শিয়া–সুন্নি সংঘর্ষে তৈরি- হাদিসের পাহাড়


 শিয়া–সুন্নি সংঘর্ষে তৈরি- হাদিসের পাহাড়

লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ
বন্ধুগণ!
ইতিহাস যখন নীরবে কাঁদে, তখন মাটি শোনে। আর যখন সত্য চাপা পড়ে যায়, তখন আকাশ সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ আমি আপনাদের এমন এক ইতিহাস শুনাতে এসেছি—যেখানে শুধু মিথ্যা তৈরিই হয়নি, বরং সেই মিথ্যাকে পবিত্রতার মোড়কে মুড়ে ‘ইসলামের অংশ’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আজকের আলোচনা সেই ইতিহাস,
যেখানে শিয়া–সুন্নির দলীয় সংঘর্ষ পুরো মুসলিম দুনিয়ায় তৈরি করেছে হাদিসের পাহাড়,
এমন পাহাড় যার নিচে চাপা পড়ে গেছে কুরআনের আলো,
চাপা পরে গেছে নবীর প্রকৃত বার্তা আর সত্যের আসল চেহারা।

বন্ধুগণ!
এই গোষ্ঠীসংঘর্ষ শুরু হয়েছিল ক্ষমতার রাজনীতি দিয়ে—খিলাফত কার? নেতৃত্ব কার? সাহাবাদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? কার মর্যাদা বেশি? অথচ কুরআন বলছে— إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ — “মর্যাদা শুধু তাকওয়ায়।”
কিন্তু মানুষের দলীয় রাজনীতি যখন মাথায় চড়ে বসে, তখন তাকওয়া ভুলে যায়, কুরআন দূরে যায়, আর জায়গা দখল করে ‘আমার দল–তোমার দল’

বন্ধুগণ!
শিয়ারা বলল— “আলীই শ্রেষ্ঠ, কারণ নবী গাদিরে খুমে তাকে উত্তরাধিকার ঘোষণা করেছেন।”
সুন্নিরা বলল— “না, আবু বকর শ্রেষ্ঠ; তার ফজিলত নিয়ে অসংখ্য বর্ণনা আছে।”
এভাবেই দুই পক্ষ দুই দিকের মহাসড়ক ধরে শুরু করল “ফাজায়েল হাদিস” উৎপাদন।

বন্ধুগণ!
এটা আমি বানানো কথা বলছি না—
ইবনে আবিল হাদিদ তার কিতাব (শরহে নাহজুল বালাগা) বইয়ে স্পষ্টভাবে লিখেছেন:
➡️ শিয়ারা আলীর গুণ বাড়ানোর জন্য শত শত হাদিসের বর্ণনা বানিয়েছে।
➡️ সুন্নিরা আবু বকর, ওমর, ওসমান—এদের গুণ বাড়াতে পাল্টা হাদিস বানিয়েছে।

ইবনে আবিল হাদিদের ভাষায়—
“রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো নিজেদের পছন্দের ইমামের মর্যাদা বাড়াতে মিথ্যা হাদিস তৈরি করত।”

বন্ধুগণ!
ভাবেন তো—
একদল বলছে: “আলী শ্রেষ্ঠ”,
আরেক দল বলছে: “আবু বকর শ্রেষ্ঠ”—
এবং তাদের প্রতিটা কথাই “হাদিস” নামে প্রচারিত!
এভাবে সত্য আর মিথ্যার ফারাক কোথায় থাকবে?

বন্ধুগণ!
ইবনে জাওযীর লিখিত বিখ্যাত বই আল-মাওদুআত।  এই বইয়ে তিনি ১৮৪ জন হাদিস জালকারীর নাম লিখেছেন। ১৮৪ জন!
যাদের নামের পাশে লেখা— “ফাজায়েল বানাতেন”, “অমুক সাহাবির গুণ বাড়াতেন”, “অমুক দলের মান বাড়ানোর জন্য বর্ণনা তৈরি করতেন”।

এটা কী? এটা কি ইসলাম?
এটা কি সেই দীন, যা সত্যের উপর দাঁড়ানোর কথা?
নাকি এটা গোষ্ঠীর রাজনীতি?

বন্ধুগণ!
একজন জালকারী ছিলেন—নুসাইর।
তার নামের পাশে ইবনে জাওযী লিখেছেন—
“তিনিই আলীর ফাজায়েল নিয়ে অসংখ্য মিথ্যা বানিয়েছেন।”

একজন ছিলেন—মুগীরাহ।
যাকে ইমাম দারাকুতনী বলেছেন—
“মিথ্যার পাহাড়।”

আরেকজন ছিলেন—সাকফী।
তাকে নিয়ে লেখা আছে—
“তিনি ওসমান ও উমাইয়া পরিবারের মর্যাদা রক্ষার জন্য মিথ্যা হাদিস বানাতেন।”

বন্ধুগণ!
এগুলো কি গল্প?
না, এগুলো মুসলিম ইতিহাসের কবরের ভেতর লুকানো নোংরা নথি—যা বলা হয় না, শেখানো হয় না, আলোচনা হয় না। কারণ বললেই ভেঙে যাবে সেই কৃত্রিম কাঠামো, যেটার উপর দাঁড়িয়ে আছে রাজনৈতিক ইসলাম, দলীয় ইসলাম, মাদ্রাসা ইসলাম, এবং আমাদের মাথায় চাপানো হাদিসের পাহাড়।

বন্ধুগণ!
শিয়া–সুন্নির লড়াই মোটেই সাধারণ লড়াই ছিল না।
এটা ছিল মতের লড়াই নয়— এটা ছিল ক্ষমতার লড়াই।
এটা ছিল ভবিষ্যতের কৌশল নির্ধারণের লড়াই।

যার ইমাম শ্রেষ্ঠ— তার দল শ্রেষ্ঠ,
তারই ধর্ম ‘সঠিক’, তারই ব্যাখ্যা ‘মূলধারা’।

তাই প্রতিটি পক্ষ চাইত—
“আমাদের ইমামের ফজিলত বেশি দেখাতে হবে।”
আর তখনই শুরু হলো হাদিস তৈরির শিল্পকারখানা

বন্ধুগণ!
একদল বানালো—
“আলীকে দেখে ফেরেশতারা সিজদা করে!”
অন্যদল বানালো—
“আবু বকর জান্নাতের পাখি!”
আরেকদল বানালো—
“ওমরকে ভয় পেয়ে শয়তান রাস্তা পাল্টে ফেলতো!”

এই বর্ণনাগুলোর উৎস কী?
কুরআন? না। সত্য? না। গবেষণা? না।
উৎস—গোষ্ঠীর প্রতিযোগিতা

বন্ধুগণ!
আপনি যদি ভাবেন, শুধু শিয়ারা মিথ্যা বানিয়েছে—
ভুল করবেন।
ইবনে জাওযী লিখেছেন—
“মিথ্যা বানানোর ক্ষেত্রে কোনো দলই কম ছিলনা।”
সুন্নিরাও বানিয়েছে, অর্থাত উমাইয়ারা বানিয়েছে, আব্বাসীরা বানিয়েছে।
কারণ মিথ্যা কখনও একদলের সম্পত্তি হয় না;
যেখানে দলীয় স্বার্থ আছে, সেখানে মিথ্যা স্বাভাবিকভাবে জন্মায়।

বন্ধুগণ!
কুরআন নিজেই বলছে—
وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا
“রবের বাণী সত্য ও ন্যায় দিয়ে পূর্ণ।”
আর নবী বলেছেন—
تركت فيكم ما تمسكتم به لن تضلوا بعدي أبداً: كتاب الله
“আমি তোমাদের রেখে গেলাম আল্লাহর কিতাব; এটিকে ধরলে কখনও ভ্রান্ত হবে না।”

কিন্তু গোষ্ঠীপক্ষ কী করল?
কুরআনকে রেখে দিল পাশে—
আর দলের নেতা/ইমামের ফজিলত বাড়াতে বানাতে লাগল একের পর এক বর্ণনা।

বন্ধুগণ!
একজন শিয়া আলেম লিখলেন—
“নবী আলীকে ৭০ বার জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।”
পাল্টা একজন সুন্নি আলেম লিখলেন—
“নবী আবু বকরকে ৭০ বার জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।”
এই ৭০ সংখ্যাটা কোথা থেকে এলো?
কুরআনে আছে?
কোথাও নেই।

এটা গোষ্ঠীর বানানে সংখ্যা—
যারা গুণ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিখেছে “আমরাই সেরা!”

বন্ধুগণ!
একদল বলল—
“মুয়াবিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলা হারাম”— এটা নাকি হাদিস!
কিন্তু ইবনে কাসীর বলেন—
“এটা মিথ্যা; এটা বানানো হয়েছে রাজনৈতিক শান্তির নামে!”

অন্যদল বানালো—
“ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে ফেরেশতারা নেমেছিল!”
ইবনে জাওযী এমন বর্ণনাকে বলেছেন—
“এগুলো পুরোপুরি fabrications।”

বন্ধুগণ!
একথা কি আপনাকে ভাবায় না—
যদি ধর্ম সত্য হয়, তবে ধর্ম রক্ষায় মিথ্যা কেন দরকার?
কেন একজন সাহাবির মর্যাদা বাড়াতে মিথ্যা লাগল?
কেন একজন ইমামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে জালকারী  নেওয়া হল?

বন্ধুগণ!
মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে থাকা কোনো সমাজ টিকে না।
আজ শিয়া–সুন্নির মধ্যে যে ঘৃণা, যে রক্তপাত,
যে অবিশ্বাস—
তার একটা বড় কারণই হলো এই ফাজায়েল–মিথ্যার পাহাড়।

শিয়ারা বলে— “সুন্নিরা আলীর হক খেয়েছে।”
সুন্নিরা বলে— “শিয়ারা সাহাবিদের গালি দেয়।”
কিন্তু কুরআন কী বলে?
تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ
“তারা ছিল অতীতের একটি জাতি।”

অতীতের লড়াই আজকের লড়াই হওয়ার কথা নয়।
কিন্তু হাদিসের মিথ্যা বর্ণনা উভয় পক্ষের ঘৃণাকে জ্বালানি দিয়েছে শত শত বছর ধরে।

বন্ধুগণ!
এই বিশাল ইতিহাসের শিক্ষা মাত্র একটাই—
দলীয় ইসলাম আমাদেরকে কুরআন থেকে দুই হাজার কিলোমিটার দূরে সরিয়ে দিয়েছে।

কুরআনকে আলমারিতে রেখে,
দলের বড়ত্ব প্রমাণের জন্য মিথ্যা বানানো হয়েছে,
কুরআনের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে—
إِثْمًا مُبِينًا — “পরিষ্কার অপরাধ।”

আমাদের সামনে আজ দুটি পথ—
এক: গোষ্ঠীর মিথ্যা অনুসরণ করে বিভক্ত থাকা।
দুই: কুরআনকে মাপকাঠি ধরে সত্যকে আলাদা করা।

বন্ধুগণ!
ইবনে আবিল হাদিদ, ইবনে কাসীর, দারাকুতনী, ইবনে জাওযী—
এসব ইতিহাসবিদরা বলতে চেয়েছেন—
“মিথ্যা প্রচুর আছে, তাই চোখ খোলা রাখো।”
এখন চোখ খোলার দায়িত্ব, সত্য যাচাইয়ের দায়িত্ব—
আমাদের।
এখন সময় ফ্রেন্ডস অফ কুরআন হওয়ার,
এখন সময় কুরআনের বন্ধু হওয়ার।
এখন সময় মিথ্যাকে তাড়িয়ে দেয়ার,
এখন সময় সত্যকে আকড়ে ধরার, 

Post a Comment

0 Comments

শিয়া সুন্নিদের হাদিস কতগুলো

সমাজে সততা ও ইমানের গুরুত্ব  লিখকঃ মাহাতাব আকন্দ
Chat with us on WhatsApp