ্ধা তিনি। অথচ আপনি.......।

আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই স্প্রীং এর মত ছিটকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল চুগতাই। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। আহমদ মুসার ছয়ঘরা রিভলভারের চকচকে নল স্থির লক্ষ্যে চেয়ে আছে চুগতাই এর দিকে।

আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল, পকেট থেকে হাত বের করে নিন। মৃত্যু না চাইলে আত্মসর্পণ কারাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

-মৃত্যুকে আমি ভয় করি না মুসা। কিন্তু তোমরা জীবিত থাক তাও আমার কাম্য নয়। বলে সে বিদ্যুৎ বেগে পকেট থেকে হাত বের করল, হাতে ডিম্বাকৃতির একটি গ্রেনেড।

বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সবাই ঘটনার এ অবিশ্বাস্য আকস্মিকতায়। বেপরোয়া ঐ লোকটির দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল সবাই। তারা জানে হাতের ঐ বিশেষ হ্যান্ডে গ্রেনেডটি দিয়ে শুধু গুহার এ কয়জন মানুষই নয়, পাহাড়ের একটি অংশ সহজেই উড়িয়ে দেয়া যাবে।

কিন্তু গ্রেনেডটি ছুড়বার অবসর পেল না চুগতাই। আহমদ মুসার রিভলভার নিঃশব্দে একরাশ ধুম্র উদগিরণ করল। হ্যান্ডে গ্রেনেডটি হাতেই রইল, টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল চুগতাই এর দেহ। ঠিক এ সময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করল আলী এফেন্দি এবং তার সাথে সাথে মোস্তফা আমিন চুগতাই। ওদের দিকে তাকিয়ে একমাত্র আহমদ মুসা ছাড়া সকলের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে উঠল।

গত একরাত একদিনের কাহিনী শেষ করে চুপ করল মেজর জেনারেল আলী এফেন্দি। একটি গোল টেবিল ঘিরে সবাই বসে আছে নির্বাক হয়ে।

কথা বলল আহমদ মুসা প্রথম। বলল, পরশু দুপুরেই ইস্তাম্বুল গেছে হাসান তারিক। অথচ এত অল্প সময়ের মধ্যে হাসান তারিকের আটক থেকে শুরু করে মোস্তফা আমিনের কিডন্যাপ, একজন ইহুদি স্পাইকে নিখুঁত প্লাষ্টিক অপারেশন দ্বারা মোস্তফা আমিন চুগতাই এর পরিবর্তন কেমন করে সম্ভব হল? তাহলে আমাদের আজকের এ অধিবেশনের কথা এবং মোস্তফা আমিন চুগতাই এ এখানে যোগদানের কথা কি ওরা আগেই জানতে পেরেছিল?

আলী এফেন্দি বলল, যতদূর জানতে পেরেছি WRF এবং 'মোসাদে'র সম্মিলিত তৎপরতায় এটা সম্ভব হয়েছে। টার্কিস সিক্রেট সার্ভিস জানিয়েছে, গতকাল তুরস্ক ইরাক সীমান্ত থেকে একটি কফিন ইরান দিয়ে কাস্পীয়ান সাগরে অপেক্ষমান একটি সাবমেরিনে উঠেছে। সে কফিনের আবরণে যদি হাসান তারিককে পাচার করা হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায়, আমাদের এ অধিবেশন সংক্রান্ত সকল খবর ও তথ্য দিয়ে ডজঋ 'মোসাদ'কে সাহায্য করেছে, বিনিময়ে "মোসাদ" হাসান তারিককে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে।

-WRF এর এ তৎপরতার কথা আরও সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না হাসান তারিকের উপর WRF এর এ বিশেষ আগ্রহ কেন? বলল আহমদ মুসা।

একটু চিন্তা করে আলি এফেন্দি বলল, আপনার নিশ্চয় মনে আছে, দু' বছর আগে জর্দানে বিদেশী কূটনীতিক মার্থাল খিরভ গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে ধরা পড়েছিলেন। একমাত্র হাসান তারিকের কৃতিত্বেই দলিল দস্তাবেজসহ খিরভ হাতে নাতে ধরা পড়ে এবং সে দুর্ঘটনার সময় বিশ্বব্যাপী বহু আলোচিত দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা কূটনীতিক ব্রিগেডিয়ার ক্লিমোভিচ হাসান তারিকের গুলিতেই নিহত হয়েছিল। আমার মনে হয় হাসান তারিকের উপর তারই প্রতিশোধ নিতে এসেছে বেসরকারী আন্তর্জাতিক কম্যুনিষ্ট সন্ত্রাসবাদী সংস্থা WRF। খিরভ ও ক্লিমোভিচ উভয়েই যে এ বেসরকারী কম্যুনিষ্ট সংগঠন WRF এরও সদস্য ছিল, তা আমরা আজ নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারি।

আলী এফেন্দি থামল। ধীরে ধীরে মুখ তুলল আহমদ মুসা। মনে হল চিন্তার কোন অতল থেকে জেগে উঠল সে। বলল ধীরে ধীরে, ক্লিমোভিচকে অনুসরণ করে তার গোপন আড্ডার হানা দিয়ে একটি পরিকল্পনার দুর্বোধ্য নক্সা পেয়েছিল হাসান তারিক। কিন্তু নক্সাটি হাসান তারিক রাখতে পারেনি। সে দিনই গভীর রাতে আক্রান্ত হয়েছিল সে। ক্লিমোভিচের লাশ পেছনে রেখে তারা নক্সাটি নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কিছুক্ষণ থামলো আহমদ মুসা। আবার শুরু করল সে, পরিকল্পনার মূল কপি আমাদের কাছে না তাকলেও এর একটি ফটো কটি আমাদের কাছে আছে। এ কথা ওরা জানে কিনা জানি না, তবে আমার মনে হয় যদি প্রতিশোধ গ্রহণই WRF এর লক্ষ্য হত, তাহলে হাসান তারিককে ধরে না নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। এ থেকে প্রমাণ হয়, পরিকল্পনার নক্সা সম্পর্কে হাসান তারিককে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। হাসান তারিক পরিকল্পনার কতদূর জেনেছে, আর কেউ এর কোন কিছু জানতে পেরেছে কিনা, ইত্যাদি জেনে না নেয়া পর্যন্ত তারা হাসান তারিককে কিছুতেই হত্যা করবে না।

-পরিকল্পনা কি সম্পর্কিত এবং আপনারা কি জানতে পেরেছেন তা থেকে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে মোস্তফা আমিন।

-পরিকল্পনাটির অর্থ আজও আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো থেকে আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত তানজানিয়া এবং মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত অধ্যুষিত মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র। এর মাঝে অসংখ্য সাংকেতিক চিহ্ন এবং লাল ও কালো রেখার অসংখ্য সারি। সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে নিঃসন্দেহে আমরা বুঝতে পারছি, পরিকল্পনাটি আসলে WRF এর এবং তা যদি হয়, এর অর্থ আমাদের কাছে পরিস্কার, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে ওরা চক্রান্তের জাল বিছিয়ে রেখেছে। পরিকল্পনাটির নক্সাটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। কিন্তু তার আগে হাসান তারিক সম্বন্ধে আমাদের... কথা শেষ হলো না আহমদ মুসার। ঘরে পাথরের দেয়ালে এক বিশেষ স্থানে লাল সংকেত জ্বলে উঠল। আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে বলল, আকাশে নিশ্চয় কোথাও হানাদার ইসরাইলী বিমান দেখা গেছে। আমাদের রাডারের সংকেত ওটা। আসুন বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। সবাই উঠে এল ছাদে। পশ্চিম আকাশ তখন লাল হয়ে উঠেছে। জর্দান নদীর ওপারে বোমা ফেলেছে ইহুদিরা নিশ্চয়। বলল আহমদ মুসা।

ঘড়ি দেখে আব্দুর রশিদ বলল, আজ রাত ১২ টায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিট জেরুজালেমের তিন মাইল পশ্চিমে নতুন ইসরাইল ঘাঁটি আক্রমণ করেছে। মনে হয় তার দায়িত্ব পালন করে ইতিমধ্যেই নদীর ওপারে ফিরে এসেছে। ইসরাইলী বিমানগুলো মনে হয় তাদেরকেই তাড়া করে এসেছে। এসময় রাডার পর্যবেক্ষক আবদুল্লাহ মাসুদ এসে জানাল, জর্দান নদীর আড়াই মাইল পশ্চিমে আরব পল্লীর উপর বোমা ফেলেছে ইসরাইলীরা। সবাই চোখ ফিরাল লাল হয়ে ওঠা দিগন্তের দিকে। ঐ লাল আগুন কত অসংখ্য নারী পুরুষ আর অসহায় শিশুর রক্ত চুষে নিল কে জানে। কারো মুখে কোন কথা জাগলো না। বোধ হয় সবার মনে একই প্রশ্নঃ এ অগ্নি পরীক্ষা আর কতদিন চলবে? এ কোরবানীর শেষ হবে কবে?

Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp