Header Ads Widget

▶️ আধার রাতের বন্দিনী। পর্ব-৩

 

(ঐতিহাসিক বীরাঙ্গনা সায়েমার এই উপন্যাস টি যারা পরছেন- তাদের উদ্যেশ্যে বলি। এটা আধার রাতের বন্দিনী পর্ব-২। যারা ১ নম্বর পর্ব পড়েননি তারা নিচে ক্লিক হেয়ারে চাপ দিয়ে ১ম পর্ব পড়ে আসুন।) 

আধার রাতের বন্দিনী-১

*Click Here...

আধার রাতে বন্দিনী-২

*Click Here....

[ছয়]

রাত আনুমানিক তিনটা। আল্লাহর উপর ভরসা করে আমি আস্তে আস্তে শহীদদের লাশ দেখতে অগ্রসর হলাম। সামনে একটু অগ্রসর হয়েই অনুভব করলাম, মৃদুমন্দ অনিল হিল্লোল সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছে এক জান্নাতী খুশবু। এমন মনোমুগ্ধকর পাগলকরা সুবাস যা দুনিয়ার কোন নাসিকা কোনদিন গ্রহণ করেনি। আমার হৃদয় সাক্ষ্য দিল, এ নিশ্চয়ই শহীদের রক্তের সুঘ্রাণ। কামরার নিকট গিয়ে দেখি, লাশগুলো মুক্তার মতো ঝলমল করছে।

লাশগুলো এত গাদাগাদী অবস্থায় পড়ে আছে যে, কোন্টা কার লাশ, তা শনাক্ত করা মুশকিল। অনেকগুলো লাশ ব্রাশফায়ারে ক্ষতবিক্ষত। একা একা টানাটানি করে আব্বুর লাশ উদ্ধার করা অসম্ভব। তাই লাশগুলো সামনে নিয়ে জানাযা পড়ে নিজেকে ধন্য মনে করলাম। আব্বুর জন্য হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসল- "আব্বু.. ও আমার আব্বু! তোমার পাগল ছেলে তোমার খোঁজে এসেছে।" আহ! কেউ আমার ডাকে সাড়া দিল না। তিনি আর ধূলির ধরায় নেই।

রাত বেশী নেই। আমার অরণ্যে রোদন কে শুনবে? কিছুক্ষণ পরই ভোরের রবি সমস্ত আঁধার নাশিয়ে পূর্বাকাশ রাঙ্গিয়ে উদিত হবে। সেনাবাহিনী আবার আসতে পারে। কোন্ বিপদ ঘটে যায় কে জানে। তাই এ স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র যাওয়ার চিন্তা করছি।

হঠাৎ শুনতে পেলাম উত্তরের দেয়াল ঘেঁষে লাশের স্তূপের ভেতর থেকে ক্ষীণস্বরে কে যেন 'আল্লাহ আল্লাহ' যিকির করছে। আমি অত্যন্ত কৌতূহলে ভয়ে ভয়ে প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম লাশের স্তূপের পাশ দিয়ে। অনেক কষ্ট করে বেশক'টি লাশ টেনে সরালাম। তারপর আরো একটি লাশ সরানোর চেষ্টা করলে একটু ঝাঁকুনি লাগল। আমি বুঝতে পারলাম, এ লোকটি গুরুতর আহত এবং জীবিত। আমি তাকে কক্ষের বাইরে নিয়ে এলাম। হাত-পায়ের বন্ধন খুলে দিলাম। তারপর একটু নড়াচড়া করতেই উহ্ আহ্ শব্দ করল। আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ভাই, তুমি ভয় পেয়ো না, আমি তোমার উদ্ধারকারী, তোমাকে মুক্ত করতে এসেছি। এখন আর তোমার কোন ভয় নেই। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই, তোমার শরীরে কোন গুলী লেগেছে

কি? সে মাথা নেড়ে জানান, কোন গুলী তাকে আঘাত করেনি।

দু'তিন দিনের অনাহারে লোকটির শরীর দুর্বল। আমি কিসমিস আর পানি বের করে দিলাম। লোকটি বেশ কয়েক মুঠো কিসমিস খেয়ে পানি পান করল। আমি তাকে আরো একটু দূরে নিয়ে গেলাম। একটি বৃক্ষের নীচে বসিয়ে অভয় দিলাম। এখন সে অনেকটা শান্ত ও সুস্থ। একটু একটু করে হাঁটতে সক্ষম। লোকটি আমাকে খুব দোআ করতে লাগল এবং আল্লাহর প্রশংসা করল।

লোকটি মৃদু স্বরে বলল, "ভাই, আপনাকে আরো একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করি মনে দুঃখ নেবেন না। কাজটি হল, ওখানে দরজার নিকট দু'টি সৈন্যের লাশ পড়ে আছে। তাদের নিকট রয়েছে অত্যাধুনিক দু'টি হাতিয়ার ও গোলা-বারূদ। রয়েছে গ্রেনেড, মাইন, পিটু, বেল্ট, জুতা, লাইনার, বাঁশি ও জামা-কাপড়। ওসব মালামাল এক্ষুণি নিয়ে আসুন। এগুলো আমাদের অনেক কাজে লাগবে।”

আমি লোকটির কথায় এগিয়ে গেলাম। তারপর সমস্ত মালামাল নিয়ে এলাম। খুলে নিয়ে এলাম লাশ দু'টোর পরনের কাপড়-চোপড়ও। লোকটি বলল, "ভাইজান এখানে দেরী করা বিপজ্জনক। ভোর হয়ে গেছে। চলুন, অন্ধকার কাটার আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই।"

কোথায় যাব? কোথায় নিরাপদ আশ্রয় পাব, তা নিয়ে দু'জন শলা- পরামর্শ করলাম। লোকটি বলল, "এ অবস্থায় লোকালয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। চলুন, আমরা গভীর অরণ্যে আশ্রয় নেই। বনের হিংস্র জানোয়াররা আমাদের শত্রু নয়, আমাদের শত্রু হল আশরাফুল মাখলুকাত- মানুষ।" আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলাম।

তিনি আমাকে আরো জানালেন, "ভাইজান! আপনি আমাকে সুনিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন, আল্লাহ আপনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমি আমার বংশে একা। পরিবার-পরিজনকে কমিউনিস্ট হায়েনারা শহীদ করে দিয়েছে। বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার সংসারে আর কেউ জীবিত নেই। দুনিয়াতে থাকতে হলে দ্বীন নিয়ে, ইসলাম নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। অন্যথায় আল্লাহর দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করতে চাই। আমি দেশে ফিরে যেতে চাই না।"
কি? সে মাথা নেড়ে জানান, কোন গুলী তাকে আঘাত করেনি।

দু'তিন দিনের অনাহারে লোকটির শরীর দুর্বল। আমি কিসমিস আর পানি বের করে দিলাম। লোকটি বেশ কয়েক মুঠো কিসমিস খেয়ে পানি পান করল। আমি তাকে আরো একটু দূরে নিয়ে গেলাম। একটি বৃক্ষের নীচে বসিয়ে অভয় দিলাম। এখন সে অনেকটা শান্ত ও সুস্থ। একটু একটু করে হাঁটতে সক্ষম। লোকটি আমাকে খুব দোআ করতে লাগল এবং আল্লাহর প্রশংসা করল।

বাংলাদেশি যুবক ও এক রোহিঙ্গা তরুনীকে নিয়ে লেখা "আমিরুল মোমেনিন মানিক" দারুন এক উপন্যাস লিখেছে পড়ে দেখুন ভালো লাগবেই। ৪ টি ছোট ছোট পর্বে সমাপ্ত হয়েছে।



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-১



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-২



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৩



▶️ রোহিঙ্গা তরুনী পর্ব-৪


🌹 ধন্যবাদ 🌹


লোকটি মৃদু স্বরে বলল, "ভাই, আপনাকে আরো একটু কষ্ট করতে হবে। আশা করি মনে দুঃখ নেবেন না। কাজটি হল, ওখানে দরজার নিকট দু'টি সৈন্যের লাশ পড়ে আছে। তাদের নিকট রয়েছে অত্যাধুনিক দু'টি হাতিয়ার ও গোলা-বারূদ। রয়েছে গ্রেনেড, মাইন, পিটু, বেল্ট, জুতা, লাইনার, বাঁশি ও জামা-কাপড়। ওসব মালামাল এক্ষুণি নিয়ে আসুন। এগুলো আমাদের অনেক কাজে লাগবে।”

আমি লোকটির কথায় এগিয়ে গেলাম। তারপর সমস্ত মালামাল নিয়ে এলাম। খুলে নিয়ে এলাম লাশ দু'টোর পরনের কাপড়-চোপড়ও। লোকটি বলল, "ভাইজান এখানে দেরী করা বিপজ্জনক। ভোর হয়ে গেছে। চলুন, অন্ধকার কাটার আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাই।"

কোথায় যাব? কোথায় নিরাপদ আশ্রয় পাব, তা নিয়ে দু'জন শলা- পরামর্শ করলাম। লোকটি বলল, "এ অবস্থায় লোকালয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। চলুন, আমরা গভীর অরণ্যে আশ্রয় নেই। বনের হিংস্র জানোয়াররা আমাদের শত্রু নয়, আমাদের শত্রু হল আশরাফুল মাখলুকাত- মানুষ।" আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জ্ঞাপন করলাম।

তিনি আমাকে আরো জানালেন, "ভাইজান! আপনি আমাকে সুনিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন, আল্লাহ আপনাকে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমি আমার বংশে একা। পরিবার-পরিজনকে কমিউনিস্ট হায়েনারা শহীদ করে দিয়েছে। বাড়ীঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার সংসারে আর কেউ জীবিত নেই। দুনিয়াতে থাকতে হলে দ্বীন নিয়ে, ইসলাম নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। অন্যথায় আল্লাহর দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করতে চাই। আমি দেশে ফিরে যেতে চাই না।"

নিকটে গেলাম। গিয়ে দেখি, এ তো মানুষ নয়, পুরুষও নয়। এ যেন জান্নাত থেকে পালিয়ে আসা হুর। বৃক্ষের ফাঁক দিয়ে সূর্যের কিরণ এসে তার চেহারায় পড়েছে। এতে যেন তার চেহারার কমনীয়তা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ও যেন একটি ফুটন্ত কুসুম। কাল কেশদাম কটিদেশ পর্যন্ত বিছিয়ে রয়েছে। নাসিকাটা যেন কোন সুদক্ষ কারিগর নিপুণ হাতে তৈরী করেছে। আঁখিযুগল যেন বনের চঞ্চলা হরিণী থেকে চুরি করে সংগ্রহ করেছে। আঙ্গুলের মাথাগুলো যেন আঙ্গুরের থোকা। সুঠাম গড়ন, উন্নত বক্ষদেশ। এ যেন ইউসুফের জুলায়খা, মজনুর লায়লা, ফরহাদের শিরী।

দীর্ঘক্ষণ অপলক নেত্রে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি ভাবনার সাগরে হারিয়ে গেলাম। লাবণ্যময় চেহারাটা যেন চেনা চেনা মনে হয়। সে যেন আমার খুব কাছের মানুষ। আসলে কিন্তু পুরোটা চিনতে পারছি না। না, আসলে সে মানুষ নয়, মানবরূপী ফেরেশতা, না হয় রূপসী পরী। এখানে কেন তার আগমন? কে নিয়ে এল ওকে বেহেশতের দুয়ার খুলে?

এই তরুণীকে দেখলে মহান আল্লাহর কথা স্মরণ হয়, যিনি তাকে এত সুষমামণ্ডিত করে সৃষ্টি করেছেন, তিনি কত সুন্দর! যার সৃষ্টি এত মনভোলা, মনোলোভা, এত সুন্দর; তার সৌন্দর্যের কি তুলনা হয়! পার্শ্বে বসে আমি এসব চিন্তায় বিভোর। হঠাৎ পার্শ্ব পরিবর্তন করে সে বামদিক থেকে ডানদিক ঘুরল। এমন সময় ডাগর দু'টি আঁখি খুলে সে আমার দিকে তাকাল। তাকিয়েই চিৎকার করে বলে উঠল, "ইয়া.. তুমি খোবায়েব জামবুলী! খোবায়েব ভাইয়া! তুমি যে এখানে? কোথেকে এলে এ বিজন বনে? তুমি কি মুক্তির পয়গাম নিয়ে এসেছ? তুমি কি তোমার অসহায়া বোনটিকে জালিমের হাত থেকে মুক্ত করতে ছুটে এসেছ? আল্লাহ কি তোমাকে প্রেরণ করেছেন মুসলিম জাতিকে উদ্ধার করতে? তুমি এসেছ দ্বীনকে রক্ষা করতে? বললে না ভাইয়া, তুমি কোথা

থেকে এলে?"

এবার আমি সুন্দরীকে আবিষ্কার করেছি, সে যে আমার হেফজ জীবনের সাথী। দু'তিন বছর আমরা একই সাথে আলমাআতা জামেউল উলুমে হেফজ বভাগে পড়াশোনা করেছি। নাম ছায়েমা মালাকানী। নাজেরার বছর ওদের বাসায় জায়গীর ছিলাম। ওর আব্বা

একজন দ্বীনদার, পরহেজগার লোক। বড় আলেম না হলেও শরীয়তের জরুরী মাসআলা-মাসায়েলে খুবই পাকা ছিলেন। গ্রামের একটি মসজিদের ইমাম ছিলেন তিনি। ছায়েমা আমার চেয়ে বয়সে দু'এক বছরের ছোট হবে। বর্তমানে আমার বয়স আঠার। ছায়েমার ষোল কি সতের হবে। ওর সাথে দেখা নেই প্রায় দশ-এগার বছর হবে। তাই প্রথমে চিনতে একটু কষ্ট হয়েছে। সে তার আব্বা-আম্মা ও ভাই- বোনের শাহাদাতের করুণ কাহিনী আমাকে শুনাল। আমিও তাকে আব্বুর মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক শাহাদাতের খবর, দেশের অবস্থা এবং নিজের ইতিহাস শুনালাম।



[সাত]

ছায়েমা মালাকানী আমাকে অনুনয়-বিনয় করে বলতে লাগল, "ভাই খোবায়েব! তুমি আমাকে একা ছেড়ে কোথাও চলে যেও না। আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তুমিই তো আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে কেড়ে এনেছ। আমার দুনিয়াতে আর কোন আশা বাকি নেই। দুনিয়ার সব আশা-আকাঙ্খা স্বপ্ন-সাধ আমার ধুলায় মিশে গেছে। এখন ইসলামের জন্য জিহাদ করেই জীবনের যবনিকা টানতে চাই। তাই শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করে রক্তমাখা ভূষণে আল্লাহর সমীপে হাজির হতে। আমি চাই, আমার তাজা খুনে ইসলামের কালেমাখচিত ঝাণ্ডা তামাম জাহানে উড্ডীন করতে। আমি চাই, হযরত ছুমাইয়া (রাঃ)-এর মত শাহাদাতবরণ করতে। আমি চাই, ইসলামের দুশমনদের দুনিয়ার বুক থেকে জাহান্নামে নির্বাসন দিতে। তামাম তাগুতি শক্তিকে পদানত করে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে। আমি চাই, গোটা মুসলিম বিশ্বের বিজয় ছিনিয়ে এনে মজলুম মানবতার মুক্তি দিতে। নির্যাতিত- নিপীড়িত মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে। আমি চাই, এতিম, বিধবা, পঙ্গু, অনাথ-অনাথিনীর মলিন মুখে হাসি ফুটাতে। আমি চাই, কাফির- বেঈমানদের বন্দীশালার লৌহ কপাট চূর্ণ করে সকল বন্দী-বন্দীনীকে উদ্ধার করে তাদের স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দিতে। আমি চাই, সন্তানহারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদের পরিবর্তে আনন্দের হাসি দেখতে। আমি চাই, দুঃখী ও অসহায় মানুষের চোখের পানি মুছে সান্ত্বনার বাণী শোনাতে।"

বীরাঙ্গনা ছায়েমা মালাকানী তেজোদীপ্ত কণ্ঠে তার অভিপ্রায়গুলো

দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বর্ণনা করছিল। আমি তার বর্ণনাভঙ্গি ও ঈমানী জযবা

দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। মনে হল, আমি নবজীবনের সন্ধান পেয়েছি।

আমার চিরঘুমন্ত প্রাণে সাড়া জাগিয়েছে ছায়েমা। সুপ্ত ঈমানে শাণ

দেয়ার মতো অসাধারণ যোগ্যতা তার মাঝে লুকিয়ে আছে, যা কোনদিন

ভাবতেও পারিনি। ওর কথাগুলো সত্যিই যাদু-মন্ত্রের ন্যায় চমকপ্রদ।

এমন সাহস দানকারী তরুণী সমাজে খুঁজে পাওয়া এতো সহজ নয়।

তার জ্ঞান-গরিমা ও বুদ্ধির প্রখরতা দেখে আমি বিস্মিত।

আমি ভাবছিলাম, এ কি সেই ছায়েমা, যার সাথে আমি শৈশবে খেলা করেছি! একি সেই খুকী, যার সাথে দু'তিনটি বছর পবিত্র কুরআন শরীফ হেফজ করেছি! যার সাথে প্রায়ই ছবক নিয়ে প্রতিযোগিতা হত। একি সেই ছায়েমা, যে সুরেলা কণ্ঠে হামদ, নাত, তারানা, গজল, কাছিদা, কবিতা আবৃত্তি ও ক্বেরাত পাঠ করে প্রথম প্রাইজগুলো নিয়ে নিত। যার সুর লহরীতে ভাবুক নিজেকে হারিয়ে ফেলত, সে কি আজ জিহাদের দুর্গম পথে, খুনরাঙ্গা পিচ্ছিল পথে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে বজ্রশপথ নিয়েছে? এই কিশোরীর জিহাদের স্পৃহার কথা শুনে বিস্মিত হবে না, এমন কে আছে!

এসব চিন্তা করতে করতে উঁচু বৃক্ষের মাথার উপরের সূর্যটা কখন যে ঢলে পড়েছে, তা টেরও পাইনি। হঠাৎ ছায়েমা আমাকে বলল, "ভাইয়া! যোহরের সময় হয়ে গেছে; গোছল সেরে নামায পড়ে নিন। আমি গোছলের জন্য নদীতে চলে গেলাম।

গোছল সেরে কাপড় পাল্টিয়ে দু'চার কদম সামনে অগ্রসর হতেই আমার শরীর শিউরে উঠল। চেয়ে দেখি, একটু দূরে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এক সৈনিক আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি প্রায় সংজ্ঞাহীন, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জীবন নিয়ে পালাতে পারলেই বাঁচি। তাই জীবন বাজি রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে দিলাম এক দৌড়।

হঠাৎ ছায়েমার কোমল কণ্ঠস্বর ভেসে আসল আমার কানে, "খোবায়েব ভাইয়া! খোবায়েব ভাইয়া! তুমি কোথায় যাচ্ছ? কোথায় যাচ্ছ তুমি আমাকে একা ফেলে এ বিজন বনে? অমন করে পালাচ্ছ কেন? ফিরে আস। আমায় একা ফেলে যেও না!" আমি ভয়ে ভয়ে একবার

ঘাড় ফিরিয়ে চেয়ে দেখি, সৈন্যটি আমাকে অনুসরণ করছে। আমার দিকে দৌড়িয়ে আসছে। আমি আরো জোরে পাগলা ঘোড়ার মত প্রাণপণে ছুটছি। ঘন জঙ্গলের অন্তপুরে এক ঝোপের অভ্যন্তরে মিছামাছি আশ্রয় নিয়েছি। কর্মকারের তাদানির মত আমার পেট উঠানামা করছে। আর নাসিকার ছিদ্র পথে হাজার মাইল বেগে নিশ্বাস বেরিয়ে আসছে। কেউ দেখলে হয়ত মনে করত সাইমুম আরম্ভ হয়েছে। হাত-পা অবশ, মাথা ঘুরছে, ছাতি কাঁপছে, ঠোঁট শুকিয়ে গেছে। তবুও আল্লাহর শুকরিয়া, অল্পতে বেঁচে গেছি। মনে মনে ভাবছি, এতদূর হয়ত ধাওয়া করবে না। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ল, আমার অসহায়া বোন হাফেযা ছায়েমা মালাকানির কথা।

হায়! দুমশনের হাত থেকে ছিনিয়ে এনে মেয়েটাকে আবার বুঝি হায়েনার মুখের কাছে ছেড়ে এসেছি। হে আল্লাহ! তুমি আমায় ক্ষমা কর। ছায়েমা আমার অবলা-অসহায় মজলুম বোন। তুমি ছায়েমাকে হেফাযত কর। আমি তোমার কুদরতি হাতে তাকে সোপর্দ করলাম। তুমি আমাকে হেফাজত কর।

একটু পরেই শুকনো পাতার মর্মরধ্বনি কানে আসল। শরীর শিউরে উঠল। আবর ছাতি কাঁপা আরম্ভ হল। তাহলে কি সৈন্যটি আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে? নড়াচড়া বিলকুল বন্ধ। হঠাৎ দেখি, রণসাজে সুসজ্জিত হয়ে সেনা জওয়ানটি ক্ষণে ক্ষণে বৃক্ষের উপরিভাগে তাকাচ্ছে, আবার বসে বসে নীচে কি যেন খুঁজছে। আমাকেই যে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি ভয়ে ভয়ে উচ্চারণ করতে লাগলাম- 'অজাআলনা বাইনা আইদীহিম ছাদ্দাও অমিন খালফিহিম ছাদ্দান ফাআগশাইনাহুম ফাহুম লা ইবছিরুন। আল্লাহুম মাকফিনাহু বিমা শিতা, আল্লাহুম্মা ইন্না নাজআলুকা ফী নুহুরিহিম, অনাউযুবিকা মিন সুরুরিহিম।'

পেছনে চেয়ে দেখি গ্রীবা নেড়ে নেড়ে এক অভিনব ভঙ্গিতে এক সৈনিক ফিল্ড মার্শালের মতো, বীর বাহাদুর জেনারেলের মত ঘুরে ঘুরে আমাকে তালাশ করছে। এবার আর রক্ষা নেই। এবার একদম নিকটে। আমি চোখ বুজে মৃত লাশের মতো পড়ে আছি। চেয়ে দেখি বসে বসে সে তালাশ করছে।

হঠাৎ সে আমাকে আবিষ্কার করে ফেলল। তাই অট্টহাসিতে বন- বাদার মাঠঘাট মুখরিত করে তুলছে। হায় আল্লাহ! ও যে বীরঙ্গনা ছায়েমা! ছায়েমা আমার অবস্থা দেখে হেসে কুটপাট। সে ভর্ৎসনা করে বলছিল, "আ-হা-রে আমার বীর পুরুষ! আলেয়ার প্রদীপ দেখে আগুন লাগছে, আগুন লাগছে বলে হৈচৈ জুড়ে দিয়েছ। মনে হয় যেন সিংহ সাদৃশ শিকারী বিড়াল।"

ওর কথাগুলো আমাকে লজ্জিত করে দিল। কিন্তু জবাব দেয়ার কোন ভাষা আমার অভিধানে মওজুদ ছিল না। ওর কাছে সত্যিই আমি পরাজিত। ওর বিচক্ষণতা ও বুদ্ধির প্রখরতা দেখে আমি অবাক। সে যে একজন সুন্দরী তরুণী, তা টের পাবে এমন কে আছে? ছায়েমা দু'ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা টেনে বলল, "বাহাদুর ভাই! এবার ইঁদুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে আসুন, চলুন নামায আদায় করে নেই, সময় যে বয়ে যাচ্ছে।"

আমি ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে ছায়েমার অনুসরণ করলাম। রাস্তা যেন শেষ হচ্ছে না। এতদূর চলে এসেছি তা ভাবতেও পারিনি। আধা ঘন্টা পর পূর্বের স্থানে ফিরে এলাম। অযু করে নামায পড়ে নিলাম। ছায়েমাও তার নির্বাচিত বৃক্ষের আড়ালে গিয়ে নামায আদায় করল। পেটে ক্ষুধার অনল দাউ দাউ করে জ্বলছে। খাবার অর্তি সামান্য- কয়টি খেজুর আর দু'মুঠো কিসমিস। দু'জন মিলে ওগুলো খেয়ে বাকি উদর পূর্ণ করলাম নদীর পানি পান করে।

ছায়েমা আমার পাশে বসে জীবনের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় জানতে চাইলে এক এক করে সব বলতে লাগলাম। কথার ফাঁকে লজ্জার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ছায়েমা! আমরা তো দু'টো অস্ত্র পেলাম, পেলাম গোলা-বারূদ, গ্রেনেড ও ডিনামাইট। কিন্তু ব্যবহার কিভাবে করতে হয়, তা তো জানিনা। কি করে ব্যবহার করব বল তো বোন? ছায়েমা চোখ দু'টি কপালে তুলে মুখ বাঁকা করে বলল, "তুমি আবার কেমন পুরুষ? তুমি নাকি কাফির-বেঈমান আর মুর্তাদদের সাথে যুদ্ধ করার শপথ নিয়েছ?

 অথচ অস্ত্র চালনা শিখনি! তবে কিসের মুজাহিদ তুমি? পবিত্র কুরআন শরীফে কি আল্লাহ বলে দেননি যে, "আর প্রস্তুত কর তাদের সাথে যুদ্ধের জন্য যা কিছু সংগ্রহ করতে পার নিজের শক্তি- সামর্থের মধ্য থেকে এবং পালিত ঘোড়া থেকে, যেন প্রভাব পড়ে আল্লাহর শত্রুদের উপর এবং তোমাদের শত্রুদের উপর, আর তাদেরকে ছাড়া অন্যদের উপর, যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে চিনেন। বস্তুত আর যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে আল্লাহর রাহে, তা তোমরা পরিপূর্ণভাবে ফিরে পাবে এবং তোমাদের কোন হক অপূর্ণ থাকবে না।" (সূরা আনফালঃ আয়াত নম্বর ৬০)

কেউ সুন্নত তরক করলে তাকে ফাসেক ফতোয়া দেয়া হয়। অথচ ফরয তরক করলে ফাসেক বলা হয় না। আজকাল তো দেখা যায়, ইমাম সাহেবও অস্ত্র চালাতে জানেন না। মাওলানা, মুহাদ্দেস, মুফতী, পীর-মাশায়েখ এবং সাধারণ মুসলমানগণ যুদ্ধের কলাকৌশল শিখেননি। এ যে একটি ফরয তরক করা হচ্ছে, এর জন্য কোন আফসোস বা অনুশোচনা নেই। গুনাহকে যদি কেউ গুনাহ মনে না করে, তবে তওবা নসিব হয় না। নাউযুবিল্লাহ!

শুনেছি বুখারা-তাসখন্দের অনেক বড় বড় মাদ্রাসার ছাত্ররা গোপনে গোপনে আনোয়ার পাশাার নিকট জিহাদী তরবিয়ত নিয়ে তৈরি হচ্ছে। জিহাদের ফান্ডে চাঁদা দিচ্ছে। আর সে কারণে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ নাকি তাদেরকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দিচ্ছে। খানা বন্ধ করে দিচ্ছে, নাম লিস্ট করে লাল ফৌজদের নিকট ধরিয়ে দিচ্ছে। আহ! কি করুণ ইতিহাস! যারা আল্লাহর ফরয হুকুম পালন করার জন্য যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে, তাদের সাথে এ ধরনের ব্যবহার করা হচ্ছে! সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লিস্ট হচ্ছে। তাদের অপরাধ, তারা কাফের, বেঈমান, নাস্তিক, মুরতাদ ও জিন্দিকদের সাথে যুদ্ধ করে।

বায়ু বের হলে ওযু ভঙ্গ হয় বিধায় পুনঃ অজু করতে হয়। এ মাসআলা শিখে যদি কোন ছাত্র আমল না করে, অর্থাৎ বায়ু নির্গত হওয়ার পর অযু না করে কোন ছাত্র যদি নামায আদায় করে, আর যদি ওস্তাদগণ জানতে পারেন, তবে কঠোর শাস্তি প্রদান করেন। দুঃখের বিষয়, অসংখ্য জিহাদের আয়াত ও হাদীস অধ্যয়ন করে যদি কেউ জিহাদ না করে, তবে ওস্তাদগণ তাকে শাসন করেন না। পবিত্র জিহাদ তরক করার কারণে আজ তাসখন্দ, সমরকন্দ, বোখারা, তাজাকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কিস্তানসহ আরো অনেক ভূখণ্ডে চলছে মুসলিম নিধনের মহড়া। বন্ধ করে দিচ্ছে মসজিদ, মাদ্রাসা, গীর্জা ও মন্দির। 

কোন ধর্মের প্রতি কমিউনিস্টরা শ্রদ্ধাশীল নয়। ইসলামের কর্ণধার ওলামায়ে কেরাম জিহাদকে নির্বাসন দিয়েছেন। তাই দ্বীনের ধারক-বাহক ওলামা- তালাবাদের উপরই আসছে আযাব। নবী জামানায় এক লক্ষ বা সোয়া লক্ষ ছাহাবা ছিলেন। তাদের মধ্যে জিহাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি বা জিহাদ করেননি, এমন একজন ছাহাবার নাম কুরআন-হাদীসে পাওয়া যায় না।

সাইয়েদুল মুরসালীন রাহমাতুল্লিল আলামীন খাতামুন নাবিয়‍্যীন আমীরুল মুজাহেদীন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) জীবদ্দশায় সাতাশটি জিহাদের ফিল্ড মার্শাল হিসেবে স্বশরীরে দায়িত্ব পালন করেছেন। এসব ঘটনা কি আমাদের নিকট আদর্শ নয়? দুনিয়ার ইতিহাসে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বড় সমরবিদ। নবীয়ে দুজাহা (সাঃ) মসজিদে নববীর মধ্যে শুধু নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাতের নসিহতই করেনি, জিহাদের অনুশীলনও করেছেন। আম্মা আয়েশা সিদ্দীকা (রাঃ) কে নিয়ে মহানবী প্রাণভরে জিহাদের অনুশীলন অবলোকন করেছেন। উম্মত আজ এমন গুরুত্বপূর্ণ ফরয আমলকে ভুলতে বসেছে।

ছায়েমার জবান থেকে এমন জ্ঞানগর্ভ আলোচনা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সে আরো বলল, "খোবায়েব ভাই! শুনুন, সেদিন আমাদের মহল্লায় কমিউনিস্ট হায়েনারা প্রবেশ করে একের পর এক ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে দিয়েছে। বন্দী করেছে শতাধিক নারী-পুরুষ। এর মধ্যে আলেম ও তালেব এলেমের সংখ্যা বেশী। কমিউনিজম গ্রহণ না করাই হল তাদের অপরাধ। বন্দীদের মধ্যে আমিও একজন। আমাদেরকে নিয়ে এল সেনা ছাউনীতে। গ্রেফতারের সাথে সাথে আমি আমাকে মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সোপর্দ করে দিলাম। ইজ্জত- আব্রুর হেফাজতের জন্য খুব বেশি দোআ করলাম। হায়েনারা আমাদেরকে সেনা ছাউনীতে এনে বেদম প্রহার আরম্ভ করল। নারী- পুরুষের বুকফাটা চিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে উঠছিল। এক পর্যায়ে যুবতীদের বিবস্ত্র করে পিতা-মাতার সামনে গণধর্ষণ করতে লাগল। উহ! কি করুণ ঘটনা। আলেমদের দাড়ি কেটে দিগম্বর করে প্রহার

করছে। বেশ ক'জন সাথে সাথে শহীদ হয়ে জান্নাতবাসী হয়েছেন। 

তারা আমাদেরকে তিনদিন সেনা ছাউনীতে রাখে। তারপর ভেড়ার পালের মত এ বিজন পরিত্যক্ত ভবনে নিয়ে এল। আমার সামনে অনেককেই শহীদ করা হল। আমি আমার উড়নীতে চেহারা ঢেকে সব দেখেছি। ওরা কিভাবে অস্ত্র খোলে, কিভাবে ফিট করে, ম্যাগজিন খোলা-লাগানো, গুলী ভরা, ফায়ার করলে গুলী কেন আটকে যায়- এসব বিষয় খুব ভালভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। আশা করি আমি অস্ত্র চালাতে পারব, কোন অসুবিধা হবে না। অস্ত্র মোছা, তেল লাগান, পার্টসে পার্টসে খোলা ও ফিট করা আমার জন্য কোন ব্যাপার নয়। থ্রি- নট-থ্রি, স্টেনগান, মেশিনগান, শর্টগান, ক্লাশিনকভ, একে-৪৭ রাইফেল, এসএলআর, এসএমজি, এমজি, রকেটলাঞ্চার ইত্যাদি অস্ত্র সম্পর্কে আমাকে কারো নিকট জিজ্ঞেস করতে হবে না। তাছাড়া গ্রেনেড নিক্ষেপ কিভাবে করতে হয়, তাও দেখেছি। তবে ডিনামাইট ও মাইন ফাটান শিখতে পারিনি।"

ছায়েমা যখন অস্ত্রের নামগুলো ফর ফর করে বলছিল, তখন আমি ওর মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ছায়েমা এসএলআরটি হাতে নিয়ে তা খুলল এবং লাগিয়ে দেখাল। কিভাবে ফায়ার করতে হয়, কিভাবে নিশানা ঠিক করতে হয়, এসব আমাকে শেখাল। আমিও তার সামনে বারবার খুলেছি ও ফিট করেছি। তবে প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হচ্ছিল। তারপর সবই ঠিক হয়ে যায়। এগুলো শেখার পর সাহসে-আনন্দে বুক ভরে গেল, যা জীবনে কোন দিন পাইনি। আমি আল্লাহর শোকর আদায় করতে লাগলাম।

[আট]

আমি অল্পক্ষণেই সায়েমার কাছ থেকে অস্ত্র চালানোর সব কলাকৌশল শিখে নিলাম। এখন একটা ফায়ার করে অভিজ্ঞতা যাচাই করতে মনে বিরাট কৌতূহল জাগল। তাই কাকিং হেন্ডেল টেনে স্টিগারে শাহাদাত অঙ্গুলী বাড়িয়ে দিয়ে একটি টান দেব। ছায়েমা আমার অভিপ্রায় বুঝতে পেরে চোখের পলকে লক্ টেনে আমার হাত চেপে ধরল এবং বলল, "খোবায়েব ভাইয়া! তুমি একি করছ? তুমি বোকা নাকি। দু'তিন কিলোমিটার দূরে সেনা ছাউনী। ফায়ারের শব্দ শোনা মাত্র শকুনীর মত ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসবে সেনাবাহিনীর সৈন্যরা। গুলী বৃষ্টিতে ঝড়ে যাবে বৃক্ষরাজির পত্রপল্লব।"

আমি ছায়েমার কথায় অবুঝ মনকে কিছুতেই প্রবোধ মানাতে পারলাম না। তাই লক্ পেছনে টেনে শাহাদাত অঙ্গুলী সামান্য টান দিতেই বিকট আওয়াজে বেরেল দিয়ে বেরিয়ে গেল একটি গুলী। বন্য পশু-পাখি গুলীর শব্দে হুমড়ি খেয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি আরম্ভ করল। আমিও আনন্দে আত্মহারা।

বুদ্ধিমতী ছায়েমা আমাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, "ভাইজান! যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আর মিছামিছি চিন্তা করে লাভ নেই। চলুন, আমরা অতি তাড়াতাড়ি এ স্থান ত্যাগ করি। অন্যথায় আমাদেরকে লাল বাহিনীর হিংস্র থাবায় পড়তে হবে।"

আমি ছায়েমার কথামত ছামানা গুছিয়ে তার পদাংক অনুসরণ করলাম। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর গিয়ে একটি নীচু জায়গায় বিরতির রেখা টানলাম। একদিকে প্রবাহিত হচ্ছে খরস্রোতা নদী। অপরদিকে রয়েছে বিশাল পাহাড়। তারই মাঝখানে আশ্রয়ের উপযুক্ত জায়গা বেছে নিলাম। এখানে দুশমন এত সহজে আক্রমণ করতে আসবে না। যদিওবা আসে, তবে জীবন নিয়ে পালাবার সময়টুকু তাদের ভাগ্যে জুটবে না। এখন আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত। তাই দু'জনে বসে জীবনের সব কিচ্ছা-কাহিনী আর গল্প-গুজব করছি। একজনে বলি আর অপরজন শুনি, পালাক্রমে চলছে আমাদের গল্প-গুজব।

এমনই এক আনন্দঘন মুহূর্তে হঠাৎ দেখলাম, ডজনখানেক সৈন্য খুব সতর্কতার সাথে নদীর কূল ঘেঁষে আমাদের দিকে আসছে আর এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখার সাথে সাথে ছায়েমা হাতে অস্ত্র তুলে নিল। আমিও তাকে অনুসরণ করলাম। ছায়েমা তিমছা হালতে (কুমিরের মত) ফায়ার পজিশনে চলে গেল। আমিও তাই করলাম। এতক্ষণে দুমশন আমাদের রেঞ্জের ভেতরে এসে গেল। ছায়েমা একযোগে ফায়ার করার ইঙ্গিত দিল। আমরা দু'জনে 'অমা রামাইতা ইয রামাইতা অলা-কিন্নাল্লাহা রামা' বলে ট্রিগার টেনে ধরলাম। মুহূর্তে গর্জে উঠল এসএলআর। চোখের পলকে এক ঝাঁক গুলী কেড়ে নিল বারজন বেঈমান লাল সেনাদের জান। ঝাঁঝরা করে দিল হায়েনাদের বক্ষদেশ। লুটিয়ে পড়ল ধরাতলে। আমরা আনন্দে আত্মহারা। আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করতে করতে সেজদায় লুটিয়ে পড়লাম।

ছায়েমা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল গনীমত কুড়ানোর জন্য। গনীমত হিসেবে আমাদের হস্তগত হল তিনটি রাইফেল, চারটি স্টেনগান, দু'টি ক্লাশিনকভ, একটি এসএলআর, দু'টি এলএমজিও পাঁচটি গ্রেনেড। ম্যাগজিন ষাটটি, গুলীর বাক্স বারটি, পানির বোতল বারটি, হাতঘড়ি সাতটি, চিনি-মিশ্রিত ভুট্টার ছাতু প্রায় পাঁচ কেজি, ডলার দু'হাজার তিনশ'। তাছাড়া কাপড়-চোপড়, বেল্ট, জুতা, লাইনার, টুপি ও হেলমেট- সব মিলে ওজন হবে প্রায় দুই মণ।

এসব মালামাল সামলানো আমাদের জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। তবু হেফাজত করতে হবে। দু'জনে মিলে অল্প অল্প করে মালগুলো বহুদূরে সরিয়ে নিয়ে গেলাম। তারপর আল্লাহর শুকর আদায় করতে লাগলাম। আল্লাহর দরবারে কাতর হয়ে প্রার্থনা করলাম, হে আল্লাহ! তোমার খাছ রহমতে নিরস্ত্র অসহায় বান্দা-বান্দীদের বিজয় দান করেছ। এ সহজ বিজয়ের আশা আমরা কোনদিন করিনি। এ বিজয় তোমার, এ বিজয় তোমার দ্বীনের। হে আল্লাহ! আমাদেরকে জিহাদের পথে তোমার মর্জি মতে পরিচালিত কর।

ছায়েমার বিচক্ষণতা, বুদ্ধিমত্তা, সাহসিকতা, দূরদর্শিতা, ভদ্রতা, মানবতা, উদারতা, সহিষ্ণুতা, লজ্জাশীলতা ও খোদাভীরুতা ছোটকাল থেকেই। অর্থাৎ, ছাত্রী জীবনেই তার চরিত্রে এসব গুণাবলী ফুটে উঠেছে। আমরা তো কোনদিন কল্পনাও করিনি, ছায়েমা একদিন হবে দেশপ্রেমিক-দ্বীনপ্রেমিক। সে যে হবে উম্মে জিয়াদ, উম্মে আম্মারা, বিবি খানছা ও ছুমাইয়ার স্থলাভিষিক্ত, তা কে জানত। কিন্তু ছাত্রী জীবনেই ছাত্র-শিক্ষক, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই তাকে আদর করত, ভালবাসত। এখন ছায়েমা ছোট্ট খুকী নয়, টলমল যৌবনের অধিকারিনী। তাকওয়া ও পরহেযগারী আগের তুলনায় অনেক গুণ বেড়ে গেছে তার। তাছাড়া এখন সে অনাথিনী, অসহায়িনী ও দুঃখিনী। একমাত্র আল্লাহর আশ্রয়ে দিনাতিপাত করছে। জিকির, তিলাওয়াত, ইবাদত-বন্দেগী, দোআ প্রার্থনা, তওবা ও শোকরগুজারিতে লিপ্ত থাকে প্রায় সময়। অলসতার ছোঁয়া তাকে সহজে কাবু করতে পারে না।

একজন মুজাহিদের মধ্যে কি কি গুণ থাকতে হয়, তা বর্ণনা করতে গিয়ে ছায়েমা বলল, "খোবায়েব ভাই! আমরা তো দ্বীনের

মুজাহিদ। আমাদের কি কি গুণ থাকা দরকার, তা আল্লাহপাক তার কালামে এভাবে বলেছেন-

"তারা তওবাকারী, এবাদতকারী, শোকরগোজার, দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্ছেদকারী, রুকু ও সিজদা আদায়কারী, সৎকাজে আদেশ দানকারী, মন্দ কাজ থেকে নিবৃত্তকারী এবং আল্লাহর দেয়া সীমানাসমূহের হেফাজতকারী। তুমি সুসংবাদ দাও ঈমানদারদেরকে।" (সূরা তওবা: আয়াত ১১২)

এসব নছিহত করতে করতে ছায়েমা একবার বলে উঠল, “ওহে বীর পুরুষ! পেটে তো ক্ষুধার আগুন জ্বলছে, কিছুই তো খাওনি। চল, গনীমতের ছাতু খেয়ে জঠর জ্বালা নিবারণ করি।"

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। সে তাড়াতাড়ি ছাতু ও পানি নিয়ে হাজির হল। আমরা কিছু ছাতু পানিতে ভিজিয়ে পেট পুরে খেয়ে নিলাম। তারপর ছায়েমা আমাকে পরামর্শ দিল, এ এলাকার কথা তো দুমশনরা জেনে ফেলেছে। তাই এখানে অবস্থান করা ঠিক হবে না। নদীর ওপারে আশ্রয় পাওয়া যায় কিনা তা অনুন্ধান করা খুব দরকার। দু'এক ঘন্টার মধ্যেই এখান থেকে চলে যেতে হবে। অন্যথায় কখন কোন্ বিপদ আসে তা বলা যায় না।

ছায়েমাকে মালের হেফাজতের দায়িত্বে রেখে আমি নদীর কূল ঘেঁষে হাঁটছিলাম আর নদী পার হওয়ার ফিকির করছিলাম। নদীটি যদিও তেমন প্রশস্ত নয়, কিন্তু বেশ গভীর ও খরস্রোতা। মালামাল নিয়ে সাঁতার কেটে পার হওয়া অসম্ভব। হাঙ্গর-কুমির যে নেই, এমনটি ধারণা করা যায় না। আমি এসব চিন্তা করছি আর আনমনে হাঁটছি। হঠাৎ চেয়ে দেখি, একটু দূরে একটি মাঝারি ধরনের জেলে নৌকা। মাঝি-মাল্লা মাত্র দু'জন। উভয়ের বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। কিন্তু বয়স যদিও পঞ্চাশের অধিক, কিন্তু সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী। বেশ শক্তিশালী বলে মনে হল। গালভরা সুন্নতী দাড়ি। মাছ শিকার করছে পেটের দায়ে। আমি দ্রুতপদে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখামাত্র ওরা ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। কারণ, আমার পরনে সৈনিকের পোশাক, পায়ে জঙ্গল-সু, কোমড়ে বেল্ট, মাথায় ক্যাপ, কাঁধে ক্লাসিনকভ। তাদের ধারণা, আমি লাল বাহিনীর জওয়ান, তাই

পালাতে চাচ্ছে। আমি বাঁশি বাজিয়ে তাদের ডাক দিলাম। ওরা নিরুপায় হয়ে নৌকা তটে ভিড়াল।

ওদেরকে মুসলমান মনে করে আমি সালাম দিলাম। উত্তর আসল, ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু। এবার বুঝতে পেরেছি ওরা মুসলমান। কিন্তু ওদের সংশয় দূর হল না। ওরা ভাবছে আমি কমিউনিষ্ট সৈন্য। আমি যথাসম্ভব অভয় দেয়ার চেষ্টা করি। তারপর নৌকায় উঠে আলাপ জুড়ে দিলাম। প্রথমে নিজের সামান্য পরিচয় দিয়ে আমি তাদের পরিচয়, পারিবারিক অবস্থা ও দেশের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চাইলাম। তাঁরা ভয়ে ভয়ে কিছু বলল। এখনো তাদের ভয় কাটেনি, তা বুঝতে পেরে আমার ইতিহাস কিছুটা বর্ণনা করলে তাদের চেহারায় সরলতার সুপ্ত আভা ফুটে উঠল।

তারা তাদের জীবন বৃত্তান্ত বলতে লাগল। মর্মান্তিক ইতিহাস। দু'জনই চাকুরী নিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে বিশ বছর আগে। মুসলমান হওয়ার অপরাধে চাকুরী হারিয়ে কোনরকম জীবন-ধারণের ক্ষীণ আশায় মাছ শিকারের পথ বেছে নিয়েছেন। খবিছ ও বাতিল লেনিনের সমাজতন্ত্র আন্দোলন যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, তখন পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধ, ইসলাম অনুরাগী ও ইসলামে বিশ্বাসী যাদেরকে বুঝতে পেরেছে, তাদেরকেই ছাঁটাই করেছে। কেউ স্বেচ্ছায় জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে। আবার অনেককে এক সারিতে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে। আবার অনেক সৈন্যদের ধরে সাইবেরিয়ায় প্রেরণ করেছে। অনেক মুসলিম সেনাবাহিনীর ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাদের অপরাধ শুধু এতটুকু যে, তারা ঈমানের পরিবর্তে সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেননি। নবীয়ে দু'জাহা (সাঃ)-এর পরিবর্তে লেনিন আর কালমার্কসকে নেতা হিসেবে মেনে নেননি।

দু'জনের একজন ছিলেন আর্টিলারী ডিভিশনাল প্রধান। নাম ইয়ার মোহাম্মদ গোভী। অপরজন হাবিলদার জাফর লুধী। উভয়ই ছিলেন আলমাআতার বাসিন্দা। মাছ শিকার করা অর্থাৎ জেলের কাজ বেছে নেয়ার কারণ, জানতে চাইলে হাবিলদার জাফর লুধী বললেন, "স্থলে বিচরণ করা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। কারণ, সবগুলো গোয়েন্দা

সংস্থা পাগলা কুকুরের মতো হন্যে হয়ে আমাদেরকে খুঁজছে। যদি একবার ধরতে পারে, তবে আর রক্ষা নেই। জ্যান্ত কবর দেবে আমাদেরকে। তাই নদীতে ভেসে বেড়ান এবং জেলের মত নিম্নমানের কাজ করাটাই আমাদের জন্য নিরাপদ মনে করি।" আমি আবার প্রশ্ন করলাম, স্যার! বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন রাস্তা আছে কি? উত্তরে ইয়ার মোহাম্মদ গোভী বললেন, "জিহাদ ছাড়া মুসলমানদের টিকে থাকার জন্য কোন পথ আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) বাতলিয়ে যাননি।" আমি আবার প্রশ্ন করলাম, স্যার, এদেশে কিভাবে কোন্ পদ্ধতিতে কার নেতৃত্বে জিহাদ করব? তিনি বললেন, "বাবা! তোমার প্রশ্ন খুবই জটিল।”

 তারপর একটু নীরবতা অবলম্বন করে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, "বাবা! সমাজতন্ত্রের প্রবক্তারা খুব সুকৌশলে সর্বস্তরে প্রবেশ করেছে। বিশেষ করে আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের ঐক্যকে চূর্ণ- বিচূর্ণ করে শতধা বিভক্ত করে দিয়েছে। এখন তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তা ও মতাদর্শ নিয়ে নিজ নিজ ব্যানারে কাজ করছেন। প্রত্যেকে নিজেকে একজন যুগ-সংস্কারক বা মুজাদ্দিদ হিসেবে মনে করছেন। তারা পরামর্শ করে এক প্লাটফরমে কাজ করতে আগ্রহী নন। মুসলমানদের ঐক্যের সেতুবন্ধন হল জিহাদের ময়দান। আজ তারা জিহাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবাদতকে ছেড়ে দিয়েছেন। পূর্ব যুগের ওলামাদের ইতিহাস তো ছিল গৌরবোজ্জ্বল। তারা দ্বীনের জন্য বুকের তাজা রক্তে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। 

তারা ছিলেন দ্বীনের ধারক- বাহক। তাদের হাতে শোভা পেত কালেমা-খচিত ইসলামের বিজয় নিশান। তাদের কটিদেশে ঝুলত শাণিত তরবারী। আজ ওলামায়ে কেরাম পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ভুলে গিয়ে কাঁদা ছোঁড়াছুঁড়ির খেলায় মেতে উঠেছেন। একে অপরের বিরুদ্ধে ফতোয়া প্রদান করে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। নিজেরা জিহাদ তরক করছেন। আর যারা জিহাদের ফরজিয়াত পালন করতে চান, তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া, লিফলেট, বিজ্ঞাপন, ইশতিহার ছাপিয়ে বিতরণ করছেন। তাছাড়াও সভা-সমিতি, সেমিনারে মুজাহিদদের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ও কাল্পনিক অপবাদ দিয়ে সরলমনা সাধারণ মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করছেন।" 

আমি প্রশ্ন করলাম, স্যার! আপনি কি আলেম? এ সব কোথেকে জানলেন? তিনি বললেন, "বাবা! আলেম বলে দাবী করতে সাহস পাই না, তবে কিছুদিন তাফসীর-হাদীস ও ফেকাহ শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি।" আমি বললাম, হুজুর! শতধাবিভক্ত সমাজে জিহাদ করা কি সম্ভব? তিনি বললেন, "জিহাদ নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাতের মতই তো ফরয। দুনিয়ার কেউ যদি নামায না পড়ে, রোযা না রাখে, যাকাত না দেয় ও হজ্ব না করে, তবে তোমাকে একা হলেও তা আদায় করতে হবে। এ কথা বলে বাঁচতে পারবে না যে, কেউ তো নামায পড়ছে না, তাই আমিও পড়ব না, কেউ যাকাত দেয় না, তাই আমিও দেব না ইত্যাদি। অতএব কেউ জিহাদ না করলে তোমাকে একা হলেও জিহাদ করতে হবে।"

সেনা অফিসারের জবান থেকে এসব মূল্যবান বক্তব্য শুনে আমি বললাম, হুজুর! জিহাদের জন্য আমি আমার জীবনকে ওয়াক্ত করে দিয়েছি। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারূদ সংগ্রহ করেছি। এখন জিহাদ কিভাবে করব, তা আপনারাই বলে দেবেন বলে আশা রাখি। আমার কথা শুনে উভয়ে মারহাবা মারহাবা বলে মুবারকবাদ জানালেন। আমি করজোড় আবেদন করলাম, হুজুর! আপনাদের নৌকাটি বড় না হলেও মাঝারি ধরনের। দশ-পনেরজন অনায়াসে থাকা যাবে। আপনার সাথে আমাদের দু'জনকেও শামিল করে নিন। আমাদের অনেক হাতিয়ার আছে, এগুলোর হেফাযতও করতে হবে। আশা করি আমাদেরকে আপনাদের নৌকায় আশ্রয় দিয়ে উপকার করবেন।

আমার কথায় তারা খুশি হয়ে আমদেরকে আশ্রয় দিতে সম্মতি জ্ঞাপন করলেন এবং বললেন, "আপনাদের মালপত্র জলদি নিয়ে আসুন।" আমি বললাম, ওসব একা এখানে আনা সম্ভব নয়। দয়া করে নৌকাটা আরো সামনে নিয়ে চলুন এবং আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমার কথা মতো তারা বৈঠা ঠেলে নৌকাটি আমাদের মালপত্রের নিকটে নিয়ে এল।

জাফর ভাইয়ের সহযোগিতায় ছায়েমাকে নিয়ে সব মালপত্র নৌকায় তুললাম। মালপত্র দেখে ইয়ার মোহাম্মদ গোভী খুবই বিস্মিত হলেন এবং সীমাহীন খুশি হলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "ওহে বীর পুরুষ! তোমরা এগুলো পেলে কোথায়? কোন সেনা ছাউনী

লুট করেছ বুঝি?" আমি বললাম, না স্যার, এগুলো গনীমত। কিভাবে হস্তগত হল তা পরে বলব।

আমরা সবাই নৌকায় উঠে বসলাম। এতক্ষণে সূর্য পশ্চিমাকাশে লুকানোর পথ খুঁজছে। একটু পরেই ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসবে। আমরা তাড়াতাড়ি অযু করে জামাতে নামায আদায় করলাম। ছায়েমা গাফিলতির ভান করে একটু বিলম্বে নামায আদায় করল। ছায়েমা সতর্ক করে বলল, "বিপদের কোন সময় নেই যে, অমুক দিন অতটায় আসবে। বিপদ ঘোষণা দিয়ে আসে না। তাই এক্ষুণি এখান থেকে বিদায় নিন। অন্যথায় বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে।" ছায়েমার কথামত আমরা অন্যত্র চলে যাওয়ার আয়োজন করলাম।

আর্মি ডিভিশনাল প্রধান ইয়ার মোহাম্মদ গোভী কান্ডারী সেজে পেছনের বড় বৈঠা ধরলেন। আমি ও হাবিলদার জাফর লুধী দু'জনে দু'টি দাঁড় দু'দিকে টানতে আরম্ভ করলাম। জীবনে এই প্রথম আমি বৈঠা হাতে ধরলাম। ছায়েমা বসে আছে নৌকার সম্মুখে। নতুন মাঝি, নতুন মাল্লা, নতুন সফর। ছায়েমা তার অভ্যাস অনুযায়ী তিলাওয়াত করছে। ভাটিয়ালী সুর ধরার জন্য কোন গায়ক নেই। বৈঠা ঠেলে চলছি অজানার উদ্দেশ্যে। আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা কান্ডারীর জানা নেই। নদীর কলতানে বৈঠা চালনা এক ধরনের মনে আনন্দের বিষয়। জাফর ভাই ও আমি একই সাথে বসে দাঁড় টানছি। দু'একটু আলাপও করছি।

জাফর ভাই ছায়েমার দিকে ইশারা করে বললেন, "এত অল্প বয়সে সৈনিকের চাকুরী! সৈনিক হওয়া তো অনেক কঠিন কাজ। কত সুন্দর চেহারা, কি সুন্দর চাহনি। টগবগে এক তরুণ সিপাহী।"

ওরা মনে করেছে আমরাও তাদের মতো পলাতক সৈন্য। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পলায়ন করেছি। জাফর ভাইয়ের কথায় বুঝতে পারলাম, ছায়েমা যে নারী, তা তারা এখনো ধরতে পারেননি।

ছায়েমাকে তারা অল্প বয়সের যুবক বলে মনে করছেন। আর বুঝতে না পারার কারণও রয়েছে। পরনে প্যান্ট, শার্ট, তার উপর মোটা জ্যাকেট। লম্বা চুলগুলো সুন্দর করে নীচে ফেলে হেলমেট মাথায় দিয়েছে। কাজেই মেয়ে হিসেবে চেনার আর জো নেই। আমাদের নৌকা এতক্ষণে বহু দূরে চলে এল। ছায়েমা নৌকায় বসে বসে নদীর দু'ধারের ঘন বন-জঙ্গলের সবুজ-শ্যামল দৃশ্য দেখছে। আমরা এখন দুশমনের নাগালের বাইরে। সূর্য্যটা যেন ক্লান্ত হয়ে পশ্চিমের গাছগাছালির নীচে লুকাচ্ছে। ক্রমশই কাল আঁধারে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। 

আমরাও তটে নোঙর ফেলে মাগরিবের নামায আদায় করলাম। সকলের পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে। রুটি বানাতে হবে, সালন রান্না করতে হবে। কে পাকাবে পরামর্শ চলছে। ছায়েমা বলল, "আমি পাকাব, আপনারা পরিশ্রান্ত, অনেক দূর থেকে দাঁড় টেনে আসছেন, আর আমি বসে বসে অলসতার পরিচয় দিচ্ছি।" জাফর ভাই বললেন, "ভাই! তুমি আমাদের মাঝে সবার ছোট, কাজেই আমরা খাওয়ার আয়োজন করি, তুমি বসে বসে দেখ।" কিন্তু ছায়েমা অতি অল্পসময়ে তার নিপুণ হাতে সুস্বাদু খানা তৈরি করে বলল, "আপনারা খানা খেয়ে নিন।" ছায়েমার কথায় সবাই অবাক! একি! এত তাড়াতাড়ি খানা তৈরি হয়ে গেল! আমরা হাত-মুখ ধুয়ে ছৈয়ের ভেতর প্রবেশ করে দেখি দস্তরখানা সাজানো। সবাই একত্রে বসে খানা খেলাম। এতো মজাদার খানা ও নিপুণ পরিবেশন দেখে সকলেই ছায়েমার প্রশংসা করতে লাগলেন।




Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

A touching story of an oppressed woman
Chat with us on WhatsApp