জীবনের পরিণতি — এক নির্মম সত্যের সামনে দাঁড়ানোর আহ্বান

 

জীবনের পরিণতি — এক নির্মম সত্যের সামনে দাঁড়ানোর আহ্বান
লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ

বন্ধুগণ,
আজ আমরা এমন একটি বাস্তবতা নিয়ে কথা বলবো—যা থেকে কেউ পালাতে পারে না।
যা ধনী–গরিব, শক্তিশালী–দুর্বল, রাজা–ফকির—সবাইকে একইভাবে স্পর্শ করে।
এটি জীবনের পরিণতি।
আমাদের হাঁটার শেষ বিন্দু—কবর।

মানুষ পুরো জীবন দৌড়ায়, কিন্তু যার দিকে দৌড়ায়—তা নিয়ে কোনোদিন ভাবেই না।
আমরা ভুলে যাই, গন্তব্য।
আল্লাহ তাআলা বলেছেন—
"مِنْهَا خَلَقْنَاكُمْ وَفِيهَا نُعِيدُكُمْ
وَمِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً أُخْرَى"
“আমরা তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছি, তাতে তোমাদের ফিরিয়ে দেবো, আবার সেখান থেকেই তোমাদের উঠাবো।” (সূরা তাহা ২০:৫৫)
এই আয়াত আমাদের যাত্রার শুরু, শেষ এবং পুনর্জন্ম—সবকিছু পরিষ্কার করে দেয়।

১. বন্ধুগণ, জীবন এক দৌড়—কিন্তু আমরা জানি না দৌড় কোথায় শেষ হবে।
মানুষ সারাজীবন দৌড়ায়।
কেউ চাকরির জন্য, কেউ টাকার জন্য,
কেউ সম্মানের জন্য, কেউ আবার নিজের পরিবারকে সুখী করার জন্য।

এই দৌড়ে আমরা ভুলে যাই জীবনের সবচেয়ে সত্য বাক্য—
"أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ"
“বেশি বেশি অর্জনের প্রতিযোগিতা তোমাদের ব্যস্ত করে রেখেছে।” (সূরা তাকাসুর 102:1)
আরেকটি আয়াতে আল্লাহ বলেন—
"حَتَّىٰ زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ"
—“এ ব্যস্ততা চলতেই থাকে, যতক্ষণ না তোমরা কবর পর্যন্ত পৌঁছে যাও।” (সূরা তাকাসুর 102:2)

বন্ধুগণ,
মানুষ ভাবে—আমি এইটুকু অর্জন করলেই পরিপূর্ণ হবো।
কিন্তু সে জানে না, পরিপূর্ণতা দুনিয়ার জিনিসে নেই।
এ দৌড় অসীম, এর কোনো শেষ নেই—শেষ আছে শুধু কাধে তুলে নেওয়া সেই মুহূর্তে।

২. বন্ধুগণ, যাদের জন্য এত কষ্ট করি—শেষমেশ তারাই আমাদের মাটিতে পুঁতে দেয়।
এটা জীবনের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতা।

যাদের জন্য মানুষ সারাজীবন পরিশ্রম করে,
ঘাম ঝরায়, অহংকার ভাঙে,
নিজেকে ভুলে যায়—
শেষমেশ সেই মানুষগুলোই আমাদের কবর খুঁড়ে মাটিতে শুইয়ে দেয়।

কিন্তু এটিই সত্য, কারণ আল্লাহ বলেছেন—
"إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ"
“তুমি মরবে, তারা-ও মরবে।” (সূরা যুমার 39:30)
মৃত্যু সবার জন্য সমান।
কেউই কাউকে বাঁচাতে পারবে না।
কবরের দরজায় মানুষের ভালোবাসা থেমে যায়।
এখানে কেউ থাকে না—
না স্ত্রী, না সন্তান, না প্রিয় বন্ধু, না পৃথিবীর কোনো অর্জন।

৩. বন্ধুগণ, কবর শেষ নয়—এখান থেকে আসল জীবন শুরু,
মানুষ ভাবে কবরই শেষ।
কিন্তু কুরআন বলে—
"وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ"
—“আখেরাতের ঘরই আসল জীবন।” (সূরা আনকাবূত 29:64)

এ দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী, এখানে সুখ–দুঃখ অস্থায়ী, এখানে মানুষ জন্মায়, বাঁচে, সুস্থ হয়, অসুস্থ হয়—শেষমেশ মাটিতে মিশে যায়।
কিন্তু কবরের দরজায় ঢোকার সাথে সাথে আসল জগৎ শুরু হয়।
যেখানে মৃত্যু নেই,
বুড়ো হওয়া নেই, সময় নেই—শুধু হিসাব।

৪. বন্ধুগণ, জীবন আসলে একটি পরীক্ষা মাত্র
আল্লাহ তাআলা বলেছেন—
"لِنَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا"
“কে ভালো কাজ করে—তোমাদের পরীক্ষা করার জন্যই জীবন।” (সূরা হুদ 11:7)

আরও বলেন—
"وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُورِ"
“দুনিয়ার জীবন প্রতারণাময় ভোগমাত্র।” (সূরা আলে ইমরান 3:185)

বন্ধুগণ,
আমরা পরীক্ষা ভুলে যাই,
এবং পরীক্ষার প্রশ্ন ভুলে—বাইরের উৎসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই।

মানুষ ভাবে—
✓ বড় ঘর হলে জীবন সফল
✓ বেশি টাকা হলে জীবন সুন্দর
✓ সবাই প্রশংসা করলে জীবন অর্থপূর্ণ
কিন্তু মৃত্যু বলে দেয়— কিছুই আমাদের নয়।

৫. বন্ধুগণ, আল্লাহ স্পষ্টভাবে বলেছেন—সবকিছু তাঁর
"لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ"
“আকাশে ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর।”
(সূরা বাকারা 2:284)
আমরা যা কিছু পেয়েছি—
সন্তান, সম্পদ, শক্তি, জ্ঞান, সময়—
সবই আল্লাহর দেওয়া অমানত।
এই অমানত ফেরত যাবে তার মালিকের কাছে।

৬. বন্ধুগণ, কবর—মানুষের অহংকার ভেঙে দেয়
যে মানুষ ভাবত— “আমি বড় লোক”,
“আমি শক্তিশালী”, “আমি বড় নেতা”,
“আমি ছাড়া পৃথিবী চলে না”—
কবর তাকে শুইয়ে দেয় এক হাত মাটির নিচে।

কুরআনে আছে—
"كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ"
“প্রত্যেক প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহন করবে।” (সূরা আলে ইমরান 3:185)
এ সত্য কারো জন্য থামে না।
এ সত্য কোনো জাতিকে ছাড় দেয় না।
এ সত্য কোনো শক্তিকে ভাঙতে পারে না।

৭. বন্ধুগণ, মৃত্যুর পরে মানুষ একা হয়ে যায়।
আল্লাহ বলেন—
"وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَىٰ"
—“তোমরা আমাদের কাছে আসবে একা।” (সূরা আনআম 6:94)
একা মানে—
✓ সন্তান থাকবে না ✓ সম্পদ থাকবে না
✓ সম্পর্ক থাকবে না ✓ শক্তি থাকবে না
✓ খ্যাতি থাকবে না
থাকবে শুধু— আমল এবং হৃদয়।

৮. বন্ধুগণ, সেদিন ধন-সম্পদ বা সন্তান কিছুই কাজে আসবে না।
আল্লাহ বলেন—
"يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ
إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ"
—“সেদিন ধন-সম্পদ ও সন্তান কোনো উপকারে আসবে না, উপকার করবে শুধু বিশুদ্ধ হৃদয়।”
(সূরা আশ-শু‘আরা 26:88–89)
হৃদয়—যা ছিল সৎ, সত্যের প্রতি বিনম্র,
অন্যায় থেকে দূরে, আর মানুষের জন্য দয়ালু।

৯. বন্ধুগণ, যিনি মৃত্যু সৃষ্টি করেছেন—তিনি জীবনের মানেও বোঝান।
আল্লাহ বলেন—
"الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ
لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا"
“তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য—কার কাজ সবচেয়ে ভালো।”
(সূরা মূলক 67:2)
এ আয়াত পুরো জীবনের সংজ্ঞা দিয়ে দেয়।
জীবন উপভোগ—পরীক্ষা।
দুঃখ—পরীক্ষা।
সুখ—পরীক্ষা।
সম্পদ—পরীক্ষা।
সন্তান—পরীক্ষা।
আমরা শুধু পরীক্ষার্থী—
কাগজ জমা দিয়ে চলে যেতে হবে।

১০. বন্ধুগণ, শেষপর্যন্ত সবাই ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে।
এ বাক্যটি আমরা অনেকবার শুনি—
"إِنَّا لِلَّهِ وَإِنَّا إِلَيْهِ رَاجِعُونَ"
“আমরা আল্লাহর এবং আমরা তাঁর দিকেই ফিরে যাবো।”
(সূরা বাকারা 2:156)
এটি শুধু দুঃখের বাক্য নয়। এটি আমাদের পরিচয়।
এটি আমাদের গন্তব্য। এটি আমাদের শান্তি।

১১. বন্ধুগণ, কবরকে ভুলে থাকলে জীবন নষ্ট হয়ে যায়।
যে মানুষ কবর ভুলে যায়—
✓ সে অন্যায় করে, ✓ সে অহংকার করে
✓ সে মানুষের প্রতি কঠোর হয়
✓ সে হিসাবকে ভয় পায় না
✓ সে জীবনের উদ্দেশ্য ভুলে যায়
কিন্তু যে মানুষ কবর মনে রাখে,
সে কখনো অন্যকে কষ্ট দেয় না।
কারণ সে জানে—
একদিন প্রতিটি কাজের হিসাব হবে।

আল্লাহ বলেন—
"فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ
وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ"
(সূরা যিলযাল 99:7–8)
অণু পরিমাণ ভালোও দেখা হবে।
অণু পরিমাণ খারাপও দেখা হবে।

১২. বন্ধুগণ,  যেহেতু জীবন ক্ষণস্থায়ী,
যেহেতু গন্তব্য—কবর, তাহলে বাঁচবো কিভাবে?
আল্লাহ বলেন—
"وَافْعَلُوا الْخَيْرَ"
“ভালো কাজ করো।” (সূরা হজ্জ 22:77)
ভালো কাজ কী? ভালো কাজ হলো,
✓ মানুষের প্রতি দয়া
✓ অন্যায় থেকে দূরে থাকা
✓ অহংকার ছেড়ে বিনম্র হওয়া
✓ প্রতিবেশীদের সাহায্য করা
✓ সত্য কথা বলা
✓ কারো দুঃখ কমানো
✓ কারো কষ্ট না বাড়ানো
✓ অপচয় থেকে বাঁচা
✓ কৃতজ্ঞ থাকা
এগুলোই জীবনকে সুন্দর ও অর্থপূর্ণ করে।

১৩. বন্ধুগণ, পৃথিবীকে ভালোবাসা যাবে—কিন্তু আঁকড়ে ধরা যাবে না।
আল্লাহ বলেন—
"إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ"
“তোমাদের সম্পদ ও সন্তান তোমাদের জন্য পরীক্ষা।” (সূরা আনফাল 8:28)

অতএব,
দুনিয়াকে ঘৃণা করতে বলা হয়নি—
কিন্তু দুনিয়ার দাস হতে নিষেধ করা হয়েছে।
আমরা পৃথিবী ব্যবহার করবো,
কিন্তু পৃথিবী যেন আমাদের ব্যবহার না করে।

১৪. বন্ধুগণ, কবরকে স্মরণ করা মানে জীবনকে সোজা করা।
মৃত্যু ভয় নয়।
মৃত্যু হলো সত্যের সামনে দাঁড়ানো।
যে মৃত্যু মনে রাখে—
সে ভালো থাকে।
সে শান্ত থাকে।
সে সঠিক পথে থাকে।

বন্ধুগণ, জীবন এত বড় নয় যতটা আমরা ভাবি
জীবন শুরু হয় কান্না দিয়ে,
শেষ হয় নিস্তব্ধতায়।
কিন্তু মাঝের অংশটাই আমাদের পরিচয়।
এই মাঝের অংশটুকু— পরিপূর্ণ হোক সত্যে,
সৌন্দর্যে, দয়ায়, মানবিকতায়,
এবং পরিণতিকে স্মরণ করে।
কারণ শেষমেশ থাকবে শুধু—
হৃদয় এবং আমল।

Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

সমাজে সততা ও ইমানের গুরুত্ব  লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ
Chat with us on WhatsApp